লেখালেখি নিয়ে মাতামাতির মূল্য আছে

লেখালেখি নিয়ে মাতামাতির মূল্য আছে

যাঁরা লেখেন—গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, রম্যরচনা ইত্যাদি, তাঁরা প্রচারের জন্যই লেখেন। কবি আল মাহমুদের কবিতার লাইন আছে, ‘একটি সদ্য রচিত কবিতা পাঠ করে শোনানোর নির্লজ্জতা’। এ নির্লজ্জতা না থাকলে কেউ কবি বা লেখক হতেন না। নিজের বেদনার কথা, কামনার কথা বা দুনিয়াটা কেমন হওয়া উচিত, এ বিষয়ে নিজের মত লেখক লেখেন এবং প্রচার করতে দেন। তখন লেখার সঙ্গে নিজের নামটাও দেন।

আমরা যাঁরা সংবাদপত্রে কাজ করি, তাঁরা জানি, ‘আমার কবিতা কেন ওপরে নয়, আমার কবিতার ইলাস্ট্রেশন কেন রঙিন হলো না’, এ নিয়েও কবিরা সম্পাদকদের ঝাড়ি দেন। লেখকেরা যদি আত্মপ্রচারবিমুখই হবেন, তাহলে তো তাঁরা লিখতেনই না, বইও বের করতে দিতেন না। সব লেখকই চান, তাঁর বইটা যথাযথ পাঠকের হাতে যাক এবং ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রিসিয়েশন পাক। কাজেই লেখকেরা যদি বইমেলা উপলক্ষে নিজেদের বইয়ের প্রচার নিজেরা করেন, এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এটাকে বাঁকা চোখে দেখার কিছু নেই।

এখন একেকজনের প্রচারের ধরন একেক রকম। কেউ কেউ এই ব্র্যান্ডিং করতে চান যে আমি প্রচারবিমুখ। এটাও একটা প্রচারণা। কেউ কেউ বইমেলায় অটোগ্রাফ দেওয়ার ছবি প্রকাশ করে দেখাতে চান, তিনি একজন সেলিব্রিটি। প্রচারও করতে হবে, আবার স্মার্টও দেখাতে হবে—এ রকম একটা তারের ওপর দিয়ে হাঁটার ব্যাপার আছে।
বইয়ের প্রচার দেওয়া ভালো।
আমাদের প্রকাশকেরা এই দায়িত্ব পালন করেন কম। ফলে বেচারা লেখকদেরই কাজটা অনেক সময় করতে হয়।

তবে কত কপি বই বিক্রি হলো, তার চেয়েও লেখকের মনের মধ্যে এই প্রশ্ন বেশি ক্রিয়াশীল থাকা হয়তো ভালো যে আমি ভালো লিখলাম কি না! ভালো লেখা শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা পায়। যেমন শহীদুল জহির নিজের প্রচার করেননি। পাঠক ও সমালোচকেরা তাঁকে খুঁজে নিয়েছেন।

লেখালেখি ব্যক্তিগত কাজ। প্রকাশের পর থেকে কাজটা আর ব্যক্তিগত থাকে না। সামাজিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সেইখানে সবাই ভালো না–ও করতে পারেন।
ভালো যিনি লিখছেন, তাঁর একটা আত্মবিশ্বাস, কিছুটা গৌরববোধ থাকা উচিত যে আমি ভালো লিখছি। আমি বাজারের নই। আবার কিছুটা দ্বিধাও কাজ করে নিশ্চয়ই, কেমন যে লিখলাম। আদৌ হলো কি!
অতিরিক্ত ঢাকঢোল বাজিয়ে কিছু পাঠককে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা সম্ভব, কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা ধোপে টেকে না।

আরেকটা কথা। পশ্চিমে ফিকশনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, লিটেরারি ফিকশন আর পাল্প ফিকশন বা পপ ফিকশন। আপনি যদি থ্রিলার লেখেন, আপনি থ্রিলারই লিখছেন। তাতে অগৌরবের কিছু নেই, কাজটা অগুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেই। কিন্তু লিটেরারি ফিকশনের ভাগে আপনার লেখা পড়বে না।
নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলারের তালিকায় ওঠার জন্য লেখক নিজের বই নিজে কিনে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশেও দু–একজন এমন কাজ যদি করে থাকেন, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

আপনি কীভাবে নিজেকে ব্র্যান্ডিং করবেন, এটা আপনার রুচি, পড়াশোনা, অভিপ্রায়, সঙ্গ, সুযোগ ও নিয়তির ব্যাপার।
তবে লেখালেখি নিয়ে মাতামাতির মূল্য আছে। সব লেখকের জয় হোক। ভালো লেখকদের জয় আমাকে কামনা করতে হবে না, তাঁরা জয়ী হবেনই।