তোমার অমৃতসাগর-মাঝারে ভাসিছে অবিরামে

গল্পটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অলংকরণ: অভিনয় আহমেদ

চৈতালির মুখের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে জলপ্রপাতের মতো বিস্ময় ঝরে পড়ল চোখ থেকে। দুদিন আগেও মেয়েটি ছিল নির্ভার, নিঃসংকোচে কথা বলেছে। আজ এমন শক্তপোক্ত লাগছে কেন ওর চোখের ভাষা! কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কিছুটা শঙ্কিত হয়ে গানের শিক্ষক সুমন চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি মন খারাপ, চৈতালি?’

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সুমন চৌধুরীর দিকে তাকাল মেয়েটি। ওর মুখের ত্বকের ভেতর থেকে কিশোরী মুখের আলোর মতো অমোঘ স্পষ্ট আলো ঢেউ তুলে আচমকা মিলিয়ে গেল শূন্যে। বয়স ২০-২১ হলেও এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে ১৪-১৫। ঠোঁট কেঁপে উঠল। কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল সে।

সুমন চৌধুরী আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়েছ? নাকি মন খারাপের অন্য কোনো কারণ আছে তোমার?’

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কাঁধের ঝোলানো ক্যাজুয়াল ব্যাগটা হাতে ধরে বুকের কাছে এনে দাঁড়িয়ে রইল চৈতালি। দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে জানান দিল, সে ক্ষুব্ধ। ক্রোধ ঝরে পড়ছে চোখ থেকে। মুখের পেশি আরও শক্ত হয়ে গেল।

‘ঠিক আছে। বসো। প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না।’ বাঁ পাশে সরানো চেয়ারটা টেনে বললেন, ‘চেয়ারে বসো।’

আমার চোখ নিয়ে বাজে কথা বলেছেন কেন? আপনার কমেন্ট ভুলতে পারছি না। নিজেকে পচা মনে হচ্ছে দুদিন ধরে।

না বসে চারপাশে তাকাল চৈতালি। জানালা বন্ধ। পর্দা ঝুলছে সব কটি জানালায়। এ কক্ষে ঢোকার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেগে গেছে দরজা। কক্ষে এখন সে আর গানের শিক্ষক সুমন চৌধুরী। ভয় পেল না বদ্ধ ঘরে। বহুবার এ ঘরে এসেছে। কোনো অঘটন ঘটেনি, অঘটন ঘটার শঙ্কা এখনো উঁকি দিল না মনে। তবে শিক্ষক-ছাত্রীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে গেছে কালো ছায়া। ক্রোধে কেঁপে উঠলেও মনের সরল চারাগাছটা কেঁপে ওঠেনি, দেহেও বাজেনি গোপন আকাঙ্ক্ষার গিটার। তবে মনের মেঘে ছেয়ে গেল ঘর। শিহরণে কেঁপে উঠল মায়াবী মন। মায়া নয়, আগুন-শব্দ বেরিয়ে এল চৈতালির মুখ থেকে:

আমার চোখ নিয়ে বাজে কথা বলেছেন কেন? আপনার কমেন্ট ভুলতে পারছি না। নিজেকে পচা মনে হচ্ছে দুদিন ধরে।

চৈতালির ক্ষুব্ধ অভিব্যক্তির কারণ এতক্ষণে বুঝতে পারলেন সুমন চৌধুরী। গত ক্লাসে গান শেখা শেষ হওয়ার পর বলেছিলেন, ‘ফেসবুকে তোমার যে দুটি ছবি পোস্ট করেছ, তাতে তোমার চোখের ভঙ্গিমা ভয়ংকর সুন্দর! সেক্সি! চোখের এমন লুক ছেলেদের প্রলুব্ধ করতে পারে। ওই দুটো তুলে নিয়ে অন্য কোনো সহজ ছবি পোস্ট করে দিয়ো।’ কথাটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন বললেন, ‘বাহ! তুমি তো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। শুধু গানের শিক্ষকই নই আমি। তোমাকে ভালো বিষয়ে গাইড করতে পারব না? তোমার বয়সের দ্বিগুণ বয়স আমার। অভিজ্ঞতাও বেশি। বিষয়টা বলেছি তোমার ভালোর জন্য। ফেসবুকে বা নেটে এ ধরনের লুক নানাভাবে ব্যবহার করতে পারে দুষ্কৃতকারী চক্র। সহজ আনন্দ করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে অসংখ্য মেয়ে। তোমাকে সতর্ক করার অর্থ কি পচা কথা বলা?’

‘“প্রলুব্ধ করে” মানে কী? পচা কথা না এটা? চাহনি দিয়ে কি কাউকে প্রলুব্ধ করা যায়? পচে গেছে আপনার চোখ। এ জন্য পচা কথা বলেছেন। নিজেই প্রলুব্ধ হয়ে বাঁকা চোখে দেখেছেন আমাকে। ছবি দুটো সরিয়ে ফেলেছি আমি। খুলে দেখুন আমার প্রোফাইল।’

‘সরিয়ে ভালো করেছ। তবে আমার উপদেশ ভালোভাবে নেওয়া উচিত তোমার। বিপদে পড়লে, বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আগেই ছারখার হতে দেখেছি অনেক মেয়ের জীবন। গুণী ও প্রিয় ছাত্রীকে এ বিষয়ে সতর্ক করা মানে কি বাঁকা চোখে দেখা?’

‘তো, প্রলুব্ধের কথা বললেন কেন? আমি কি প্রলুব্ধ করেছি কাউকে?’

‘তুমি করেছ সেটা বলিনি। তোমার চোখের ধারালো ওই লুক দেখে আলোড়িত হতে পারে অনেকে। সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আকর্ষিত হলে, আকর্ষণ বাধা পেলে, তাদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক আবেগের সৃষ্টি হতে পারে। সেই আবেগ ক্ষতি করতে পারে তোমাকে। এটা ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্ল্ড। কৃত্রিম জগৎ। মৌলিক অনুভূতির চেয়ে কৃত্রিম আবেগের ছড়াছড়ি বেশি এখানে। ফাঁদও বেশি। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রীটিকে সতর্ক করা দায়িত্ব মনে করেছি, পরামর্শ দিয়েছি। পরামর্শ গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার রয়েছে তোমার।’

‘পরামর্শ বর্জন করিনি। গ্রহণ করেছি। বললাম তো, ছবি দুটো সরিয়ে ফেলেছি। তবে আমার মনে হয়েছে, অনেকে আলোড়িত হতে পারে, কথার আড়ালে নিজেকেই প্রকাশ করেছেন আপনি। ফেরেশতার মতো মনে করেছি আপনাকে। এখন দেখছি ফেরেশতাও প্রলুব্ধ হয়।’

সরাসরি আক্রমণ করেছে চৈতালি। এ আক্রমণের টার্গেট সুমন চৌধুরী নিজেই। মনে হলো, এ মুহূর্তে চৈতালির বলা শব্দ থেকে দৈবগুণে ছুটে বেরোচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে বাজপাখি। পাখিদের ধারালো নখের উপর্যুপরি আঘাতে ছিঁড়ে গেছে পাঁজরের মাংস-হাড়। সযত্নে লালিত নিজের এত দিনের নৈতিক সূর্যটার কদর্যতা আছে, টের পাননি তিনি। চৈতালির কথার দাপটে খুলে গেছে নিজের খোলস। নৈতিক সূর্যটাকে কেটেকুটে দেখলেন নিজেই। নাহ্! চৈতালির ঢেলে দেওয়া গরল মেনে নিতে পারলেন না। নিজের মধ্যে কোনো কলুষতার ছায়া দেখতে পেলেন না তিনি। চৈতালিকে স্নেহের চোখেই দেখেছেন, নিজের মেয়ে নেই, থাকলে মেয়ের বয়সীই হতো চৈতালি। মেয়ে মেয়ে ভাবার কারণে পিতৃসুলভ আবেগের অনুভূতি টের পেয়ে বললেন, ‘তোমার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি। কারণ, তোমাকে আমি কখনো নারী হিসেবে দেখিনি, নিজের মেয়েরূপে দেখেছি। বাবা যেমন মেয়েকে সতর্ক করেন, পরামর্শ দেন, আমিও সেই রকম পরামর্শ দিয়েছি।’

‘বাবারা এমন বাজে কথা বলবেন না মেয়েকে। আপনি বলেছেন। বলে এখন বাবা সাজার ভান করছেন।’

চৈতালির কথা শুনে বিস্ময়ের ফোঁটা ফোঁটা জলে ঝাপসা হয়ে গেল সুমন চৌধুরীর চোখের আলো। নৈতিক আলোয় মোটেও অন্ধকার নেই, মোটেও কালিমা নেই। আত্মবিশ্বাসী সুমন চৌধুরী বললেন, ‘তোমার ধারণা ঠিক নয়। ভুল। এর বাইরে বলার কোনো জবাব নেই আমার। তোমার আচরণে একটা বোল্ডনেস দেখেছি। এখন মনে হলো ভুল দেখেছি, মনের ভেতরটা তোমার বেশ রক্ষণশীল। তোমার মধ্যে কোথাও খাদ আছে নিশ্চয়ই। তাই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছ আমার কথা। তোমার ভালো চাই আমি। আমার কাছে গান শিখতে না-ও আসতে পারো। বর্জনও করতে পারো আমার ক্লাস। সে অধিকারও আছে তোমার। তবে শেষ পরামর্শ দিচ্ছি, কোনো ঘটনা নেতিবাচক চোখে মেপে দেখার আগে ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনা কয়েকবার মূল্যায়ন করে দেখা উচিত। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো। উপদেশটা মনে থাকলে ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে, সে দোয়া করছি তোমার জন্য।’

এ সময় কক্ষে ঢুকল চৈতালির দুই ফ্রেন্ড—উষা ও সায়ন্তনী।

উষা প্রশ্ন করল, ‘কথা শেষ হয়েছে চৈতালি?’

চৈতালি জবাব দিল, ‘হ্যাঁ। শেষ। যা বলার বলেছি।’

সায়ন্তনী বলল, ‘ভালো করেছিস বলে। চল এখন বেরোই।’

সুমন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে উষা বলল, ‘মেয়েদের ব্যাপারে নোংরা কমেন্ট থেকে বিরত থাকবেন। নোংরা কথা বলা মানে ইভ টিজিং করা। এবারের জন্য ছেড়ে দিলাম আপনাকে। ছাড় দেব না ভবিষ্যতে। মনে রাখবেন কথাটা।’

কথা শেষ করে চৈতালিকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল তিন বান্ধবী। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন সুমন চৌধুরী। বুঝতে পারলেন, চৈতালি এ কক্ষের ভেতরে একা ঢুকলেও বাইরে দাঁড়িয়েছিল ওরা দুজন। নিজের মন স্বচ্ছ হলেও, স্বচ্ছতায় বসে গেল কালির লেপন। ওরা ধরে নিয়েছে ‘ইভ টিজিং’ করেছেন তিনি। অবিশ্বাস্য কথাটা মাথায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ছাদের পলেস্তারা ফুঁড়ে গরম তাপ ঢুকে গেল মস্তিষ্কে। ওদের অচিন্তনীয়, অবিশ্বাস্য কথা বুলেটের মতো আক্রমণ করার কারণে দপ করে নিভে গেল নিজের অন্তরের সৌরবলয়ের আগুন।

কষ্ট পেয়ে দুম করে চেয়ারে বসে পড়লেন সুমন চৌধুরী। চৈতালির কণ্ঠ শুনে মনে আনন্দ হতো এই ভেবে যে চঞ্চল গানের পাখিটির শিক্ষক তিনি। এখন মনে হচ্ছে নীলকণ্ঠ পাখি হঠাৎ সাগরগর্ভে বিসর্জন দিয়ে গেল তার চোখে দেখা দেবতুল্য শিক্ষককে। ভুল বিশ্লেষণ আর ভুল সিদ্ধান্তের পথেই এগিয়েছে; ওই পথ থেকে এখন ফিরবে না আর। হয়তো একদিন ভুল বুঝবে। ভুল বুঝলেও তখন আগের মতো খুঁজে পাওয়া যাবে না আনন্দের পাখিটাকে।

দুই

বান এলে মরা গাঙে নীরবতা ভাঙে, সরব হয়। অথচ মনগাঙে জলোচ্ছ্বাস এসে নেমে যাওয়ার পরও নীরব প্রকৃতির সুমন চৌধুরীর নীরবতা ভাঙছে না, বিস্ময়ের ঘোর থেকে এখনো বেরোতে পারছেন না। আঙুলের অগ্রভাগের নিপুণ স্পর্শে হারমোনিয়ামের বিটে টোকা দিয়ে তুলতেন নির্ভরতা আর মুগ্ধতার সুরলহরি। আঙুলের ছোঁয়ায় আর সুর উঠবে বলে মনে হচ্ছে না। তাললয়ের মূর্ছনায় শ্রোতার মন ভরাতে পারবেন, হঠাৎ ঝড়ের আঘাতে সেই আশারও জলসমাধি ঘটেছে। ঢেউ আর ঝড়ের ব্যাপকতা আরও কত গভীর হতে পারে, জানা ছিল না সুমন চৌধুরীর। পাশে রাখা মুঠোফোনে মেসেজ আসার শব্দ হওয়ায় হাতে তুলে নিলেন সেট। মেসেজ অপশনে চাপ দিয়ে উন্মুক্ত করলেন ইনবক্স। দুটিমাত্র শব্দ ঢুকেছে ইনবক্সে, ‘কুত্তার বাচ্চা!’

চোখের মাধ্যমে শব্দ দুটি শাঁই করে ঢুকে গেল মস্তিষ্কে। নতুন তিক্ত বোধে টলে উঠলেন তিনি। শঙ্কা আর উদ্বেগের উড়াল ঢেউ মনগাঙে আবার তুলল জোয়ার। নীরবতা আর নীরব রইল না। উৎকণ্ঠার বীভৎস উল্লাসে সরব হয়ে উঠল ব্রেন। কপালে ঘাম জমে গেছে। বুকেও চাপ বোধ করছেন। হাত কাঁপতে শুরু করেছে। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দেহ। প্রযুক্তিবোমার আঘাত থামছে না। আবার শব্দ হলো সেটে। আবার মেসেজ? শব্দস্কাড আর কত নিম্নমানের হতে পারে? ‘কুত্তার বাচ্চা’র চেয়ে তো খারাপ কোনো গালি অভিধানে আছে বলে জানা নেই। এ ভাবনা মনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় দেখে নিলেন মেসেজ-ইনবক্স। আবার ঢুকেছে দুটি শব্দ, ‘ইতরের বাচ্চা!’

দুরন্ত চিল ছোঁ মেরে খুলে নিয়ে গেল হৃৎপিণ্ড! চিলের ডানায় উড়ে গেল অতীতের সাফল্যগাথা, বর্তমানের শ্রম আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। ছাইরঙা আকাশে ঢেকে গেল আলোকিত সময়ের রোদ্দুর। মনের মধ্যে নতুন চিন্তার উদয় হলো, কোনো মেয়ে এসব শব্দ এসএমএস করে পাঠাতে পারে না। নিশ্চয়ই ছেলেদের কেউ এ কাজ করেছে। চৈতালির ছেলে বন্ধুরাও কি জেনে গেছে সব? ছেলেদের জানাজানির কারণে কি ভয়ংকর কোনো পরিণতির দিকে নেমে যাচ্ছে নির্দোষ ঘটনাটা! রসাল আলাপ-আলোচনার চাপে এ ঘটনা আরও ফুলেফেঁপে উঠবে, আরও বিস্তার করবে শাখা-প্রশাখা। আরও দুর্গন্ধ ছড়িয়ে যাবে। সেই ঢেউ সামাল দেওয়ার শক্তি থাকবে না চৈতালির, ভেসে যাবে চৈতালির সুনামও। নিজেই কেবল ডুববেন না। ডুবে যাবে দীর্ঘদিনের শ্রমে গড়ে তোলা গানের স্কুলও। অসংখ্য ছেলেমেয়ে গান শিখতে আসে। সেই সঙ্গে আসেন অভিভাবকেরা। মায়েরা কেবল নিজের সন্তান নিয়ে সচেতন হলেও, অন্যের সন্তানের দোষ ধরতে ও কুৎসা রটাতে মোটেও দ্বিধাগ্রস্ত হবেন না। ঈর্ষার কারণে চৈতালির মতো দুরন্ত ও সফল মেয়ের বদনাম গেয়ে আনন্দ পাবেন তাঁরা। চিন্তার জাল প্রসারিত হচ্ছে, স্ফীত হচ্ছে। চৈতালির বান্ধবী উষার শেষ কথাটা মনে পড়ল, ‘মেয়েদের ব্যাপারে নোংরা কমেন্ট থেকে বিরত থাকবেন। নোংরা কথা বলা মানে ইভ টিজিং করা। এবারের জন্য ছেড়ে দিলাম আপনাকে। ছাড় দেব না ভবিষ্যতে।’

ঘটনার ভুল ব্যাখ্যাটা ছেলেরা জেনে গেলে ভুল-শুদ্ধ বিচার করবে না। মুহূর্তে ধুলায় লুটিয়ে দেবে নিজের গৌরব। ভুলকেই সত্য হিসেবে মেনে নেবে ওরা। যাচাই-বাছাই করবে না; একদম না। এ অবস্থায় চৈতালিদের কথা কথিত ক্ষমাই যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যতে লাগামটি থাকবে না তাদের নিয়ন্ত্রণে। ঝোড়ো উদ্বেগ নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে পাশের ঘরে ঢুকলেন। ওই রুমে কয়েকটি শিশুকে হারমোনিয়ামের বেসিক সূত্রের ওপর তালিম দিচ্ছিলেন এ স্কুলের আরেকজন শিক্ষক, শিপ্রা মণ্ডল।

সুমন চৌধুরী এ স্কুলের অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ হলেও তাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করেন না অন্য শিক্ষকেরা। সবাই ভাই বলে ডাকেন। অধ্যক্ষকে দেখে হাতের কাজ থেমে গেল শিপ্রা মণ্ডলের। মুখ তুলে সুমন চৌধুরীর দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে আকস্মিক থেমে গেল হারমোনিয়ামের ওপর হাত চালানোর শৈল্পিক গতি। মুখ থেকে ছুটে বেরোল উদ্বেগ জড়ানো প্রশ্ন, শরীর খারাপ লাগছে, সুমন ভাই?

সুমন চৌধুরী জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, কিছুটা খারাপ বোধ করছি। আপনি একটু আসবেন আমার কক্ষে?’

‘শিওর। আপনার কক্ষে বসুন আপনি। আমি আসছি।’

নিজের রুমের দিকে ফিরে গেলেন সুমন চৌধুরী। একটি বড় শিশুর হাতে হারমোনিয়ামে গান তোলার দায়িত্ব দিয়ে শিপ্রা মণ্ডলও ঢুকলেন অধ্যক্ষের রুমে।

চেয়ারে বসলেন সুমন চৌধুরী। শিপ্রাও বসল টেবিলের সামনের চেয়ারে। উজ্জ্বল মুখের সুমন চৌধুরীর মুখ ছাই রং ধারণ করেছে এ মুহূর্তে।

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শিপ্রা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনো দুঃসংবাদ আছে, সুমন ভাই?’

‘দুঃসংবাদ বলা যাবে না। একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি।’

‘নিজের অতল মনে কোনো কদর্যতা কিংবা কলুষতা আছে বলে মনে হয়নি কখনো। আজ টের পেলাম, নিজেকে বোঝা হয়নি, জানা হয়নি।’

শিপ্রা মণ্ডল বললেন, ‘হ্যাঁ। সেটা ঠিক। নিজেকে বোঝা বা জানা কঠিন কাজ। এ জন্যই তো সক্রেটিস বলেছেন, “নো দাইসেলফ।”’

‘চারপাশের মানুষ কি একটা মানুষকে বুঝতে পারে? ধারণা লাভ করতে পারে কেমন তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য?’

‘কিছুটা তো বুঝতে পারে। তবে অতল মনের রহস্য বোঝা সহজ নয়।’

শিপ্রা মণ্ডলের জবাব শুনে দমে গেলেন সুমন চৌধুরী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আমারও সেটা মনে হচ্ছে, হয়তো অতল মনে আমার ভেতর অন্য একজন আমি আছি, সেই আমিটাকে চিনি না আমি।’

‘এমন ভাবনা এল কেন’, সুমন ভাই?

‘বললাম তো, একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি আমি।’

‘খুলে বলা যাবে? বিশ্বাস রেখে সব বলতে পারেন আমাকে। বললে আপনারই লাভ হবে। মন হালকা হবে। মনে হচ্ছে চাপে পড়েছেন।’

শিপ্রা মণ্ডলের আশ্বাস পেয়ে পুরো ঘটনা খুলে বললেন সুমন চৌধুরী। মনোযোগ দিয়ে শুনে শিপ্রা মণ্ডল বললেন, ‘নিজের নিকট তো স্বচ্ছ আপনি। ভয় পাবেন কেন?’

‘আমার স্বচ্ছতা থাকলে তো হবে না। যেহেতু বিষয়টির সঙ্গে এক ছাত্রী জড়িত, একালের সেনসিটিভ ইস্যু এটা। উদ্বেগ কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? আপনাকে ডেকেছি নিজের ব্যাপারে জানার জন্য, আমার কি কোনো ত্রুটি আছে? ছাত্রীকে বা অন্য কোনো মেয়েকে কি প্রলুব্ধ করার মতো কোনো দৃষ্টিভঙ্গি দেখেছেন আমার চরিত্রে?’

‘আপনার শত্রুও কখনো এ অভিযোগে দুষবে না, বদনাম রটাবে না। নিশ্চিত আমি। আমরা তো চারপাশে থাকি, সব সময় দেখি আপনাকে। ওই ধরনের পুরুষ নন আপনি। নিশ্চিত হতে পারেন। অবচেতনের গোপন প্রলোভন থাকতেই পারে মানুষের। সেই প্রলোভন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও আপনার ঈর্ষণীয়। নিজের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস হারাবেন না, আশা করি ঠিক হয়ে যাবে সব। চৈতালি আমাদের গুণী ছাত্রী। ওর একার কণ্ঠ থেকে প্রতিবাদী স্বর বেরোনোর কথা নয়। নিশ্চয়ই দুই বান্ধবী উসকে দিয়েছে ওকে। আমার সঙ্গে দেখা হলে বুঝিয়ে দেব, দায়িত্ব নিলাম। নিশ্চিন্তে থাকুন আপনি।’

স্বপ্নবান সুমন চৌধুরীর মনের ঝড় থামল না। কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন তিনি। উদ্বেগমুক্ত হননি। নিখুঁত জীবনের ভিত গড়ে তোলার কাজে নিষ্ঠাবান তাঁর সামনে মরীচিকার ঢেউ ভেসে উঠল হঠাৎ। মরীচিকার সামনে দুর্গম আঁধার। সূর্যের আলোয় আঁধার দূর না হলেও ছোট একটু করে আশায় জোনাকি জ্বলজ্বল করে উঠল শিপ্রা মণ্ডলের কথায়।

কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সুমন চৌধুরী বললেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।’

‘ধন্যবাদ জানাবেন কেন? ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। আবার বলছি, এটা আমার দায়িত্ব। আমরা সবাই আছি আপনার সঙ্গে।’

‘না, না। সবাই থাকার প্রয়োজন নেই। আর কাউকে জানাবেন না, প্লিজ। আপনার মধ্যে কথাটা সীমাবদ্ধ থাকুক।’

‘হ্যাঁ। সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয়, সবার সহযোগিতার প্রয়োজন হচ্ছে, জানাতে হবে না সবাইকে?’

‘সেটা পরে দেখা যাবে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’

‘ঠিক আছে, সুমন ভাই। বাসায় যান। ইজি থাকুন প্লিজ। আমার মন বলছে কোনো ঝামেলা হবে না।’

শিপ্রা মণ্ডল চলে যাওয়ার পর হঠাৎ ঝড়ের মতো উড়ে আসা জীবন-মরীচিকার অগ্রভাগে অন্ধকারের বদলে আলোর শিখা দেখতে পেলেন সুমন চৌধুরী। ছায়া আছে আলোর শিখারও। আঁধারেরও আছে আঁধার। বুঝে গেছেন, জীবনের সেই আঁধারের তল খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। অতলের তল বড় বেশি অসীম...বড় বেশি রহস্যময়...

তিন

‘সুমন স্যারের কথাগুলো সায়ন্তনীকে বলা ঠিক হয়নি। উষাকেও নয়। একা একা আরও তলিয়ে দেখা উচিত ছিল, স্যারের কথা ভেবে কিছুটা অস্থির হয়ে উঠল চৈতালি। ক্লাস আছে আজ। কীভাবে স্যারের সামনে যাবে, মুখ দেখাবে কীভাবে? মাথায় প্রশ্ন নিয়ে ক্লাসরুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হলো, দেহ টেনে এগিয়ে যাচ্ছে অচেনা এক কঙ্কাল। কঙ্কালের অদ্ভুত পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল সে। দুই কানে আঙুল ঢুকিয়ে চোখ বুজে বিল্ডিংয়ের পিলারের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল চৈতালি।

‘কানে আঙুল ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

আচমকা প্রশ্ন শুনে চোখ খুলে দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনীক। বিব্রত অবস্থার মুখোমুখি হলো।

কান থেকে আঙুল বের করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চৈতালি জবাব দিল, ‘তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?’

‘আমাকে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। জাস্ট কৌতূহলের বশে জানতে চাচ্ছিলাম। অবশ্য প্রশ্নের জবাব তুমি দিতে পারো স্যারকে!’

কথা শুনে নীল হয়ে গেল চৈতালি। মনে হলো, বিষের থলি উল্টিয়ে কালকেউটের মতো হিসহিসিয়ে ছোবল দিল অনীক।

কথার জবাব না দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল চৈতালি। পথ আগলে অনীক জিজ্ঞেস করল, ‘শুনলাম, সুমন স্যার প্রপোজ করেছে তোমাকে। ওনার রুমে নাকি কাপড় খোলার চেষ্টা করেছে তোমার?’

প্রশ্ন শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল চৈতালি। কান লাল হওয়ার মেয়ে নয় সে। তবু লাল হয়ে উঠল দুই কান। মুখের ত্বকে ছলকে ছুটে এল রক্ত প্রবাহ। লালচে হয়ে গেছে মুখের উজ্জ্বল সাদা ত্বক। ক্ষণকাল পরে নিজেকে সামলে শক্ত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কে বলেছে এসব?’

‘অশ্লীল বিষয় কি লুকানো থাকে? লজ্জা পাচ্ছো কেন? স্যার তো হ্যান্ডসাম পুরুষ। ঝুলে পড়ো, কেউ বাদ সাধবে না। আমার কষ্ট হবে। সমবয়সী বলে রিজেক্ট করেছিলে আমার প্রস্তাব। তবে আমি সাপোর্ট দিচ্ছি তোমাকে। গো অ্যাহেড। আই শ্যাল হেলপ ইউ। তুমি বললে স্যারের বিরুদ্ধে ফেনিয়ে ওঠা অসন্তোষ, বিদ্রোহ সামাল দিয়ে ফেলব। তোমাকে উপকার করার সেই সুযোগ কি দেবে আমাকে?’

অনীককে আর সহপাঠী মনে হলো না। মনে হলো অচেনা কোনো যুবক ভালো লাগার কথা জানিয়েছিল, প্রত্যাখ্যাত হয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চুপ সময়ে গুপ্তঘাতকের বেশে বেড়ে উঠেছে; সুযোগ বুঝে ঢেলে দিচ্ছে শ্লেষ। তার অশুভ ভালো লাগায় জন্ম নিয়েছে ক্ষোভ, প্রতিহিংসা। প্রতিহিংসা ফলানোর সুযোগটা কাজে লাগাতে চাচ্ছে এখন।

দৃঢ় স্বরে চৈতালি জবাব দিল, ‘পথ ছাড়ো। ওই সব নোংরা কথা বলে আমাকে কাহিল করতে পারবে না। আর শোনো, সুমন স্যার প্রপোজ করেনি আমাকে। বাকি যে বাক্যটা ব্যবহার করলে, মুখে উচ্চারণ না করে বলছি, স্যার তোমার মতো এত লুইচ্চা স্বভাবের না যে অন্য মেয়ের কাপড় খুলতে চাইবেন।’

‘তাহলে উষা আর সায়ন্তনীকে নিয়ে শাসিয়ে এসেছ কেন? লুকাতে চাচ্ছো নিজের স্খলন আর লুণ্ঠনের কাহিনি? আমরা তো শুনেছি, শুধু কাপড়ই খোলেনি, স্যার বিছানায়ও শুইয়েছে তোমাকে।’

‘তোমার অরুচিকর কথার কোনো জবাব হয় না। নোংরা মনের কল্পনায় কেবল ভাসতে পারে, এমন নোংরা আর অশ্লীল দৃশ্য। নিজে নিশ্চয়ই এভাবে কোনো মেয়ের কাপড় খুলেছ, বিছানায় শুইয়েছ, এমন করেছ, তাই ভেবেছ সব মেয়েকে বিছানায় শোয়ানো সোজা। তা-ই না? আমাকে প্রশ্ন করে নিজেরই কলুষ মনের প্রকাশ ঘটিয়েছ, এটুকুন বোঝারও মেধা নেই তোমার। বুঝেছ?’

‘আমার মেধার ঘাটতি আছে নিশ্চয়ই। এ জন্যই তোমার মতো সেক্সি মেয়েকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ব্যর্থ হয়ে নিজেকে ভিলেন ভাবতে চাই না। তবে সুযোগ পেলে তোমার উপকার করতে চাই’, গলার স্বর নরম করে বলল অনীক।

অনীকের সামনে থেকে দ্রুত সরে গেল চৈতালি। এ রকম বিশ্রী প্রশ্নের মুখোমুখি কখনো হয়নি সে। অনেক প্রস্তাব, প্রলোভন মোকাবিলা করেছে। ডাইরেক্ট এমন কথা শুনতে হবে, কল্পনাও করেনি। অনীকের কথার সঙ্গে স্যারের কথা মিলে গেছে। সেক্সি মেয়ের লেবাস গায়ে পরিয়ে দিয়েছে অনীক। আসলেই কি ‘সেক্সি লুকের’ কথা বলেছিল? দেহটাও কি তবে সেক্সি! ভাবতে ভাবতে ক্লাস না করে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো চৈতালি। এ সময় সামনের করিডর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখল সায়ন্তনীকে।

ইশারায় ডাকছে সায়ন্তনী, থামতে বলছে। চৈতালি একবার ভাবল, থামবে না; বেরিয়ে যাবে ক্যাম্পাস থেকে। তারপরও বেরোতে পারল না। সায়ন্তনীর ডাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া টের পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কাছে এসে সায়ন্তনী বলল, ‘এমন হনহন করে কোথায় যাচ্ছিস? ক্লাসে ঢুকবি না?’

‘না।’ শক্ত স্বরে জবাব দিল চৈতালি।

‘ক্লাস অ্যাভয়েড করলে সমস্যা আরও বাড়বে, আরও ফুলেফেঁপে উঠবে ঘটনা, রসাল আলোচনা বেড়ে যাবে।’

‘বাড়ুক। ক্লাসে ঢোকার ইচ্ছা নেই আমার।’

‘পাগলামো করিস না, চৈতালি। কথা শোন আমার।’

‘তোরা তো আমার কথা শুনিসনি। তুই আর উষা ছাড়া বিষয়টা কেউ জানত না। বাইরে ছড়াল কীভাবে? অনীকরা জানল কীভাবে?’

‘তোকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, আমার নিকট থেকে কোনো শব্দ বাইরে ফাঁস হয়নি। উষা সম্ভবত ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। এভাবেই বোধ হয় লিক হয়ে গেছে কথা।’

‘তুই-ই বলেছিলি, একাকী গিয়ে স্যারের নিকট অশ্লীল কথার প্রতিবাদ জানাতে। প্রতিবাদ করলে ভবিষ্যতে কোনো মেয়েকে অশোভন কথা বলার সুযোগ পাবেন না তিনি। এ জন্যই তো সাহসী হয়েছিলাম। সাহসের ফল কী এই যে ছেলেরা বলে বেড়াবে, স্যার ওনার রুমে কাপড় খোলার চেষ্টা করেছিলেন আমার?’

চৈতালির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল সায়ন্তনী। বিস্ময় ঝরে পড়ল তার কণ্ঠেও, ‘এত দূর গড়িয়েছে ঘটনা!’

‘হ্যাঁ। বেশ রসিয়ে কথাগুলো শুনিয়ে গেল অনীক। তুই তো জানিস, সে বহুদিন ঘুরেছে পেছনে, বাগে নেওয়ার চেষ্টা করেছে আমাকে। পারেনি। সুযোগ পেয়ে গুপ্তচরের মতো প্রতিঘাত করার চেষ্টা করছে এখন। কলুষ ছড়াচ্ছে। অশ্লীল কথা শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে বিছানায়!’

উষার ওপর রাগ হচ্ছে সায়ন্তনীর। কেন সে গোপন কথা পেটে রাখতে পারল না! কেন সে ফাঁস করল বয়ফ্রেন্ডের নিকট? ঘটনার মোড় টের পেয়ে সায়ন্তনীর উদ্দেশে জোর করে বলল, ‘ক্লাস অ্যাভয়েড করা চলবে না। স্যারের ক্লাস এড়িয়ে গেলে ছেলেরা আরও বেশি লাই পেয়ে যাবে, তাদের বিশ্বাস আরও বেশি শক্ত হবে। তাদের হিংসার আগুনে পুড়ে যাবি তুই, স্যারও।’

সায়ন্তনীর মুখে ‘স্যার’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর নরম এক ঢেউ জেগে ওঠার খবর টের পেল চৈতালি। স্পষ্টভাবে মনের গিটারে বেজে উঠল সুমন স্যারের শেষ পরামর্শটি, ‘কোনো ঘটনা নেতিবাচক চোখে মেপে দেখার আগে ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনা কয়েকবার মূল্যায়ন করে দেখা উচিত। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো। উপদেশটা মনে থাকলে ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে, সে দোয়া করছি তোমার জন্য।’ প্রথমে মূল্যায়ন করল স্যারের সেই কথা, ‘ফেসবুকে তোমার যে দুটি ছবি পোস্ট করেছ, ছবিগুলোতে চোখের ভঙ্গিমা ভয়ংকর সুন্দর! সেক্সি! চোখের এমন লুক ছেলেদের প্রলুব্ধ করতে পারে। ওই দুটো তুলে নিয়ে অন্য কোনো সহজ ছবি পোস্ট করে দিয়ো।’ এখানে স্যারের প্রলুব্ধ হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্য ছেলেদের চোখ ও জিব থেকে বাঁচানোর জন্য সঠিক পরামর্শ দিয়েছিলেন সুমন স্যার। তখন এভাবে অর্থটা ধরা দেয়নি। বরং উসকে দিয়েছিল উষা। উষার অতল মনে কি গোপন হিংসার শিখা জ্বলে উঠেছিল? অতল থেকেই কি সে চেয়েছিল চৈতালির ক্ষতি? চেতন মনে হয়তো চায়নি। অবচেতন থেকেই বোধ হয় বলেছিল এমন কথা। নতুন ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে মনযাতনা কমে এল। স্যারের প্রতি ক্ষোভ কমে গেল, উল্টো ভালোবাসার অনুরণন ছড়িয়ে গেল মনজুড়ে। উষার প্রতিও ক্রোধ জেগে উঠল না। বুঝল, নারী মন হিংসায় কাতর হতেই পারে। তারও উচিত ছিল বুদ্ধি খরচ করে চলা। চলতে পারেনি। আবেগের তোড়ে ঢুকে গিয়েছিল সুমন স্যারের কক্ষে। কঠিন কথা শুনিয়ে এসেছে। এ অশ্রদ্ধা, অপমান স্যারের প্রাপ্য ছিল না। অপরাধবোধে কাতর হয়ে সায়ন্তনীর উদ্দেশে বলল, ‘ঠিকই বলেছিস তুই। ক্যাম্পাস ত্যাগ করা ঠিক হবে না। ক্লাসে হাজির থাকতে হবে।’ প্রত্যয়ী হয়ে সায়ন্তনীর হাত ধরে বলল, ‘চল, ক্লাসে যাই।’

ক্লাসরুমে ঢুকে দেখল, সামনের সারিতে বসে আছে উষা। সামনে না বসে পেছনের সারিতে বসল চৈতালি। সায়ন্তনীও বসল পাশাপাশি। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল উষা। চোখাচোখি হওয়ামাত্রই ম্লান হাসল চৈতালি। এ হাসির অর্থ ধরতে পারল না উষা; ইশারায় ডাকল সামনে বসার জন্য। বুঝেও চৈতালি পাত্তা দিল না সেই ডাক। কঠিন অভিব্যক্তি নিয়ে বসে রইল নিজ আসনে। চারপাশে গুঞ্জন হচ্ছে। কিসের গুঞ্জন, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। চৈতালিও বুঝল, ওদের মূল আলোচ্য বিষয় সে আর সুমন স্যার। গুঞ্জন তাকে কাবু করতে পারল না, ভাঙতে পারল না। কিন্তু ভেঙে চুরমার হতে লাগল, যখন দেখল ক্লাসে ঢুকেছেন শিপ্রা ম্যাডাম। নির্ধারিত ক্লাস কখনো মিস করেন না স্যার। আজ করলেন। চৈতালি বুঝল, বুদ্ধিমান স্যার ভুল করলেন আজ। ভুলটা করার কথা ছিল ওর। অথচ স্যারের পরামর্শ নতুনভাবে মেপে, নতুনভাবে উপলব্ধি করে নিজেকে শুধরে হাজির হয়েছে ক্লাসে। হাজির হলেন না স্যার। মনে মনে স্যারকে শাসিয়ে বলল, ‘কেন ভুল করলেন? কেন ক্লাসে এলেন না আজ?’ চৈতালির আত্মগত প্রশ্ন শুনে মনের আকাশের তারারা খসে পড়তে লাগল; সুদূর আকাশ থেকে ঝরে পড়ল নীরব শূন্যতার ভেতর। চারপাশে আঁধার জেগে উঠেছে মনে হলেও নিজের অন্তর্লোকের আলোয় জ্বলে উঠে ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করে স্যারের উদ্দেশে টেক্সট লিখল, ‘আই অ্যাম সরি স্যার। প্লিজ ডোন্ট মিস, টেক ইয়োর শিডিউলড ক্লাস নাউ।’ টেক্সটি সেন্ড করে দিল।

শিপ্রা মণ্ডল বললেন, ‘জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন সুমন ভাই। ওনার ক্লাসটা আমি নিচ্ছি। আমার আগামী দিনের ক্লাস উনি নেবেন। ঠিক আছে?’

ম্যাডামের কথা শুনে চারপাশে আবার গুঞ্জনা জেগে উঠল। সায়ন্তনী শক্ত করে ধরে আছে চৈতালির হাত। এ হাতে বিশ্বাসের ছোঁয়া পেয়ে ফিসফিস করে চৈতালি বলল, ‘দেখিস, সুমন স্যার ক্লাসে আসবেন। আই অ্যাম শিওর।’

থেমে গেল চৈতালির আত্মপ্রত্যয়ী কণ্ঠ।

শিপ্রা মণ্ডল বললেন, ‘আজ তোমাদের উচ্চারণের ওপর ক্লাস নেব। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে তোমাদের বেশ উন্নতি দেখেছি। কিন্তু আজ ক্রিয়াপদে ‘ও’-কার নিয়ে আলোচনা করব। সব ক্ষেত্রে ‘ও’-কার দিয়ে ক্রিয়াপদের শেষ বর্ণ লেখার ব্যাকরণগত কোনো সমর্থন নেই। এ-জাতীয় অপ্রয়োজনীয় ‘ও’-কার বর্জন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী লিখতে হবে: করছ, করেছ, করছিল, করেছিল, করত, করব, করাব। একইভাবে লিখতে হবে: আছ, গেল, ছিল, এল, হব, খেত, যেত, পাব, দিল, নিল, দেব। ‘আসল’ না লিখে লিখতে হবে ‘এল’। অবশ্য বেশি প্রচলিত শব্দের ক্ষেত্রে এবং অর্থবিভ্রাট এড়ানোর জন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে। যেমন: হতো, হলো ইত্যাদি। উচ্চারণের সময় ঊহ্য বর্ণগুলোর বিষয় মাথায় থাকলে উচ্চারণবিভ্রাট হবে না। ম্যাডামের কথাগুলো মাথায় ঢুকছিল না। কঠিন থেকে কঠিনতর মনে হচ্ছিল আলোচ্য বিষয়। নিভে যাচ্ছিল মনের আলো। বিষাদে ডুবে যাচ্ছিল মন। স্যার এলেন না। পাত্তা দিলেন না পাঠানো এসএমএসটিকে! ভাবনায় ছেদ পড়ল। আকস্মিক নেচে উঠল চৈতালির চোখ। ক্লাসরুমে আচমকা যেন জ্বলে উঠেছে কয়েক হাজার বাল্ব। চৈতালি দেখল, শ্রেণিকক্ষে ঢুকেছেন সুমন স্যার। স্যারকে ম্লান লাগছে না। প্রতিদিনের মতোই ঘোষণা ছাড়াই ঘোষণা করলেন নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি। শিপ্রা মণ্ডলের উদ্দেশে বললেন, ‘জরুরি কাজটা শেষ করে ফেলেছি। শিডিউলড ক্লাসটা নিতে পারব আমি। ক্যান আই টেক দ্য ক্লাস?’

শিপ্রা মণ্ডল জবাব দিলেন, ‘শিওর, সুমন ভাই।’ হাস্যোজ্জ্বল সুমন ভাইকে দেখে তাঁর মনও খুশি হয়ে গেল। ক্লাস ত্যাগ করলেন হাসিমুখে।

শিপ্রা ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়াল চৈতালি। উদ্ধত গলায় বলল, ‘আমার একটা বিশেষ অনুরোধ আছে, স্যার!’

চৈতালির দীপ্ত দেহভঙ্গিমা আর উদ্ধত স্বর শুনে ক্লাসের সব কটি চোখ আছড়ে পড়ল তার ওপর। চৈতালি অনুভব করল, ঈর্ষাগ্রস্ত চোখগুলোর চেতন কিংবা অবচেতন লেহন বিষ ঢেলে দিতে পারেনি তার দেহে। আরও জ্বলে উঠে বলল, ‘মনের বিকৃতি কীভাবে কণ্ঠের বিকৃতি ঘটায়, উচ্চারণবিভ্রাট ঘটায়, শুনতে চাই স্যার। ঘটনা বিশ্লেষণে মনের মূল্যায়নের সঙ্গে উচ্চারণের অশুদ্ধতার লিংকটা ধরিয়ে দিন, প্লিজ।’

পুরো ক্লাসে জেগে উঠল পিনপতন নিস্তব্ধতা। চৈতালি অনুভব করল, চারপাশের সব কটি চোখের আলো নিভে গেছে; কেবলই জ্বলজ্বল করছে সুমন স্যারের চোখের আলো। ওই আলোকবিম ঢুকে যাচ্ছে চোখ দিয়ে নিজ মস্তিষ্কের কোষে কোষে। চৈতালির মন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হতে লাগল, চেয়ারে না বসে তাকাল স্যারের মুখের দিকে। এ তাকানোর মধ্যে আছে ক্ষমাপ্রার্থীর বিনম্র শ্রদ্ধা।

সুমন চৌধুরীর অনুভবের পুরো স্তর নাড়া খেল। চৈতালিকে নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলেন তিনি। মিষ্টিকণ্ঠী গানের পাখিটি বিষের ঠোক্কর দিয়েছিল দেহ-মনে। এখন মনে হলো নীলকণ্ঠ পাখি বিরল স্বরে ডাকছে তাকে; দেহের বিষ শুষে নিয়ে ঢেলে দিচ্ছে অমৃতসুধা, অমৃতস্বর। এই স্বর ছড়িয়ে যাচ্ছে অসীম শূন্যে, বিশ্ব চরাচরে...

মনের হারমোনিয়ামে বেজে উঠল:

তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধাইছে—

রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে

অসীম আকাশ নীলশতদল তোমার কিরণে সদা ঢলঢল,

তোমার অমৃতসাগর-মাঝারে ভাসিছে অবিরামে।

উপদেষ্টা (২০২২–২০২৩), বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ