সহযোদ্ধা

পোশাকশিল্প কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিক। প্রতীকীছবি: প্রথম আলো

ভোরের আলো ছুঁয়ে যাওয়ার আগেই ঘুম ভাঙে বিউটি খাতুনের। ডান হাতে সাদা ঘড়ি। মেলা থেকে এনেছিল। তখন চৌগাছার গার্মেন্টসে কাজ করত। বর্তমানে ঢাকায় থাকে। একটি পোশাক কারখানার হেলপার পদে চাকরি করে।

ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ায় বিউটি। মুখখানি মলিন। চোখে হালকা ফোলাভাব। তবু চোখে একরাশ দৃঢ়তা। আজ পহেলা মে। সারা দিন ছুটি। তবু কেন জানি শরীরের ভেতর লেগে আছে মেশিনের একঘেয়ে শব্দ।

সকালে চা বানাতে বানাতে রুমমেট প্রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘আজ কি কারখানায় যাবিরে?’
‘না রে। আজ তো আমাদের দিন। মে দিবস!’ বিউটি হেসে বলল।
প্রিয়া মুচকি হেসে গালে হাত দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা বিউটি, আমরা কি সত্যিই আমাদের দিন আমাদের মতো করে পাই? কাটাতে পারি সময় আমাদের ইচ্ছেমতো?’
হঠাৎ মাথার মধ্যে কত কিছু যেন ভাবনার ক্যালকুলেটরে হিসাব কষতে শুরু করল। বিউটি চুপ হয়ে গেল। সে দুই বছর ধরে বাড়ি যায় না। ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ, মায়ের ওষুধ সবই এখন তার কাঁধে। কারখানার সুপারভাইজার বলেছিল, ‘তুমি যদি ভালো করে কাজ করো, তবে ইনক্রিমেন্ট পাবা।’ সেই দিন আজও আসেনি। অথচ বিউটি উৎসাহের সঙ্গে দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।

অফিস ছুটি। বিউটির পরিকল্পনা, বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাবে। শুনেছে, মে দিবস উপলক্ষে র‌্যালি হবে। আলোচনা সভা হবে।
শহীদ মিনারের সামনে অসংখ্য মানুষের ঢল। লাল ব্যানার দেখা যাচ্ছে। উড়ছে ফেস্টুন। বাঁপাশে ঘাড় ঘোরাতেই বিউটি দেখতে পেল, এক বৃদ্ধ হুইলচেয়ারে বসে আছেন। তাঁর গায়ে লাল পাঞ্জাবি। গলায় ঝুলছে ব্যাজ। তাতে লেখা ‘মে দিবসের যোদ্ধা’।
কাছে গিয়ে বিউটি জিজ্ঞেস করল, ‘চাচা, আপনি কি আগে থেকেই এই আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন?’
বৃদ্ধ হেসে বলল, ‘১৯৮৭ সালে আমরা গার্মেন্টসের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলাম। তখন তো এসব ছিল না। ব্যানার-ফেস্টুন কিছু না। ছিল শুধু বুকের ভেতর আগুন। ছিল নিজেদের অধিকার আদায়ের জেদ।’
বিউটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আপনারা না থাকলে আজ আমরা ছুটির দিন পেতাম না। সম্মান পেতাম না। নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা পেতাম না। এমনকি ঠিকমতো বেতনটাও পেতাম না। অধিকার আদায়ের যুদ্ধে আপনারা আমাদের সহযোদ্ধা।’
বৃদ্ধ বিউটির মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তোমরা আমাদের স্বপ্ন, মা। আমাদের সেই উজ্জীবিত শক্তি তোমাদের মধ্যে খুঁজে পাই। এখন তোমরাই আগুন হয়ে ওঠো। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনো আপস করবে না। নির্ভয়ে অধিকার নিয়ে কথা বলবে। মুখ খুলে বলো, শ্রমিক মানেই মানুষ। কেবল কাজের যন্ত্র নয়।’

নিজের জন্য, নিজের স্বপ্নের জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য চারদিকে নানা রকম স্লোগান দিচ্ছে সবাই। কেউ কেউ বলছে, ‘আমি শ্রমিক। আমি মানুষ।’
বিউটি ফিরে এল মিছিলের দিকে। সবাই স্লোগান দিচ্ছে—
‘শ্রমের মর্যাদা চাই, বাঁচার অধিকার চাই।’
চোখে জল চলে এল, কিন্তু বুকের ভেতর রোদ উঠেছে।
হাত উঁচিয়ে বিউটি চিৎকার করে বলল, ‘আমি শ্রমিক। আমি গর্বিত!’
লোকজন ফিরে তাকাল। কারও মুখে হাসি। কারও চোখে বিস্ময়।
আজ তার কাঁধে কাজের ভার নয়, গর্বের ওজন। বিউটি আনমনে বলে যায়, ‘শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে কত মানুষ কথা বলে বর্তমান সময়ে। কিছু মানুষ শ্রমিকের আন্দোলনেও সম্পৃক্ত হয়ে নিজে থেকেই। ভালো লাগে। অন্তত কিছুটা হলেও শ্রমিকদের মূল্যায়ন তো করা হয়। সর্বদা জয় হোক শ্রমিকের।’

বন্ধু, যশোর বন্ধুসভা