যারা চলে যায়, তারা অবশ্য বলে যায় যে আবার দেখা হবে। কিন্তু আর দেখা হয় না। আবার যখন দেখা হয়, তখন হয়তো আমরা ভিন্ন মানুষ।
লেখার ক্ষেত্রে বোধ হয় বন্ধুত্বটা ঠিক ধরা দেয় না। অকপট প্রেমিকের কথা বলা যায়, কিন্তু বন্ধুত্ব যেন ধোপে টেকে না। তাই তো মুখ ফুটে খালি হয়ে যাওয়া মনের কথা বলা হয় না। ভয় হয়, অগোচরে কেউ সস্তা একপক্ষীয় প্রেমের গল্প ভেবে ভুল করে! জীবনের এইটুকু সময়ে হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। পরিচিত মুখ, বন্ধুত্ব, প্রেম, সম্পর্ক। যারাই হারিয়ে গেল, তারা ঠিক কোন জায়গাটিতে বসে ছিল, জানা যায় না। তবু তাদের উপস্থিতিতে বুক ভরে উঠেছে, আবার চলে যাওয়ায় মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। কখনো বা সেই ভাঙা টুকরো এক করতে নিজের অজান্তে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছি। বিনিময়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। অগোচরে অশ্রুসিক্ত হয়েছি।
তবে ওদিকের খবর জানতে চাইনি কখনো। ভয় হয়, ওদিকের অন্তঃসারশূন্যতায় কষ্টের বাঁধটা ভেঙে যাওয়ার! লিখতে বসে হাজার হাজার শব্দ মুছে ফেলেছি। তারপরও কাঠামো দাঁড়ায় না। আগেই বলেছি, শঙ্কা জাগে, কেউ যদি আসল প্রেমটা ধরতে না পারে! গত দুই দিন ধরে হলের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপা রাস্তায় বন্ধুদের দল দেখে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকছি। মজার ব্যাপার হলো, শুধু মানুষ নয়; পাখি, কাক কিংবা কুকুরের দল দেখেও একই অনুভূতি হচ্ছে। তাকাতে পারছি না, বোঝাতে পারছি না, কী হচ্ছে ভেতরে।
মনে হচ্ছে, এই বন্ধুহীন পৃথিবীতে বন্ধুত্ব হারানোর ভয় আজ তুঙ্গে। বারবার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘আমাদের দেখা হবে তো, তাই না? কথা হবে তো!’ এই প্রশ্নে ওর কষ্ট বেড়েছে কি না জানি না। কিন্তু বুকটা ভেঙে যায় এই ভেবে যে আমরা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচেকানাচে হাঁটব না। অযথা কথায় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ব না। আমাদের আর দেখা হবে না। যারা চলে যায়, তারা অবশ্য বলে যায় যে আবার দেখা হবে। কিন্তু আর দেখা হয় না। আবার যখন দেখা হয়, তখন হয়তো আমরা ভিন্ন মানুষ। কেউ আর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ–তরুণী থাকব না। হয়ে উঠব দায়িত্বের ভাড়ে নুইয়ে পড়া ব্যস্ততম কর্মকর্তা এবং কঠিনতম পরিবারকর্তা। অযথা সময় নষ্ট করার সময় হয়ে উঠবে না, অনর্থক কথার অর্থ খুঁজব না। এত ভাবছি বলে ভাববেন না যেন এ ভাবনা আজকের; এটা অনেক দিনের।
গত পরশুর সকালটা এত সুন্দর কেন ছিল, জানি না। ১০০ মেট্রিক টন ওজনের ভারী বুক নিয়েও উপভোগ করার মতো সকাল। বাসস্টেশনে ছলছল চোখ নিয়ে ভাবছিলাম, কারও কারও চলে যাওয়াটা বোধ হয় কেবল বিষণ্নই নয়, বরং এই সকালের মতো সুন্দরও হতে পারে। ওই জায়গায় বসে অপেক্ষা করছিলাম আর নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। মনে পড়ছিল সেই সব দিনের কথা, যখন অচেনা নতুন শহরে অপরিচিত, নতুন মানুষের ভিড়ে অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধু পেলাম। হঠাৎ করেই এক অপরিচিত বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় সেই বন্ধুত্ব আমাকে অবাক করে দিল তার মমতায়। ওইদিনের ওইটুকু মমতা জ্বর–ব্যথা ভালো করে দিয়েছিল। এই ঘটনার আগে কি পরে, মনে পড়ে না, একবার জমজমের পানি খেতে খেতে বন্ধুত্বের স্থায়িত্বকরণের বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলাম। না না, প্রেমিক, স্বামী, সংসার কিচ্ছু না; চেয়েছিলাম বন্ধুত্ব। পেয়েছি, তবে পাওয়ার আনন্দে বিভোর থাকতে পারছি না। হারানোর ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠছি।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়