কবরী ছাড়া ‘সারেং বৌ’ হয় না

কবরীফাইল ছবি

একটা প্রচলিত কথা আছে, নাবিকদের বন্দরে বন্দরে বউ থাকে। বর্তমান সময়ের কোনো বাজারমুখী প্রমোটার লেখককে যদি এমন কোনো নাবিককে নিয়ে উপন্যাস লিখতে বলা হয়, তিনি অ্যাডভেঞ্চার আর রোমান্সে ভরপুর রগরগে যৌনতানির্ভর তুখোড় একটা লেখা নামিয়ে আনতে পারবেন। সেই বই প্রচুর বিক্রিও হবে। কিন্তু কোনো জীবনপোড়া লেখক যখন কোনো নাবিক বা সারেংয়ের কথা লিখবেন, সেই উপন্যাসের ধারেকাছেও কেউ যেতে পারবেন না। প্রখর জীবনদর্শন, জীবনের ঘাত–প্রতিঘাত যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি, মুহুর্মুহু যুদ্ধের দামামা, মাটি থেকে উঠে আসবে জীবনযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস।

শহীদ লেখক শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন তেমনই এক আজীবন লড়াকু সংগ্রামী জীবনপোড়া লেখক। নিজের রক্ত দিয়ে যিনি দেশের কথা লেখেন। এই বামপন্থী লড়াকু লেখককে পরাধীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অভিযোগে কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল। সেই বন্দিত্বযাপনেও কলম থেমে থাকেনি তাঁর। লৌহ কপাটের ভেতর বসে মুক্তির ডাক ‘সারেং বৌ’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন তিনি।

এই উপন্যাসের কদম সারেংও সমুদ্রের ডাকে, পেশার তাগিদে জাহাজের কাজে বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়ায়। সেখানেও অনেক গণবধূ পেটের তাগিদে অর্থের বিনিময়ে দীর্ঘ দিনের ঘরছাড়া নাবিকদের যৌন ক্ষুধা মিটিয়ে সঙ্গ দিতে আসে। কিন্তু কদম কখনো জৈবিক প্রবৃত্তির সেই প্রলোভনে মজে না। কারণ, ঘরে তার সুন্দরী বউ আছে। এই সম্পর্কের আবহমানকালের একটা প্রবল বাঁধন আর বিশ্বাস আছে, যা তাকে বিপথগামী হতে দেয় না। সেই সুন্দরী বউয়ের লড়াই–সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি। নারীর মুক্তিসংগ্রামের এক অনবদ্য দলিল, আখ্যান।

উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন কূটনৈতিক ও লেখক সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর বইটির ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত প্রথম আলো পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে ‘সারেং বৌ নবিতুনের জীবনসংগ্রাম’কে আনিসুজ্জামান উপন্যাসের মূল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘নবিতুন বাংলা সাহিত্যের আরেকজন সতীসাধ্বী নয়, নিজের অস্তিত্ব ও সম্মান রক্ষায় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধরত নারী। পরিণামে তার মুখে সদ্য জাগা পলির স্নিগ্ধতা, বিজয়িনীর গৌরব।’ আবার সম্প্রতি বাংলাদেশের বামপন্থী নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ফেসবুক পোস্ট থেকে জেনেছি, ১৯৬৭ সালে রুশ বিপ্লবের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদুল্লা কায়সার একটি গান লিখেছিলেন। গানটির তিনটি চরণ হলো, ‘নদীর কলতানে আমরা/সাগরের গর্জনে চলি অবিরাম/অগ্নি আখরে লিখি মোদেরই নাম।’ ‘সারেং বৌ’ উপন্যাসে গ্রাম্য কন্যা নবিতুনের সহজ–সরল জীবনের প্রতি পদেও একটা নদীর কলতান আছে; খেজুরপাতার নূপুরের ধ্বনির মতো যা রুমঝুম ঝুমঝুম বাজে। আবার কঠিন সংগ্রামের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদী সত্তা সাগরের গর্জনও আছে। যে গর্জন স্থান–কাল–পাত্রবিশেষে আলাদা হলেও পৃথিবীর প্রতিটি দেশে জীর্ণ পুরাতন অচলায়তন ভেঙে নতুন বিপ্লব আনে। উপকূল অঞ্চলের লড়াকু কন্যা অগ্নি আখরে তাই নিজের নাম লিখে যায়। তাই বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘সারেং বৌ’কে অবশ্যই রাখা যাবে।

বাংলাদেশের আরেক প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব নাট্যকার ও চিত্রপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ১৯৭৮ সালে সেই ‘সারেং বৌ’কে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ভাবের সঙ্গে ভাবের তরঙ্গ যদি একই স্রোতে এসে মিলে যায়, তখন তা হয় রাজযোটক। আবদুল্লাহ আল মামুন শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাস নিয়েও ধারাবাহিক নাটক তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সেই ধারাবাহিক অল্প বয়সে আমাকেও মজিয়ে রেখেছিল। লেখকের মন ও মননের প্রতিটি গতিপথ–গতিধারা এই নির্মাতা বুঝতেন, তাই সাহিত্যের পাতাকে যথাযথ নান্দনিক দর্শনে ভিন্ন মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

বাংলাদেশের অভিনয় জগতের কিংবদন্তী শিল্পী কবরী। পরিচালক তাঁকে ‘সারেং বৌ’ হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। প্রতিটি দৃশ্যে সূক্ষ্ম ও নিপুণ অভিনয়দক্ষতায় কালজয়ী এই শিল্পী বুঝিয়ে দিয়েছেন, কবরী ছাড়া ‘সারেং বৌ’ হয় না। যখন সে দুরন্ত চঞ্চল গ্রাম্য কিশোরী, গ্রামের নদী, মাঠ, ঘাস তার অভিব্যক্তিতে দ্যুতি ছড়ায়। সারেং কদমের সঙ্গে প্রণয়ের দৃশ্যে ফুলের ওপর যেন প্রজাপতি খেলে বেড়ায়। কদমের ঘরে লাল টুকটুকে বউ হয়ে রক্তিম আভা ছড়ায়। কদমকে সমুদ্র আবার ডাকে, আবার সে জাহাজে ফিরে যাবে। নব পরিণীতা বউ সন্তানের জন্ম দেবে। দারিদ্র্য তার নিত্যসঙ্গী। পরনের শাড়িটি তখন অতি ধূসর, মলিন। ব্লাউজটিও ছেঁড়া। এ পর্যায়ে কবরীর অভিনয়ও যেন ধূসর পাণ্ডুলিপি; ‘পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চলে যায় যেন কোনো মৃত্যুর ওপারে’! চরম দারিদ্র্য, তীব্র বিষাদ, পতির বিরহ, বুক ঝলসানো কান্না বারবার তাকে গ্রাস করে নেয়। গ্রামের মোড়ল বাজপাখি নানাভাবে তার ওপর এসে ডানা ঝাপটায়। লড়াই কিন্তু থামে না। কান্নার রং বারবার আগুনের ফুলকি হয়ে ওঠে। নির্জন পাটখেতে মোড়ল ধর্ষণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়লে বউটি দাঁত দিয়ে কামড়ে দেয় তাকে। মুখে উঠে আসে রক্ত। চৌধুরী বাড়িতে দাসীর কাজ করতে গিয়ে ছোট চৌধুরীর শরীরলোভী লালসার চোখে ফিরিয়ে দেয় চরম ঘৃণা। হরিণীর যৌবন; শরীরের মাংস যেন তার শত্রু। সে মানুষ নয়, তার কোনো মন নেই, মান–সম্মান থাকতে নেই, থাকে শুধুই শরীর।

ওদিকে কদম কিন্তু চিঠি আর টাকা পাঠিয়ে যায়। গ্রামের পোস্টমাস্টারকে দিয়ে মোড়ল সব চুরি করে। জাহাজের নোঙর ফেলা বন্দরে দেদার চোরাকারবার চলে, গ্রামেরই চাচা কদমের পকেটে চোরাই মাল ঢুকিয়ে দেয়। কদম জানতেও পারে না। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে মিথ্যা মামলায় জেল হয় তার। গ্রামের সবাই ধরে নেয়, কদম আর বেঁচে নেই।

কিন্তু সন্তানের জন্য নবিতনকে বাঁচতে হয়। কদম একদিন ফিরে আসবে, মন এখনো বলে যায়। মায়ে–ঝিয়ে মিলে পান্তা খায়। সন্তানকে সেদ্ধ করে দেবে বলে শাপলা তুলে আনে। পশ্চিমবঙ্গের চরম দরিদ্র উদ্বাস্তু জীবনে আমার মা–ও একসময় আমাদের এভাবে শাপলা, কচু, লতা–পাতা তুলে এনে সেদ্ধ করে খাওয়াত। দেশে দেশে সব বঞ্চিত, পীড়িত মানুষের জীবনের গল্পগুলো কোথাও একটা এসে যেন এভাবে একই রকম হয়ে মিলে যায়।

ওদিকে কদম কিন্তু চিঠি আর টাকা পাঠিয়ে যায়। গ্রামের পোস্টমাস্টারকে দিয়ে মোড়ল সব চুরি করে। জাহাজের নোঙর ফেলা বন্দরে দেদার চোরাকারবার চলে, গ্রামেরই চাচা কদমের পকেটে চোরাই মাল ঢুকিয়ে দেয়। কদম জানতেও পারে না। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে মিথ্যা মামলায় জেল হয় তার। গ্রামের সবাই ধরে নেয়, কদম আর বেঁচে নেই। মোড়লের বসানো মজলিশে নবিতুনের নতুন করে বিয়ে ঠিক হয়। আপসহীন লড়াকু নবিতুন ফন্দিবাজদের কাছে এবার যেন সত্যি সত্যিই হেরে যাবে। কিন্তু জীবন যেন কখনো কখনো ঠিক পথের শেষেও পথ খুলে দেয়। লেখক নবিতুনকে হারতে দেবেন না।

সবাইকে মিথ্যা প্রমাণ করে কদম ফিরে আসে। নবিতুনের মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে। কন্যা ফিরে পায় বাবাকে। এখানেই শেষ নয়। জীবনে যুদ্ধের পর যুদ্ধ এসে হাজির হয়। মোড়ল কদমের কান ভাঙাতে শুরু করে। নবিতুনের নামে ভুল বোঝায়। কিছুদিনের মধ্যে নবিতুনের গর্ভে সন্তান আসে। কদমেরও মনে হতে থাকে, এই সন্তান বুঝি তার নয়। নবিতুনের সামনে এবার অগ্নিপরীক্ষা। সন্দেহ আর বিশ্বাসহীনতা থেকে অশান্তি চরমে ওঠে। কদমের পদাঘাতে গর্ভের সন্তান মুকুলে বিনষ্ট হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ঘরে–বাইরে নারীর লড়াই যে কতটা কঠিন, এই কাহিনি সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে। উপকূলে ঘূর্ণিঝড় মানেই দৈত্যাকার জলোচ্ছ্বাসের সর্বগ্রাসী রূপ। হাঁটুজল থেকে কোমর হয়ে ক্রমেই মাথা ডুবে যেতে থাকে। ক্রমে সব ভেসে যায়। বর্তমান প্রযুক্তির সাহায্যে এ ধরনের দৃশ্য চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা খুবই সহজ। ১৯৭৮ সালে দাঁড়িয়ে পরিচালক কীভাবে যে এই দৃশ্যকে জীবন্ত করে তুলেছেন, তুলতে পেরেছেন, ভাবা যায় না। নির্দ্বিধায় বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই চলচ্চিত্র স্থান পাওয়ার যোগ্য।

ঝড়ের পর দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপে ভেসে ওঠা চরে চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। নবিতুন বেঁচে আছে। কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়েছে। কন্যা আর নেই। কদমের কাছে গিয়ে দেখে, তার প্রাণপ্রদীপ ধুকপুক করছে। মুখে একটু জল দরকার। চারদিকে নোনা জল, নবিতুনের দুহাতের কোশ ভরে তুলে আনা জলে, কদম উল্টে বমি করে ফেলে। নবিতুন এখন সবচেয়ে বড় বৈপ্লবিক কাজটি করে। নিজের স্তনের দুধ পান করিয়ে স্বামীর প্রাণ বাঁচায়। কবরীর অসামান্য অভিনয় বিশ্বসেরা শিল্পীদের পাশে নিয়ে এসেছে। আবারও বলি, পাখির মতো চোখ তুলে জগৎ দেখানো কবরী ছাড়া নবিতুন হয় না। আগুনের ফুলকি দিয়ে ফুল ফোটানো কবরী ছাড়া ‘সারেং বৌ’ হয় না। এই চলচ্চিত্রের শুরুতে পান্না কায়সারের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন পরিচালক। পান্না কায়সারের প্রেম ছাড়া শহীদুল্লা কায়সারের জীবনও অচল। জীবনের কত সময় লড়াই, আন্দোলন আর জেলে কেটেছে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে লেখককে হত্যা করে রাজাকাররা। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে দুই সন্তানকে মানুষ করেছেন পান্না কায়সার। দেশের জন্যও কাজ করেছেন। বাস্তবের এক নবিতুনের মধ্যে, উপন্যাসের কাহিনির এক নবিতুনের মধ্যে বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের অনেক নবিতুন তাই মিশে আছে।

‘সারেং বৌ’ চলচ্চিত্রে কদম চরিত্রে ফারুকসহ অন্য সব অভিনেতার অভিনয় উচ্চমাপের। আবদুল জব্বারের কণ্ঠে ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে, দে ছাড়িয়া’ আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই গান যেন চিরকালের অন্তরদহনের ভাষ্যপাঠ। সিনেমাটিতে সাবিনা ইয়াসমিন ও রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠের গানও বেশ ভালো। রুশ বিপ্লবের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে লেখা শহীদুল্লা কায়সারের গানটির শেষ চারটি লাইন ছিল, ‘আমরা যে পেয়েছি রক্তদ্বীপের নিশানা/আমরা মেনেছি সূর্যের ঠিকানা/আমরা চলি অবিরাম/অগ্নি আখরে লিখি মোদেরই নাম।’ ঝড়বিধ্বস্ত চরে সূর্যের ঠিকানা যদি কেউ নিয়ে আসে, এনেছে তো এই বিধ্বস্ত জীবনের হাল ধরে থাকা কান্ডারি সারেং বৌ। আমরা জীবনপোড়া মানুষেরা অনুপ্রেরণা নিয়ে পথ চলব অবিরাম। চলচ্চিত্রের শেষে বার্তা লেখা থাকে তাই, সামনে নতুন সময়।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত