মানব অস্তিত্বের গভীর অন্বেষণমূলক বই ‘মেটামরফোসিস’

ফ্রানৎস কাফকা লেখা ‘মেটামরফোসিস’ বই

ফ্রানৎস কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪) একজন বিখ্যাত চেক লেখক, যাকে আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক মনে করা হয়। তাঁর রচনা গভীরভাবে মানুষের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন ধরনের অস্বস্তির অনুভূতি বিশেষভাবে তুলে ধরে। ফ্রানৎস কাফকার জীবনকালে তাঁর বই খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সাহিত্যের দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে পরিচিতি পান।

ফ্রানৎস কাফকা লেখা ‘মেটামরফোসিস’ বইয়ে গ্রেগার সামসা নামে এক সেলসম্যান যুবকের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বেশ কিছু ফলাফল দেখানো হয়েছে। পুরো গল্পে একটি বিষাদময়, হতাশাময় আবহ তোলে ধরা হয়েছে, যা মানবজীবনের সংকটকে চিত্রিত করে।

গল্পে গ্রেগার সামসার পরিবারে আরও তিনজন মানুষ ছিলেন। তার বৃদ্ধ পিতা, বৃদ্ধা মা এবং একমাত্র ছোটবোন গ্রিটা সামসা। পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন গ্রেগর সামসা। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একদিন তার বাবার সমস্ত ঋণ পরিশোধ করবেন এবং ছোটবোনকে একটি নামকরা সংগীতের স্কুলে ভর্তি করাবেন। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু একটি পরিবর্তনের কারণে তার পরিবারে ঝড় নেমে আসে।

একদিন গ্রেগর সামসা ঘুম থেকে উঠে দেখে সে আর মানুষ নেই। মানুষ থেকে একটি পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সে আগের মতো কোনো কাজই আর করতে পারছে না। ইতিমধ্যে অফিসের কেরানি এসে তাকে একপ্রকার কাজে আসতে বাধ্য করে এবং হুমকি দিয়ে যায় যে কাজ করতে না পারলে তাকে কাজ থেকে ছাঁটাই করা হবে। এই ঘটনার মাধ্যমে কাফকা মূলত দেখাতে চেয়েছেন, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মুনাফাই সব কিছু। পুঁজিবাদী সমাজে মানবিকতা বলে যেন কিছুই নেই।

অধ্যাপক নীহার কুমার সরকার ‘ছোটদের রাজনীতি’ বইয়ে বলেছেন, ‘প্রোলেটারিয়েটদের মূলত নিজের শরীর ছাড়া আর কোনো পুঁজি নেই; যা দিয়ে তারা আয় করতে পারে। তাই তারা নিজেদের শরীর খাটিয়ে উপার্জন করে। প্রোলেটারিয়েটদের নিকট থেকে ক্যাপিটালিস্টরা শক্তি কিনে নেয় এবং তা খাটিয়ে পণ্য উৎপাদন করে পরে বাজারে বিক্রি করে। বাজারে পণ্য বিক্রি করে মালিকেরা যা টাকা পায়, তা থেকে মজুরদের মজুরি দেয় এবং অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে, তা হলো ক্যাপিটালিস্টদের লাভ। এই লাভ ক্যাপিটালিস্টদের মূল কথা।’

পুঁজিপতিদের সঙ্গে শ্রমিকদের কোনো মানবিক সম্পর্ক তৈরি হয় না। এখানে গড়ে উঠে টাকার সম্পর্ক। যা আমরা মেটামরফোসিস বইটার কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রেটা সামসার সঙ্গে ঘটে যাওয়া কাহিনির মাধ্যমে দেখতে পাই।

গ্রেটা সামসা যখন আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসতে পারছিল না, তখন আমরা দেখি তার বৃদ্ধ মা–বাবার আবার কাজ করা শুরু করে। বাড়ির কিছু অংশ ভাড়া দেওয়া হয়। গৃহপরিচারিকাকে ছাটাই করা হয়। এরকম অনেক পরিবর্তনের মধ্যে গ্রেটা সামসা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করে যে পরিবারের লোকজন তাকে বোঝা মনে করছে। আগের মতো তাকে ভালোবাসে না, সহানুভূতি দেখায় না। তার রুমে আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। এই উপলব্ধি তাকে আরও দম বন্ধ হওয়া অনুভূতি দেয়। সে ভাবতে শুরু করে, যে পরিবারের জন্য একটা সময় দিনরাত পরিশ্রম করেছে, আজ তার বিপদে সবাইকে পাশে পাচ্ছে না। আরও বুঝতে পারে, এই পুঁজিবাদী সমাজে অক্ষম মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কতটা কঠিন।

ফ্রানৎস কাফকারের ‘মেটামরফোসিস’ মানব অস্তিত্বের একটি গভীর অন্বেষণমূলক বই। এটি পাঠকদের মনে প্রশ্ন তোলে, ‘আমরা কি সত্যিই আমাদের মানবিকতাকে ধরে রাখতে পারি, যখন আমাদের মূল্য কেবল উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়?’ গল্পটি একটি নিরন্তর অনুসন্ধান, যা মানুষের অস্তিত্বের মৌলিক সংকট ও সমাজের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সক্ষম। আধুনিক সাহিত্যের এই ক্লাসিক আজও আমাদের চিন্তায় প্রভাব ফেলে, মানব জীবনের জটিলতাগুলোকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

একনজরে
বই: মেটামরফোসিস
লেখক: ফ্রানৎস কাফকা
প্রকাশনী: ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রকাশনী (ইন্ডিয়া)
পৃষ্ঠা: ১০০
মূল্য: ২৫৮ টাকা।

বন্ধু, জামালপুর বন্ধুসভা