চিলেকোঠার ঘর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এক.
দোতলার ছাদে বসে আছে আহমদ। ছাদের একপাশে তার চিলেকোঠার ঘর। ঘরের ভেতর ছোট্ট একটা খাট। খাটের সঙ্গে লাগোয়া চেয়ার-টেবিল। ঘরে খুব বেশি আসবাবপত্র নেই। চারপাশে বই আর বই। বই রাখারও জায়গা নেই। বিছানার একপাশে বইয়ের স্তূপ। সে মাঝেমধ্যে মনে করে, বইয়ের নিচে মরে পড়ে থাকবে। ভোরসকালে আলেয়া সুলতানা বেড–টি দিতে এসে দেখবে, লোকটা মরে পড়ে আছে। আচ্ছা, আলেয়া তখন কী করবে? চায়ের কাপ হাত থেকে ফেলে চিৎকার করে মা-বাবাকে জানাবে নাকি শিয়রের পাশে মূর্তির মতো বসে থাকবে? নাহ, আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না।

আহমদ তাকিয়ে আছে তালগাছটির দিকে। গাছটার জন্য বাড়িটাকে খুব ভালো দেখায়। পুরো বাড়ির ছেলেমেয়েরা বিকেল হলেই খেলতে আসে। কানামাছি খেলে। কানামাছি খেলা ছাড়া এরা কোনো খেলা সম্ভবত জানে না।

আইরিন সবার সঙ্গে খেলছিল। আহমদ হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। সে এসে বলল, ‘আপনি আমাকে ডেকেছেন?’
‘হুম।’
‘কেন?’
‘কী নাম তোমার?’
‘আপনি আমাকে নাম জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকেছেন?’
‘মানুষ কি নাম জিজ্ঞেস করার জন্য কাউকে ডাকতে পারে না?’
‘না, পারে না।’
‘তুমি কিন্তু চমৎকার কথা বলো। মনে হচ্ছে তোমার মুখ দিয়ে খই ফুটছে। আচ্ছা, তুমি কি কখনো খইভাজা খেয়েছ?’
‘না, খাইনি। কখনো ইচ্ছেও করেনি। কেন ডেকেছেন দ্রুত বলেন। আমি চলে যাচ্ছি।’
‘তোমার নামটা সুন্দর করে বলে চলে যাও।’
‘আইরিন সুলতানা রহমান।’
‘তোমার বড় আপুর নাম কী?’
‘আলেয়া সুলতানা রহমান।’
‘বাহ, কী চমৎকার তোমাদের নাম!’
‘আপনি আর কখনো আমাকে ডাকবেন না। আপু যদি কখনো দেখে, তাহলে আমাকে বকা দেবে।’
‘আচ্ছা, তোমার আপু কি অনেক রাগী?’
‘জানি না। আমি যাই।’
‘এই পিচ্চি শোনো, ঘরের ভেতর থেকে চেয়ারটা এনে দাও।’
আইরিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, ‘আমি আপনার কেনা গোলাম নই, যখন ইচ্ছা তখন আদেশ করবেন। অসহ্য মানুষ।’

আহমদ ওর কথা শুনে হেসে দিল। আইরিনকে সে ডেকেছিল চেয়ার আনার জন্যই। এত কথা বলার পর আসল কথাই ভুলে গেছে দেখে তার খুব হাসি পাচ্ছে।

ছাদের কার্নিশে পা ঝুলিয়ে দূরের সূর্যটার দিকে তাকিয়ে রইল আহমদ। সূর্য ডুবে যাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। সে মাঝেমধ্যেই এখানে বসে সূর্য ওঠা আর ডোবা দেখে। সূর্য ওঠে খুব দ্রুত আর ডোবেও খুব দ্রুত। এই সুন্দর ব্যাপার কেউ খেয়াল করে দেখে না। এটা যে কী সুন্দর একটা দৃশ্য, এই দৃশ্যের দিকে তাকালে জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার গন্ধ পাওয়া যায়।
‘এই যে নিন, আপনার চেয়ার।’
আহমদ পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে তো বলিনি।’
‘আমাকে বলেননি?’
‘জি না।’
‘তাহলে কাকে বলেছেন?’
‘আপনার ছোট বোন আইরিন সুলতানা রহমানকে।’
‘ও তো আমাকে বলল, আপনি নাকি তাকে বলে দিয়েছেন আমি যেন আপনার ঘর থেকে চেয়ার এনে দিই।’
আহমদ জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, ‘ছি! ছি! কী বলেন! আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড় হবেন বোধ হয়।’
‘আমি আপনার বয়সে বড় হব? আপনার চোখ আছে না গেছে? ভালো করে দেখে বলেন।’
‘সরি।’
‘বড়ও হতে পারি। একটু সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।’

আহমদ একটু কেশে বলল, ‘দুঃখিত! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমায় ক্ষমা করবেন। আমি একটা সুন্দর দৃশ্য দেখছি। আপনার জন্য মিস হয়ে যাচ্ছে।’
আলেয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের দৃশ্য?’
‘সুন্দর দৃশ্য।’
‘কই, আমি তো দেখছি না!’
‘আপনি ভালো করে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই দেখতে পারবেন।’
আলেয়া বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল, ‘ও বুঝেছি, আপনি ওই ছাদের দৃশ্যের কথা বলছেন?’
‘আহা, কী যন্ত্রণায় পড়লাম। ছাদে সুন্দর দৃশ্য হতে যাবে কোন দুঃখে? আমি তো...’
আহমদের কথা শেষ হতে দিল না আলেয়া। বলল, ‘ওই যে তিনটা পাখি, আপনাকে আর আমাকে দেখছে। দেখেন, দেখেন! কী অসভ্য মেয়েছেলে, কীভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে!’
‘কী ঝগড়াটে মেয়ে আপনি! নিজে নিজে এত কিছু বানিয়ে ফেললেন! ওরা হয়তো অন্য কিছু দেখছে। তা ছাড়া আমি দেখছিলাম সূর্য ডোবার সুন্দর দৃশ্যটা। আর আপনি কত কিছু বলে ফেললেন। ওরা যদি শোনে যে আপনি তাদের নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছেন, তাহলে ওরা রাগ করবে।’
‘আপনি আছেন না? গিয়ে রাগ ভাঙাবেন!’

নিচ থেকে ছাদে এল রহিমের মা। এসে বলল, ‘আফামণি, ম্যাডাম আপনেরে ডাকে। এক্ষুণি নিচে নামতে কইছে।’
আলেয়া ছাদ থেকে কাপড় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে গেল।
রহিমের মা আহমদের কাছে এসে বলল, ‘ভাইজান, মাইয়্যাডা বেশি সুবিধার না। বেশি লাই দিয়েন না। বেশি লাই দিলে আপনার মাথা আউলায়ে দিব।’
‘অদ্ভুত তো! আমি তাকে লাই দেব কেন?’
‘কেন দিবেন, তা আমি কেমনে কমু, পিরিতটিরিত...’
‘তুমি কি ভাবছ, আমি ওনার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছি?’
‘সম্পর্কটম্পর্ক বুঝি না, আমরা বুঝি লতুপুতু। আমরা প্রেমট্রেমের ধার ধারি না। ছেলেমেয়ের বয়স হইছে, চিপায় গিয়া কথা কইছে; ব্যস, ডাইরেক্ট বিবাহ পড়ায়ে দিমু। এক ঢেলে দুই পাখি খাঁচায় বন্দী।’
‘রহিমের মা, তুমিও দেখি তোমার আফামণির চেয়ে কম খারাপ নও। হা হা!’
‘সতর্ক থাইকেন ভাইজান, বইন হিসেবে কইয়ে গেলাম।’

দুই.
‘মা, কী বলবে বলো?’
‘আমি তোরে কী বলব আবার?’
‘রহিমের মা যে বলল, তুমি নাকি আমায় ডেকেছ।’
‘আমি তোকে ডাকতে যাব কেন?’
‘তাহলে রহিমের মা মিথ্যা কথা বলে ছাদ থেকে এনেছে?’
‘আমি এত কথা তোর সঙ্গে বলতে পারব না। তুই তাকেই জিজ্ঞেস কর।’
‘আচ্ছা, এককাপ রং–চা পাঠাও। আমার মাথাব্যথা করছে।’

আলেয়া তার রুমে গেল। বিছানায় বসে কী যেন ভাবছে। এমন সময় রহিমের মা চা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘আফামণি, আসমু?’
‘এসো।’
‘এই লন, আপনের চা।’
‘ধন্যবাদ।’
‘চায়ের সঙ্গে বিস্কুটও আনমু?’
‘না, তুমি একটু বসো।’
‘আফামণি, রাগ কইরেন না। আমার আপনোগো মতো আজাইরা বইসে থাকার টাইম নাই। মেলা কাম আছে। কাম করতে হইব। আমি যাই।’
‘এই দাঁড়াও।’
‘জে, কন।’
‘তুমি আমাকে মিথ্যা বললে কেন?’
নিজের দুই গালে দুই চড় মেরে রহিমের মা বলল, ‘তওবা তওবা আফা, আমি সত্য ছাড়া কথাই কই না। এই সত্য বলার কারণে আমার তিন-চার জায়গা থিকা চাকরি ছাড়তে হইছে। জানি বিশ্বাস করবেন না, সত্য কথা কেউ বিশ্বাস করে না।’
‘তুমি কি জানো, তুমি যে বেশি কথা বলো?’
‘জে না।’
‘তুমি ছাদ থেকে আমাকে মিথ্যা বলে নিচে পাঠালে কেন?’

রহিমের মা খুব দ্রুত আলেয়ার কাছে এসে কানে কানে বলার প্রস্তুতি নিল। আলেয়া বলল, ‘কানে কানে বলাবলির কিছু নেই। তুমি ওখান থেকেই বলো।’
‘আফা গো, আপনের বয়স কম, দিলডা নরম। ভালো মানুষ চিনবেন না। দুচোক্ষে যারে দেখবেন, তারেই বিশ্বাস কইরেন না।’
‘তুমি বয়ান বন্ধ করে আসল কথা বলো।’
‘আফা, আফা গো, ছাদের লোকটার মতিগতি বেশি একটা সুবিধার না, খালি মেয়েছেলের লগে কেমনে কেমনে তাকায়। তুই পোলা মানুষ, তুই থাকবি বাইরে, কাজকর্ম করবি সারা দিন, রাইতে বাসায় ফিরা দিবি ঘুম। তা না, তুই থাকোস হইছে গিয়ে কোনাব্যাঙের মতো সারা দিন ঘরে। আর ফাঁক পাইলে...’
আলেয়া রহিমের মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি আর ওই ভদ্রলোককে নিয়ে বাজে কথা বলবে না। আরেকটা কথা বললে...’
‘মন্দ লোককে মন্দ কতা কইতাম না। এটা কেমন কতা আফা?’
‘তুমি এখন বের হও। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ইচ্ছা করছে না।’

রহিমের মা ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, ‘হাছা কতার ভাত নাই, আমি আইজই চাকরি ছাইড়ে দিমু। আমিও কম না, এক বাপের এক বেটি।’

তিন.
ঘুম থেকে উঠেই আজহার সাহেবের কাজ হচ্ছে পত্রিকা শোনা। কাজের একটা ছেলে আছে এই বাড়িতে। বয়স চৌদ্দতে পড়ল এবার। সে থাকত কাকরাইল মসজিদের উত্তর পাশে। রাস্তার ফুটপাতে। আজহার সাহেব জগিং করতে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ। তাকে বললেন, ‘চল ব্যাটা, কাজে লাগিয়ে দিই।’
‘চলেন স্যার।’
‘তোর কোনো ডিমান্ড নেই?’
‘ডিমান্ড কী স্যার?’
‘কোনো চাওয়াপাওয়া নেই?’
‘তিনবেলা ভাত আর দুপুরে একটা লম্বা ভাতঘুম। এ ছাড়া কিছু লাগত না আমার।’
‘বেশ, আমার সঙ্গে চল।’
‘আচ্ছা, তোর কি আবার চুরিটুরি করার বদভ্যাস আছে?’
‘বদভ্যাস নাই, তয় মাঝেমধ্যে পারলে কিছু দিয়েন। পকেটে ট্যাকা না থাকলে হাত ঠিক থাকে না। খালি লম্বা হয়ে মাইনসের পকেটে ঢুকতে চায়।’
আজহার সাহেব হা হা করে হাসতে লাগলেন। ‘বাহ, বেশ কথা জানিস তো তুই। আচ্ছা, তোকে আমার কাছেই রেখে দেব।’
‘স্যার, একখান কতা কই? আপনের কাছে থাকলে আমি আপনের পোষা কুত্তার মতো শ্রদ্ধা করুম আর ভালোবাসুম। কুনু দিন আপনের কাছ থিকা চইলা আসমু না।’

সত্যি সত্যি ছেলেটা কথা রেখেছে। সে কখনো কোনো কারণ ছাড়া কোথাও যায়নি। আর চুরি করা তো অনেক দূরের কথা।
আজহার সাহেব বলেন, ‘শান্ত, এই শান্ত।’
‘আইতেছি স্যার।’
‘আজকের পেপার নিয়ে আয়। পড়ে শোনা।’
শান্ত সব লেখার শিরোনাম বলে যাচ্ছে। আজহার সাহেবের কোনো শিরোনামই পছন্দ হচ্ছে না৷ বলল, ‘আজ থাক। আজ ভালো লাগছে না।’
‘স্যার, মাথা বানায়া দিমু?’
‘দে দেখি।’
রহিমের মা এসে দাঁড়াল।
আজহার সাহেব বললেন, ‘রহিমের মা, কিছু বলবে?’
‘না স্যার, কী আর বলমু। বড়লোকদের বড় বড় ব্যাপারস্যাপার।’
‘আহা, তুমি মানুষটা এমন কেন? খালি আঘাত দিয়ে কথা বলো!’
‘স্যার, গরিবের আবার আঘাত।’
‘কী হয়েছে, স্পষ্ট করে বলো।’
‘স্যার, উপরের ভাইজানটারে একটু টাইট দিয়েন। খালি আফামণিরে ডিস্টাপ করে।’
‘ওপরের ভাইজান কাউকে ডিস্টার্ব করে না, করে তোমার আপামণি। খামোখা বিরক্ত করে ভদ্রলোকটাকে। ভদ্রলোক ভালো একজন মানুষ।’
‘স্যার, আমি গেলাম। আমার কতার কোনো দুই পয়সার দাম নাই। এই বাড়িতেই থাকুম না।’

বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল রহিমের মা। আহমদ চেয়ার পেতে বসে আছে চিলেকোঠার ঘরের সামনে। ছাদের এককোণে কয়েকটি বিস্কুট, একটা চায়ের কাপ ও ছিঁড়ে ছিঁড়ে পাউরুটি রেখে দিয়েছে। এ সময় ছাদে অনেক ধরনের পাখি আসে, চা ও বিস্কুট খেতে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। দুইটা পাখি এসে খাচ্ছে। ঠোঁট কিঞ্চিৎ লাল। একটা আরেকটাকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে। এরা চলে যাওয়ার পর একঝাঁক পাখি উড়ে এল। সবাই খেয়ে যাচ্ছে। এরা যাওয়ার পর আরেক ল পাখি আসে;এভাবে চলতে থাকে। এরাই ভালো, কারও প্রতি কারোর সা-বিদ্বেষ নেই। যা করবে,সবাই মিলেই করবে।
রহিমের মা এসে পাখিদের তাড়িয়ে দিল। ‘পাখিরা সব খাইতেছে আর আপনে চাইয়্যা চাইয়্যা দেখতেছেন?’
আহমদ বলল, ‘তুমি ওদের তাড়িয়ে দিয়ো না। আমি প্রতিদিন ওদের নাশতার দাওয়াত দিই। ওরা সুন্দর করে খেয়ে চলে যায়।’
‘আল্লাহ গো, কোন বাড়িতে থাহি আমি! এরা সবাই দেহি পাগল। মাইনসে ভাত খাইতে পারে না, আর কোন দেশের কোন পাখি আইসে খাইয়ে চইলে যায়, তার কোনো নামঠিকানা নাই।’
রহিমের মা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। আহমদের ডাকে আবার ফিরে এল।
‘ভাইজান, কিছু কইবেন? আমি কিন্তু আপনের কাজ করতে পারুম না। আমারে একা-একা ঘরেও আসতে বইলেন না। তা হইলে কিন্তু খবর কইরে দিমু। আমি এক কতার মানুষ!’

আহমদ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। ‘শোনো, তুমি দুই লাইন না, দশ লাইন বেশি বোঝ আর সারা দিন অন্যদের নিয়ে পড়ে থাকো। এসব ঠিক না। এটা রাখো। তোমার ছেলের জন্য সুন্দর একটা জামা এনেছিলাম গতকাল। দিতে ভুলে গেছি। এই নাও।’
রহিমের মায়ের চোখ ভিজে উঠল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ভাইজান, আপনে মানুষ না, আপনে একটা ইনসান!’
আহমদ অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, ‘আরে মানুষ আর ইনসান দুই শব্দের অর্থ একই।’
‘ভাইজান, আমারে মাফ করে দিয়েন। আপনের নামে একটু–আধটু মজা করছি। গরিবরা কি একটু মজা করতে পারে না, কন? ওদেরও তো শখ আছে। নাকি ওদের শখ নাই?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই আছে।’
‘ভাইজান, তয় একটা কথা। এই বাড়ির মালিক বেশি একটা সুবিধার না।’
‘আবার!’
রহিমের মা হাসতে হাসতে চলে গেল।

চার.
আলেয়া সুলতানা তার মাকে বলল, ‘হয় ভদ্রলোককে বাড়ি থেকে বের করে দাও, না হয়...’
‘না হয় কী?’
‘আমাকে ওনার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও।’
রহিমের মা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল। ঝাড়ু মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, ‘তওবা তওবা। আফা গো, এসব কতা মেয়েছেলের মুখে আনা পাপ। মহাপাপ।’
আলেয়ার মা বলল, ‘রহিমের মা, তুমি একটু থালাবাটি ধুতে যাও। এখন ঝাড়ু দেওয়া লাগবে না।’
‘জে আম্মা, আমি যাইতেছি।’
যাওয়ার কথা বলেও রহিমের মা দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে রইল।
‘রহিমের মা, ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
‘আম্মা, শাড়িটা ঠিক করতেছি। খালি প্যাঁচ লাগে।’
আলেয়ার বাবাকে আলেয়ার মা বলল, ‘আচ্ছা, আমাদের চিলেকোঠার ঘরে যে ছেলেটা থাকে, সে কেমন?’
‘কেমন বলতে?’
‘না মানে...’
‘নির্দ্বিধায় বলো।’
‘আমি চাচ্ছিলাম, যদি ভালো হতো, তাহলে এই বাড়িতেই ওকে রেখে দিতাম আমরা। ছেলেটা অনেক নম্র–ভদ্র প্রকৃতির। তুমি যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হলে, ও সবকিছু কীভাবে যেন জাদুর মতো ব্যবস্থা করে দিল। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ডাক্তার বলল, “আপনার স্বামী মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। দোয়া করতে থাকেন। যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে যান। অবশ্য কেউ কেউ ফেরে এই যাত্রায়।” আমি দেখেছি, সেদিন তোমার প্রতি ছেলেটার কী মায়ামোহ। তুমি কী বলো?’
‘আলেয়ার সঙ্গে কথা বলো, ও কী বলে, সেটাই আসল।’
‘আফামণি, স্যার আর ম্যাডাম আপনেরে ডাকে। একটা সুসংবাদ আছে।’
‘কী সংবাদ?’
‘সুসংবাদ!’
মা বলল, ‘ছেলেটা কেমন? তোর কি পছন্দ হয়েছে তাকে?’

আলেয়া মাথা নত করে পা দিয়ে মেঝে খুঁটছে। হঠাৎ একটা হাসি দিয়ে ওর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
হঠাৎ দরজা বন্ধ করতে দেখে রহিমের মা সবাইকে বলল, ‘স্যার-ম্যাডাম, বিষয়টা আমার কাছে বেশি একটা সুবিধার মনে হইতেছে না!’
তার কথা শুনে একযোগে সবাই হা হা করে ঘরফাটিয়ে হাসতে লাগল।

শিক্ষার্থী, জামিয়াতুল উস্তায অ্যারাবিক ইউনিভার্সিটি, মোহাম্মদপুর, ঢাকা