কোনো একটা মহান সৃষ্টি, স্রষ্টা হয়তো হারিয়ে যায়; বহু বছর পরও আমি যখন তা খুঁজে নিয়ে দেখব, জানব, তখনই তা নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। দিগন্ত উন্মোচনের মতো আমার সামনে সৃষ্টিদুয়ার খুলে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের বুকে একটি সৃষ্টি। সেই সৃষ্টিকে নিয়ে লেখা কবিতা, গান, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র—সবই সৃষ্টির ভেতর গড়ে ওঠা নতুনতর সৃষ্টি। তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদের তথ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ দেখার পর নিজের ভেতরে আবার একটা ঝড় নাড়া দিয়ে গেল।
ইতিহাসের পাতা ওলটায়। লিয়ার লেভিন নামের এক মার্কিন চিত্রপরিচালক ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের ওপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করতে এসেছিলেন। বাংলার মাটি আর মানুষের সঙ্গে তখনই তাঁর হৃদয়ের যোগসূত্র গড়ে ওঠে। পরের বছরই সেই মানুষেরা যখন মস্ত একটা ঝড়ের দোলায় ছন্নছাড়া হয়ে দুলছে, লড়ছে, মরছে; লেভিন নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। আবার ফিরে এলেন। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুশিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে মানুষের যন্ত্রণার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। আলাপ হলো বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামের একটি দলের সঙ্গে। সেই দলের সদস্যরা শরণার্থীশিবিরে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ডেরায় গিয়ে গান করে বেড়ান। গান দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেন, প্রাণ ধরে রাখার চেষ্টা করেন। লেভিন সেই দলের সঙ্গে জুড়ে যান। ট্রাকে ঘুরে ঘুরে গান শোনেন, মানুষ দেখেন আর ফুটেজ তুলে রাখেন।
সেই সংগ্রামী গানের দলে ছিলেন তারেক মাসুদের ভাই মাহমুদুর রহমান বেণু। লিয়ার লেভিন আর্থিক কারণে তথ্যচিত্র বানিয়ে উঠতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে দেশে ফিরে যান। বেণুর মুখ থেকে সব কথা শুনে তারেক আর ক্যাথরিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে লেভিনকে খুঁজে বের করেন। ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেন। রসদ পেয়ে তাঁদের সামনে সৃষ্টির নবদিগন্ত খুলে যায়।
দেশের মাটিতে সেই গানের দলকে খুঁজে বের করেন তারেক। বেণু গানের দলের প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখা অভিজ্ঞতার কথা বলে যেতে থাকেন। আরও অনেক ফুটেজ নানা সূত্র থেকে আসে। কিন্তু লেভিনের ফুটেজগুলো সব থেকে সেরা। সেই ফুটেজ তথ্যচিত্রে জুড়ে যেতে থাকে।
কচুরিপানায় ফুল থাকে। সেই ভাসমান ফুল আমরা দেখি আর অবহেলা করি। ভাবি নিকৃষ্ট। তারেক সেই ফুলকে নারীর খোঁপায় তুলে আনতে পারেন। তারেক বন্দুকের নলের মুখে লাল কলাবতী ফুল দেখান। রক্তকরবী এমন কোনো বাহারি ফুল তো নয়, সাধারণ ধারণায়। রবীন্দ্রনাথ সেই রক্তকরবীকে জনজাগরণের চেতনায় উদ্দীপিত করেছিলেন। তারেকও সেই ফুলের মতো অবহেলিত দরিদ্র, যুদ্ধপীড়িত মানুষের যন্ত্রণা, জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-স্থিতি-লয়—যুদ্ধের দোলায় আক্ষরিক রূপ দিয়ে চলেন।
আর থাকে গান। মাটির গান, মানুষের গান, বেঁচে থাকার জাগরণের গান। যুদ্ধের সময় সেই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীরা এভাবে যে ভাবতে পেরেছিলেন, সেটাই তো মস্ত বড় সৃষ্টিচেতনা। উদ্বাস্তুশিবিরে শিবিরে তাঁরা থাকেন, খান; মানুষ কীভাবে পশুর মতো টিকে আছে, দেখে কষ্ট পান। হাত ধরে থাকেন, শিশুকে কোলে তুলে নেন। যে শোকের সান্ত্বনা নেই, সেখানেও গান শুনিয়ে একটু জাগিয়ে রাখেন। যাঁরা গান করছেন, তাঁদের রক্তেও তখন জয় বাংলা। যারা গান শুনছে, তাদের ক্রন্দনেও তখন জয় বাংলা। উদ্বাস্তুশিবিরে একটি উদ্বাস্তু পাখিও মিলে যায়। খাঁচায় ভরে তাকে নিয়ে এসেছেন কেউ। সে-ও কবিতার মতো শুনতে শুনতে একসময় বলে ওঠে ‘জয় বাংলা’।
কচুরিপানার মতো দেশের নদীতে তখন লাশ ভাসে। দেশের পথে-মাঠে-ঘাটে লাশের মতো নির্জীব রক্তাক্ত ফুল। গানের দল পারমিট নিয়ে মুক্তাঞ্চলে ঢোকে। মুক্তিবাহিনীকে দেখে ইচ্ছা জাগে, গান ছেড়ে অস্ত্র তুলে নিতে। কিন্তু চোখে ক্ষীণ জ্যোতি চশমা, শারীরিক পরীক্ষায় পাস না করে আর তো যুদ্ধ করা যায় না। তবু প্রস্তাব বিবেচনায় থাকে। ওরা একটি ফুলকে বাঁচাবে বলে গান শুনিয়ে বেড়ায়। ওরা লাখো মানুষের মুখের হাসির জন্য গান শুনিয়ে বেড়ায়।
তারেকের ‘মুক্তির গান’-এ রবীন্দ্রনাথ ঘুরেফিরে আসেন। আরও অনেকের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন দুই বাংলার শিল্পীরা। বিজয়ের পতাকা ওড়ে, গান গেয়ে বেড়ানো দল দেশে ফেরে। তারেক প্রশ্ন রেখে তথ্যচিত্র শেষ করেন। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এল, এখন সেই স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে তো দেশ?
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত