কোনো নীরব সন্ধ্যায় ঠকঠক আনন্দ

কাশ্মীরের বিখ্যাত ডাল লেক
ছবি: এএফপি

এক মহাপুরুষ ঘর ছেড়েছিলেন পূর্ণিমা রাতে। তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছিল এই জগৎ–সংসার। আমরাও এক শীতের রাতে ঘর ছেড়েছিলাম। তবে আমাদের কাছে কোনো কিছু তুচ্ছ মনে হয়নি। আর সেটি কোনো পূর্ণিমা রাতও ছিল না। বরং বাসা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা ছিল, কোনো সমস্যা হয় কি না।

সেদিনের গন্তব্য ছিল কাশ্মীর। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের এক যাত্রা। ঢাকা থেকে আকাশপথে দিল্লি। তারপর এক অপরাহ্নে এখানে আসা। বিমান থেকে নেমে কাশ্মীরের ঘন কুয়াশায় ধূসর প্রকৃতিতে প্রথম পা রাখা। তীব্র শীতে প্রায় জমে যাওয়ার অবস্থা।

বিমানের রানওয়েতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল গাড়ি। এত ঠান্ডায় বাইরে থাকার কারও অভ্যাস নেই। সবাই দ্রুত গাড়িতে উঠল। তারপর শিশিরভেজা আলো–আঁধারি সন্ধ্যায় কাশ্মীরের এক লেকের পাড়ে নামতে হলো। জীবনের কত সকাল-সন্ধ্যা চলে গেছে, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটা মনে থাকবে চিরকাল। প্রায় শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় নীরব কোনো সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে আছি কোথাও। এমন সন্ধ্যা আসেনি কখনো।

আমাদের এক দলনেতা আছেন। তিনি বলেছেন, কারও চিন্তা করার দরকার নেই। সব চিন্তা তাঁর। অন্যদের কাজ শুধু আনন্দ করা। এদিকে তীব্র শীত নিয়ে চারদিকে নেমে এসেছে রাত। কেউ জানি না, কেন একটি লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর কতক্ষণই বা থাকতে হবে। কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে প্রকৃতি। অল্প দূরের কিছুও দেখা যায় না। দলনেতা বলেছেন, সদস্যদের কাজ শুধু আনন্দ করা। নিদারুণ শীতে সবাই ঠকঠক করে আনন্দ করছি। জানি না কত সময় আনন্দ করতে হবে। একসময় দুটো নৌকা এল। নৌকার ছাদ আছে। বিভিন্ন রঙে সাজানো। এখানকার মানুষ নৌকাকে বলে ‘শিকারা’। শিকারায় ভেসে একটি ঘরে উপনীত হলাম। এ যেন এক নান্দনিক প্রাসাদ! আসলে এটা একটা ভাসমান নৌকা। অনেকটা আমাদের দেশের পানসি নৌকার মতো।

হাউসবোট থেকে ডাল লেকের দৃশ্য উপভোগ করা যায়
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ভারতবর্ষে একসময় ইংরেজরা রাজত্ব করেছে। অবকাশ বিনোদনে তারা এই লেকে আসত। লেকের এই পানসিকে বলত হাউসবোট। সেই থেকে এই নৌকা হাউসবোট নামে পরিচিত। শিকারা থেকে নেমে সুন্দর সিঁড়ি দিয়ে হাউসবোটে উঠতে হয়। উঠেই একটা সুন্দর খোলা জায়গা। সেখানে সোফা আছে। আছে ফায়ার প্লেস। চুল্লিতে আগুন জ্বলে। প্রায় শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে দলনেতা ছাড়া সবার রক্ত জমে যাওয়ার অবস্থা। দলনেতার নাকি রাজা-বাদশাহর রক্ত। সহজে জমে না। ফায়ার প্লেস ঘিরে সবাই জড়ো হলো। জীবনে তাপ-উত্তাপ কত জরুরি, এই প্রথম অনুভব করছি। দলনেতা ছাড়া সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। গবেষণা ছাড়া তাঁর আনন্দ-বেদনা বোঝা যায় না। তবে তিনি চান, সবাই যেন আনন্দ করে। এর জন্য যা করা দরকার, তার সবই করছেন।

চলবে….