ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন শশীলজ

প্রবেশতোরণ ধরে প্রাসাদের দিকে যেতে চোখে পড়বে সবুজ ঘাসের বাগান, যেখানে অলংকৃত মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি ঝরনায় রয়েছে স্নানরতা একটি সুন্দর ভাস্কর্য
ফাইল ছবি

মুক্তাগাছার জমিদার বংশের উত্তরসূরি নিঃসন্তান মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী তাঁর দত্তক পুত্র শশীকান্তের নামানুসারে ময়মনসিংহ শহরে একটি বিলাসবহুল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। এটি প্যারিস ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত নানা ধরনের সৌখিন জিনিসপত্র দিয়ে সজ্জিত ছিল। ১৮৯৭ সালের জুনে প্রবল ভূমিকম্পে বাড়িটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। পরে ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে মহারাজ শশীকান্ত পুনরায় একতলা বিশিষ্ট স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। আজও সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়িটি, যার সম্মুখে রয়েছে সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন গ্রিক দেবী ভেনাসের প্রতিমূর্তি।

ময়মনসিংহের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন শশীলজের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে নানা গল্প ও ইতিহাস। শশীলজের সামনের দিকে রয়েছে মনোমুগ্ধকর ফুলের বাগান, যার মাঝখানে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা এবং এর মাঝখানে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্নানরত মূর্তি। প্রাসাদে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ, লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত মূল ভবন। বড় ভবনের পাশাপাশি রয়েছে ছোট ছোট কিছু কামরা, এগুলোতে দাস–দাসীরা থাকত। পেছনের দিকে রয়েছে একটি পুকুর, এর সামনে স্বচ্ছ সাদা একটি দ্বিতল ভবন। এটি রানির স্নানঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, স্নানঘরের ভেতরে একটি সুড়ঙ্গ ছিল। এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে মুক্তাগাছার রাজবাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বাড়িটির আশপাশে রয়েছে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য ও প্রাচীন গাছ। পুকুরের পশ্চিম পাশে এখনো দাঁড়িয়ে সবচেয়ে প্রাচীনতম গাছ নাগলিঙ্গম, যার ফল সেই সময় হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

প্রাসাদের পেছনের অংশে পুকুরধারে ঘাটের ওপর রানির জন্য দ্বিতল স্নানঘর
ফাইল ছবি

জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর জমিদারদের সব ভবন ও সম্পত্তি সরকারের খাস জমি ও ভবন হিসেবে ঘোষিত হয়। অনন্য স্থাপত্য গঠনশৈলীর কারণে ১৯৮৯ সালে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে মন্ত্রণালয় প্রাসাদটিকে পুরাকীর্তি পর্যটন স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। অপরূপ ও অনিন্দ্যসুন্দর প্রাসাদটি দেখতে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভিড় করেন। এর আগে এটি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং মহাবিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ২০১৯ সালে রাজবাড়িটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় এবং ভবনের কয়েকটি কক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু জিনিস সংগ্রহ করে জাদুঘর তৈরি করা হয়।
রাজমহলের মোট ১৮টি কক্ষের মধ্যে ৩টি কক্ষে রাজবাড়ির পুরাকীর্তি, রাজার ব্যবহার্য জিনিস, আসবাবপত্র সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। দেখতে পাওয়া যাবে হাতির দাঁতের তৈরি সোফা, মার্বেল পাথরের টেবিল, গন্ডারের চামড়া থেকে শুরু করে মহিষের শিং, হরিণের শিং, জমিদারদের ব্যবহার্য পালঙ্ক, শ্বেতপাথরের মূর্তি, হাতির মাথার কঙ্কাল, হাতির চোয়ালের কঙ্কাল, ছোট–বড় নানা ধরনের অস্ত্র, তলোয়ার, চাকু, দাসহ আরও ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি।

প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাড়া জাগানো নাটক ‘অয়োময়’-এর শুটিং এ বাড়িতেই হয়েছিল। ২০১২ সালের ২৯ জুন হানিফ সংকেতের উপস্থাপনায় জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’-এর একটি এপিসোডও শশীলজে অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া আরও জনপ্রিয় অনেক নাটকের শুটিং করা হয়েছে এ রাজবাড়িতে।

ভ্রমণপিয়াসী মানুষের জন্য বর্তমানে সপ্তাহে ছয় দিন শশীলজ উন্মুক্ত থাকে। এর মধ্যে মঙ্গলবার-শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং সোমবার বেলা ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ।

মূল ফটকের দুই পাশে রয়েছে চোখ আটকে যাওয়ার মতো কারুকার্যখচিত স্থাপনা, যা রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে
ফাইল ছবি

ময়মনসিংহ শহরের ভেতরের কেউ শশীলজ পরিদর্শন করতে চাইলে যেকোনো স্থান থেকে রিকশাযোগে চলে আসতে পারেন। দূরত্বভেদে রিকশা ভাড়া কমবেশি হবে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে রিকশা ভাড়া সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ টাকা। আর মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ড অথবা ব্রিজ বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ভবনের ফটক থেকে টিকিট সংগ্রহ করে তারপর প্রবেশ করতে হয়। টিকিটের মূল্য ১৫ টাকা। ময়মনসিংহ জিরো পয়েন্ট মোড় থেকে পশ্চিম দিকে গঙ্গাদাস গুহ রোডে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার সামনে গেলে হাতের বাঁ পাশেই শশীলজ; অথবা নতুন বাজার ট্রাফিক মোড় থেকে উত্তর দিকের রাস্তা বরাবর ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার এগিয়ে গেলে হাতের ডান পাশে এর অবস্থান।

সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা