সংবাদ উপস্থাপনা এখন মিডিয়া জগতে বেশ জনপ্রিয়। মাত্র কয়েক বছর আগেও এই দৃশ্যটি ছিল না। বিশেষ করে একুশে টেলিভিশনে প্রাণবন্ত সংবাদ উপস্থাপনা শুরু হওয়ার পর এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ব্যাপক হারে। আর ক্রমেই বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে একে নিয়ে মাতামাতিও যেন বেশ বেড়ে যায়। এখন কেউ গান বা নাচ বা শিল্পের অন্য কোথাও কিছু করতে না পারলে অন্তত সংবাদ উপস্থাপনাটা করা যায় বলে ধরেই নেন। সেই লক্ষ্যে আনাচকানাচে গজিয়ে ওঠা সংবাদ উপস্থাপনা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে দৌড়ানো শুরু হয় এবং সেখানে মাত্র কদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি সনদ জোগাড় করেই ছোটা শুরু হয় টেলিভিশনগুলোর দ্বারে দ্বারে। যখন অধিকাংশই একে একে ব্যর্থ হন অডিশনে, তখন দোষ দেন ‘মামা’দের। অর্থাৎ প্রভাবশালী কারও হাত না থাকায় নাকি তাঁরা টেকেন না। কিন্তু তাঁদের এই বোধটুকু নেই, যে কাজটির জন্য এলেন, সে কাজটুকু তাঁরা কতটুকু শিখে এসেছেন।
তাহলে কী করতে হবে?
‘আবৃত্তি’ শিল্প হিসেবে এখন নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে। এই আবৃত্তি শব্দটির আক্ষরিক অর্থ অনেকে ভাবেন শুধু কবিতার আবৃত্তি। অথচ আবৃত্তির সংজ্ঞা জানা নেই কারও। এককথায় বলতে গেলে, কোনো একটি বিষয় সেটি কবিতা, প্রবন্ধ, শ্রুতি নাটক কিংবা সংবাদ, যা-ই হোক না কেন, সেটিকে শুদ্ধ উচ্চারণের মাধ্যমে তার অন্তর্নিহিত ভাব-রস-লয় ঠিক রেখে বিষয়টি নির্মাণের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে শ্রুতিমধুর করে উপস্থাপন করাই আবৃত্তি। তাহলে একজন আবৃত্তিশিল্পী দক্ষতার সঙ্গে সংবাদ উপস্থাপন করতে পারবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই উপজীব্যটিকে ধারণ না করে কেবল চিলের পেছনে দৌড়ানোটা অনুচিত।
শেখার বিষয়
তাহলে শিখতে হবে আবৃত্তি। আর এই আবৃত্তি শিখতে পারলেই করা যাবে উপস্থাপনা। আবৃত্তি শিখতে গেলে প্রথমেই শিখতে হবে উচ্চারণ। প্রশ্ন উঠতে পারে উচ্চারণ আবার শেখার কী আছে? এ রকম প্রশ্ন যদি কারও মধ্যে থাকে, তাহলে বলতে হবে অবশ্যই তিনি উচ্চারণে যথেষ্ট পারঙ্গম। আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণও উচ্চারণ, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল কি আঞ্চলিক ভাষায় খবর প্রচার করে? সেটি আগে জানতে হবে। যদি না করে, তাহলে জানতে হবে শুদ্ধ উচ্চারণ অর্থাৎ প্রমিত বাংলা উচ্চারণ। আর সেটি জানতে বা জিবে আটকে যাওয়া ভুল উচ্চারণ শুধরে শুদ্ধ করতে সময় নিতে হবে বেশ। কয়েক দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ভেবে নেওয়া ‘আমি সব পারি’ ধ্বংস নিয়ে আসতে পারে।
ধরা যাক, আপনি ভালো বাংলায় কথা বলতে জানেন। তাহলে জানতে হবে, যে বিষয়টি আপনি বলতে যাচ্ছেন অর্থাৎ যে সংবাদটি আপনি উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন, তার ভাব-রস-লয় বা ছন্দ জানেন কি না। কারণ, অন্তর্নিহিত ভাবটি যদি বুঝতে না পারেন, তাহলে সেটি উপস্থাপন করলে দর্শক তো বুঝবেন না। দর্শককে বোঝাতে হলে আগে অবশ্যই আপনাকে বুঝতে হবে। আপনি বুঝলে তারপর তো অন্যকে বোঝাবেন। এবার আসা যাক নির্মাণে। ভবন নির্মাণ বা ঘর সাজাতে হলে আপনাকে আগে দেখতে হবে কোথায় কোন জিনিসটা রাখলে ঘরটি সুন্দর দেখাবে। অথবা ভবন নির্মাণ করতে গেলে তার সব দিক সাজিয়ে তারপর তো কাজ শুরু করতে হবে। সে রকমই যে সংবাদটি আপনি উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন, সেটিকে বিভিন্নভাবে তৈরি বা নির্মাণ করে তারপর তো উপস্থাপনায় যেতে হবে। কারণ, ছোট একটা লিংক বা ভূমিকার মধ্যে পরবর্তী খবরের পুরো নির্যাসটুকু থাকে। সেই কয়েক লাইনের মধ্যে বেশ কিছু তথ্য থাকে, যাকে বিভিন্নভাবে বা দর্শকদের বুঝিয়ে বলতে হয়। সেই বোঝানোর আগে নিজে ভালোমতো আয়ত্ত করাটাই হলো নির্মাণ।
উচ্চারণ, ভাব, রস, লয়, ছন্দ, নির্মাণ—এসব ঠিক করে সবশেষ পর্যায় হলো উপস্থাপন। আর এই উপস্থাপনটাই হবে ক্যামেরার সামনে। সেটারও প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে। অর্থাৎ কোন পোশাকে কতটুকু মেকওভার দিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে তারপর আসতে হবে ক্যামেরার সামনে। আপনাকে দেখতে উপস্থাপনযোগ্য বা প্রেজেন্টেবল হলেই তো আপনি কী বলছেন, তা শুনবেন বা দেখবেন দর্শক। তারপর সুন্দর করে বিষয়বস্তু বলে যান। আপনাকে ঠেকাবে কে?
ওপরে চারটি ভাগে যা বলা হলো, তা বলা চলে পাখির চোখে দেখা অর্থাৎ বার্ডস আই ভিউ। পড়তে অনেক কম সময় লাগবে কিন্তু এই গোটা বিষয়গুলোকে আয়ত্ত করতে কিন্তু যথেষ্ট সময় দিতে হবে।
কেন উচ্চারণ?
শিল্প যদি শিল্পের মতো না হয়, তাহলে সেই শিল্প তো মানুষ দেখবেও না, শুনবেও না। তাই নিজেকে শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সময় দিতে হবে যথেষ্ট। শুদ্ধ উচ্চারণ জিবে সহজভাবে উচ্চারিত হতে হলে অনেক কষ্ট করা প্রয়োজন। আপনি যদি কোনো আঞ্চলিক ভাষায় অত্যন্ত সহজ হয়ে থাকেন, ভাবুন, সেই ভাষাটি আপনি বংশপরম্পরায় বছরের পর বছর বলতে বলতে তা আয়ত্ত করেছেন। আপনার সেই আঞ্চলিক উচ্চারণ অন্য কোনো অঞ্চলের মানুষ যখন বলার চেষ্টা করেন, তখন আপনিই ভুল ধরবেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় নিয়ে ওই তিনিই যদি সেই ভাষাটি সহজভাবে বলেন, তা আপনার কাছেও ধরা পড়বে না। শুদ্ধ বাংলাটাও এই রকমই। দেখবেন একজন দর্শক, যিনি হয়তো শুদ্ধ বলতে পারেন না, কিন্তু উচ্চারণ বেমানান ঠেকবে। সেই দর্শকটি কখনোই ভুল উচ্চারণে করা উপস্থাপন গ্রহণ করবেন না। তাই শুদ্ধ উচ্চারণটা জানা থাকা প্রাথমিক যোগ্যতা, যা ছাড়া চলবেই না। মানে কোনো চাকরির জন্য যখন নির্দিষ্ট করে বলা হয় শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক, তবে স্নাতকের নিচে হলে আপনি অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তেমনি সংবাদ উপস্থাপনার জন্য উচ্চারণ বাধ্যতামূলক যোগ্যতা।
উপস্থাপনা
এবার আসি সংবাদ উপস্থাপন নিয়ে। আমরা কিন্তু এখন সংবাদ পাঠ করি না, উপস্থাপন করি। তাহলে নির্বাচিত বিষয়টি কেবল গড়গড়িয়ে পাঠ করলেই চলবে না। তাকে দর্শকগ্রাহ্য করে উপস্থাপন করতে হবে। তার মানে বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিতে পৌঁছাতে হবে। আর সেখানে পৌঁছাতে হলে হতে হবে পুরোদস্তুর সংবাদপাগল মানুষ। সংবাদ বা পারিপার্শ্বিক বিষয়বস্তু আর ভৌগোলিক জ্ঞান যদি স্পষ্ট না থাকে, তবে তার অন্তর্নিহিতে পৌঁছানো কঠিন হয়। তাই ইদানীং সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলো ফুলটাইম সাংবাদিকদের দিয়েই সংবাদ উপস্থাপনার চেষ্টা করছে। তাহলে ভুলের পরিমাণ অনেক কমে যায়। কারণ, ওই উপস্থাপক সারাক্ষণই সংবাদের মধ্যে থাকেন। কিন্তু তাই বলে কি অন্য পেশার মানুষ সংবাদ উপস্থাপক হতে পারেন না? পারবেন না কেন, চ্যানেলগুলো দেখলেই বুঝবেন—চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, শিক্ষক বিভিন্ন পেশার মানুষ সংবাদ উপস্থাপন করছেন এবং ভালো করছেন। তাহলে কী করে করছেন? করছেন এ কারণে যে তাঁরা তাঁদের পেশায় থেকেও দেশ-জাতি-বহির্বিশ্ব সম্পর্কে আগ্রহী, জানার চেষ্টা করেন প্রতিনিয়ত আর এখন হাতের মুঠোয় ইন্টারনেট-সেবার কারণে পৃথিবীর কোনো কিছুই অজানা থাকা সম্ভব নয়। তবে তার জন্য জানার আগ্রহ থাকতে হবে।
প্রশিক্ষণ
প্রশিক্ষণ নেওয়া যেতে পারে। কারণ, এখনো অনেকের কাছেই রীতিনীতি অজানা। তাই কোনো প্রশিক্ষণই ফেলনা নয়। আপনি যে বিষয় সম্পর্কে খুব স্কলার, সেই বিষয়ের ওপর একটা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেখুন না, কোনো না কোনো নতুন তথ্য আপনি পেয়ে যাবেনই। তাই প্রশিক্ষণ নেওয়া যেতে পারে, যে যেভাবে সুযোগ পান।
অডিশন-প্রক্রিয়া
টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যে যার নিয়ম অনুযায়ী অডিশন নিয়ে থাকে। তবে স্বতঃসিদ্ধ প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রথমে প্রাথমিক অডিশন নেওয়া হয়। যেখানে একটি সংবাদ স্ক্রিপ্ট পড়তে দেওয়া হয়। সেটি ভালো করে উপস্থাপন করতে পারলে প্রাথমিকভাবে ভালো ফল করা সম্ভব। প্রাথমিক অডিশনে সফল হলে দ্বিতীয় অডিশনের জন্য আহ্বান করা হবে। সেখানে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করার পাশাপাশি আবারও নিউজ স্ক্রিপ্ট পড়তে দেওয়া হবে। সেখানে ভালো করতে পারলে ক্যামেরা বা স্ক্রিন টেস্টে ডাকা হবে। সেখানে যাঁরা ভালো করবেন, তাঁদের পরবর্তী সময়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করে অন-এয়ারের জন্য নির্বাচিত করা হয়। অডিশনের জন্য আপনি আপনার বায়োডাটা টিভি চ্যানেলগুলোর অভ্যর্থনা ডেস্কে জমা দিতে পারেন।
পাদটীকা
যে কাজই করবেন না কেন, দক্ষতা ও অদক্ষতার একটা ফারাক থাকবেই। তাই বলে আপনি আজ সংবাদ উপস্থাপনায় এসেই দক্ষ হয়ে যাবেন, তা কিন্তু নয়। নিজের সম্পর্কে জানা অর্থাৎ আপনি যা করতে যাচ্ছেন, সেটি আপনি পারবেন কি না, তা জানতে হবে আগে। তাই নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নিজে প্রস্তুত হোন, সময় দিন কাজটিতে, দেখবেন কঠিন কিছুই নয়। তবে জানুন, চিনুন, ভাবুন ও প্রস্তুত হোন। সংবাদ উপস্থাপনা এখন শিল্পের বড় একটি বিষয়। বেসুরো গলায় গান গাইলে যেমন কেউ শুনবে না, তেমনি না শিখলে উপস্থাপনা হবে না। তাই শেখার কোনো শেষ নেই, শেখার চেষ্টা করতে হবে।
লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।