রবীন্দ্রসংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র পাপিয়া সারোয়ার সম্পর্কে ১০ তথ্য

বই পড়তে ভালোবাসতেন পাপিয়া সারোয়ারছবি: কবির হোসেন

একুশে পদকপ্রাপ্ত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ শেষে বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সকাল ৮টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি সংগীতশিল্পী এবং রবীন্দ্রসংগীতের বিশিষ্ট পরিবেশক। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে পাপিয়া সারোয়ার এক অনন্য নাম। রবীন্দ্রসংগীত তাঁর অসাধারণ অবদান। শিল্পীসত্তার গুণে তিনি বাংলাদেশের সংস্কৃতির অঙ্গনে একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।

চলুন একনজরে জেনে নেওয়া যাক এই কিংবদন্তি শিল্পী সম্পর্কে ১০টি তথ্য

১. জন্ম ও শৈশব: পাপিয়া সারোয়ার ১৯৫২ সালের ২১ নভেম্বর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখা যায়। ১৯৬৬ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ছায়ানটে ভর্তি হন।
২. সংগীত শিক্ষা: ছায়ানট এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সংগীতের ওপর শিক্ষা অর্জন করেছেন। ছায়ানটে ওয়াহিদুল হক, সন্‌জীদা খাতুন ও জাহেদুর রহিমের কাছে এবং পরবর্তী সময়ে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে সংগীত দীক্ষা গ্রহণ করেন পাপিয়া সারোয়ার। ১৯৭৩ সালে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসংগীত অধ্যয়ন করার জন্য ভারত সরকার থেকে বৃত্তি লাভ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই প্রথম ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেখানে স্নাতক করার সুযোগ পান। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলিমা সেনের অধীনে রবীন্দ্রসংগীত এবং ধ্রুবতারা যোশীর অধীনে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন। বিখ্যাত ওস্তাদদের কাছ থেকে তালিম গ্রহণের মধ্য দিয়ে সংগীতের বিভিন্ন ধারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এই গুণী।

৩. দাম্পত্যজীবন: ১৯৭৮ সালে সারোয়ার আলমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন পাপিয়া। দাম্পত্যজীবনে তাঁদের দুই মেয়ে। জারা সারোয়ার; কলেজ অব নিউ জার্সিতে জীববিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক এবং জিশা সারোয়ার; কানাডীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন নির্বাহী হিসেবে কর্মরত।
৪. শিল্পী হিসেবে পরিচিতি অর্জন: মনিরুজ্জামান মনিরের কথা ও সুরে সৃষ্টি হয় বিখ্যাত গান ‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম’। সাউন্ডটেকের ব্যানারে এই গান গেয়েছিলেন পাপিয়া সারোয়ার। এই গানের মাধ্যমেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। সে সময় যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার মুখে মুখে গানটি আওড়াতে দেখা যায়। ঘাটে-মাঠে, গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গায় গানটি প্রচুর পরিমাণে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

পাপিয়া সারোয়ার
ছবি: কবির হোসেন

৫. শিক্ষা সচেতনতা: সংগীতশিল্পীর পাশাপাশি শিক্ষা সচেতন একজন মানুষ ছিলেন পাপিয়া সারোয়ার। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রয়েছে তাঁর শিক্ষাজীবনের সম্পর্ক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।  
৬. রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি নিবেদন: রবীন্দ্রসংগীত যেন বাঙালির আত্মার সুর। এর গভীরতা, আবেগ এবং সুরের বৈচিত্র্য প্রতিটি মুহূর্তে জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমূল্য সৃষ্টি যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতির জন্য নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার উৎস। পাপিয়া সারোয়ার মূলত রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তাঁর প্রেমময় কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান শ্রোতাদের মনপ্রাণ ছুঁয়ে যায়। গানের প্রতি তাঁর দক্ষতার নৈপুণ্যে নিবেদন ও বিশুদ্ধ পরিবেশনায় বাংলা সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্য রক্ষিত হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতকে তিনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।

তাঁর কণ্ঠে অসংখ্য রবীন্দ্রসংগীত শ্রোতাদের মনে দাগ কেটেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো  ‘তোমার খোলা হাওয়া’, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘আমার এই পথ চলাতে আনন্দ’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে’, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’, ‘আমার মাথা নত করে দাও’ এবং ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। প্রতিটি গানে তিনি তাঁর স্বতন্ত্র পরিবেশনায় শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন।

৭. শিল্পীসত্তা ও সৃজনশীলতা: পাপিয়া সারোয়ার রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি নজরুলসংগীত এবং আধুনিক গানেও সমানভাবে দক্ষ ছিলেন।
৮. গানের দল: ছোটবেলা থেকে সারা জীবনই তিনি সংগীতকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন। এ ভালোবাসা থেকেই তিনি ১৯৯৬ সালে ‘গীতসুধা’ নামে একটি গানের দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
৯. কর্মজীবন: পাপিয়া সারোয়ার ১৯৬৭ সাল থেকে বেতার ও টিভিতে তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে গান করেন। ‘পাপিয়া সারোয়ার’ নামে তাঁর প্রথম অডিও অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্যান্য অ্যালবাম হলো ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী’ (১৯৯৪), ‘সং অব রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৯৬), ‘পূর্ণ চাঁদের মায়ায়’ (২০১৩), ‘আকাশপানে হাত বাড়ালাম’ (২০১৩), ‘চোখের দেখা প্রাণের কথা’ (২০১৪) ও ‘সকল রসের ধারা’ (২০১৭)। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

১০. পুরস্কার ও সম্মাননা: পাপিয়া সারোয়ার বাংলা একাডেমি থেকে ২০১৩ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপে ভূষিত হন। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০২১ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক অর্জন করেন। একুশে পদক লাভ তাঁর শিল্পীজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি।

আমাদের সবার প্রিয় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো রবীন্দ্রসংগীত, যা জীবন, মৃত্যু, প্রেম, প্রকৃতি, স্রষ্টা, মানবতা, ভক্তি, দেশপ্রেম, দুঃখ, সুখ এবং গভীর জীবনদর্শনের বিভিন্ন দিককে প্রবলভাবে উপস্থাপন করে।। পাপিয়া সারোয়ার কেবল একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী নন, তিনি নিঃসন্দেহে একজন কিংবদন্তি। তাঁর গানের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে।

বন্ধু, যশোর বন্ধুসভা