আজ ২২ শ্রাবণ। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির নিনাদ। সেতারবাদক নিমগ্নচিত্তে সুর তুলছেন,
‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী,
অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি...।’
শিল্পসাহিত্যের প্রতিটি বিভাগ—কবিতা, ছোটগল্প, গান, উপন্যাস, ব্যাকরণ—রবীন্দ্রনাথের স্পর্শে সমৃদ্ধ। একজন মানুষ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অক্ষরবিন্যাসে বেঁধে রেখে গেছেন। মৈত্রেয়ী দেবী ‘ন হন্যতে’ বইয়ে লিখেছেন, ‘তখন একটা কথা শুনতাম “এলিট” ... ... আরও একটা কথা শুনতাম “ক্রিম অফ ক্যালকাটা”। আর এই উচ্চ সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।…এঁর কাছ থেকে আমি কত কি পাই, এখানে একবার এলে এঁর অস্তিত্বের আস্বাদই কি মধুর—কিন্তু আমার তো ওঁকে দেবার কিছু নেই।’
পৃথিবীর মতো বিশাল সৃষ্টির ক্যানভাসের আড়ালে একজন উত্তম সংগঠক ও উদ্যোক্তা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে ধরাবাঁধা হৃদয়হীন শিক্ষাব্যবস্থা বরাবরই তাঁর অপছন্দ ছিল। তাই স্কুলের অসম্পূর্ণ শিক্ষার কথা ভেবেই বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথসহ পাঁচজন ছাত্রকে নিয়ে ১৯০১ সালে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।
ধরণিকে বাধিত করতে কেউ কেউ আসেন। আলোর পথ দেখান, প্রেরণা দেন এগিয়ে যাওয়ার। জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথ কাগজে-কলমে সুনিপুণ হাতে কাজটি করেছেন। সূর্যের মতো অন্ধকারের ভেতরও পৌঁছে দিয়েছেন আলোর রশ্মি।
পৃথিবীর মতো বিশাল সৃষ্টির ক্যানভাসের আড়ালে একজন উত্তম সংগঠক ও উদ্যোক্তা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে ধরাবাঁধা হৃদয়হীন শিক্ষাব্যবস্থা বরাবরই তাঁর অপছন্দ ছিল। তাই স্কুলের অসম্পূর্ণ শিক্ষার কথা ভেবেই বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথসহ পাঁচজন ছাত্রকে নিয়ে ১৯০১ সালে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন, ‘অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমার মনে এই কথাটি জেগে উঠেছিল, ছেলেদের মানুষ করে তোলবার জন্যে যে-একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম স্কুল, সেটার ভেতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না। এই শিক্ষার জন্যে আশ্রমের দরকার; যেখানে আছে সমগ্রজীবনের সজীব ভূমিকা।’
ব্রহ্মবিদ্যালয়ের আদর্শের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বন্ধু বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসুকে লেখা কবির এক চিঠিতে। কবি লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীনকালের গুরুগৃহবাসের সমস্ত নিয়ম। বিলাসিতার নাম-গন্ধ থাকিবে না- ধনী, দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হতে হইবে।’
ক্ষেত্রবিশেষে অর্থ-অনর্থ ঘটালেও প্রকৃত সত্য এই যে প্রতিটি ভালো কাজ ও উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। অর্থ ছাড়া পেট ও সমাজের উন্নয়ন হয় না। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের স্বপ্নেও অর্থ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু স্বপ্নচারী রবীন্দ্রনাথের পথ আটকায়, এ সাধ্য কার? মা মৃণালিনী দেবী প্রসঙ্গে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘মা পেয়েছিলেন প্রচুর, বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরোনো আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ যোগাতে সব অন্তর্ধান হলো। বাবার নিজের যা-কিছু মূল্যবান সম্পত্তি, তা আগেই তিনি বেচে দিয়েছিলেন।’
সৃষ্টিশীল হৃদয়ে অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত হয়। আর মানুষটি যখন রবীন্দ্রনাথ, তখন এ দৃষ্টি সমুদ্রের অগণিত জলরাশির মতোই প্রগাঢ়। ব্রহ্ম বিদ্যালয় নিয়ে কবির স্বপ্ন যে একদিন ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠবে, সূচনালগ্ন থেকেই কবি অনুভব করেছিলেন। অনেক বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে এগোতে এগোতে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। গুটি কয়েক ছাত্র নিয়ে শুরু করা ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের সঙ্গে বিশ্বকে যোগ করলেন রবীন্দ্রনাথ। শুরু হলো বিশ্বভারতীর অগ্রযাত্রা।
বিশ্বভারতীর আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবি বাঙালিকে উদ্যাপন করতে শেখালেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে শুরু করলেন পৌষ মেলা, দোলের মতো ঋতু উৎসব। সোনার চেয়েও খাঁটি বাংলার মাটিতে কৃষিভিত্তিক অগ্রযাত্রার প্রসারে কৃষির আধুনিকায়নের ওপর জোর দিলেন। আধুনিক কৃষি উদ্ভিদবিজ্ঞান ও গোপালন বিষয়ের ওপর দুই পুত্রের বিদেশে নেওয়া পাঠকে কাজে লাগাতে তাঁদের উৎসাহ দিলেন। সমবায়ভিত্তিক যন্ত্রচালিত কৃষিখামার আন্দোলনের সূচনা করলেন। গ্রামবাসীর দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন দূর করার লক্ষ্যে সুরুল গ্রামে প্রতিষ্ঠা করলেন পল্লী উন্নয়ন বিভাগ। পরবর্তীকালে পল্লী উন্নয়ন বিভাগকে ‘শ্রী নিকেতন’ নামকরণ করা হয়।
সাহিত্য-সংস্কৃতি জাতিকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করে, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। এর কল্যাণ সাধনে উদ্যোগ প্রয়োজন, এই বোধ থেকেই বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচারের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচারের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতি ছিলেন। এরপর ১৯২৩ সালে ভারতের বেনারসে প্রথম নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পুরো জীবনে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সংস্কৃতির জয়গান গেয়েছেন। তাঁর প্রতিটি রচনা জীবনের কথা বলে। প্রেরণা দেয় টিকে থাকার, লড়াই করার। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার সুর জানিয়ে দেয়, ভবিষ্যৎ বিচিত্র ও বিপুল সম্ভাবনাময়। জীবনে সম্মানই একমাত্র সম্পদ। এই মূল্যবান বস্তুটি সহজে অর্জন করা যায় না। তাঁর গানে আছে, ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান...।’ সম্মান দিলেই কেবল সম্মান মেলে। পৃথিবীর অনিন্দ্য সুন্দর আয়োজনের প্রতিটি দিন নতুন আহ্বানের, আনন্দের। কেবল অপ্রাপ্তি আর্তনাদে মুখ কালো করে থাকার নয়। কী পাইনি, তার হিসাব করার মধ্যে কেবলই আর্তনাদ। প্রাপ্তির স্মৃতিচারণায় জীবন আনন্দময় হয়ে ওঠে। তাই তো সুরে সুরে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি...।’
কেশবপুর, যশোর