স্বপ্নচারিণী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এক.
দীর্ঘদিন পর নয়ন বাড়ি ফিরে দেখে, মা কোহিনুর বেগমের শরীর ও চেহারায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। চলাফেরায়, কথাবার্তায় খুব নমনীয় ভাব; আগের মতো দাপটের সঙ্গে রেগে কথা বলেন না। এককালে খুবই তেজদীপ্ত নারী ছিলেন। রূপ-গুণ আর চাতুর্যের মোহে পড়ে বিয়ে করেছিলেন নয়নের বাবা। কোহিনুর বেগমের সে স্বভাব এখন আর নেই।

ইদানীং ছেলেমেয়ের সঙ্গে অকপট সব কথা বলেন এবং সুযোগ পেলে সুখ-দুঃখের গল্প ফেঁদে বসেন। যদিও নয়ন-মিতু ছোটবেলায় মায়ের অনুশাসন ও চোখরাঙানিতে বড় হয়েছে। এখন বেশির ভাগ সময় মুখে চিন্তার চাপ রেখে কথা বলেন তিনি। নয়নের মায়ের চোখেমুখে সেই ঝাঁজ কমে এসেছে, এখন বিষণ্নতায় কেমন বিমর্ষ দেখায় তাঁকে।

নয়নকে নিয়ে কোহিনুর বেগম বিশেষ ভাবেন না। কিন্তু মিতুর উপযুক্ত বয়স হওয়ার পর থেকে তাঁর মাথায় রাজ্যের চিন্তা ভর করে আছে। একসময়ের অসম সাহসী নারী, যিনি কিনা সংসারে সঙের মতো খেটেছেন, তিনি এখন অল্পতে হাঁপিয়ে ওঠেন।

উৎসর্গের পৃষ্ঠায় মেয়েলি হাতের লেখাগুলো এখনো জীবন্ত। লালের ছিটা লাগা পৃষ্ঠাগুলো কেমন মলিন দেখাচ্ছে, তবু স্পষ্ট।

অকাল বৈশাখী ঝড়ের মুখে মা পাখি যেমন বাচ্চাদের রক্ষা করে, ঠিক তেমনি একাই নয়ন-মিতুকে মানুষ করেছেন কোহিনুর বেগম। সন্তান বড় হওয়ার পর থেকে তিনি ধীরে ধীরে সাহস ও শক্তি হারাতে বসেছেন। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে এবং তাদের সংসারের দায়িত্বজ্ঞান বেড়েছে, সঙ্গে তৈরি হয়েছে একটা আলাদা জগৎ; যেখানটায় সূচনা হয়েছে তাদের একান্তই বসবাস। এভাবে দিনকে দিন নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে নিচ্ছেন কোহিনুর বেগম।

দুই.
লেখাপড়ার পাশাপাশি শহরের একটা বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে চাকরি করছে নয়ন। ব্যস্ততা ও ছুটির কারণে দীর্ঘদিন বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয় না তার। মা কোহিনুর বেগম আর ছোট বোন মিতুকে দেখেনি অনেক দিন। এই ঈদে দীর্ঘ ছুটি পেয়েছে নয়ন। পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাবে বলে খুবই উৎফুল্ল সে। সেই সঙ্গে বাড়িঘরের কিছুটা সংস্কার করবে, তাই অযথা বাড়তি খরচও কমাল।

দাদার আমলের বাড়িটিতে পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে, ছাদ চুইয়ে পানি ঢুকছে ভেতরে। সারা অঙ্গে ব্যথার মতো দশা। জীর্ণশীর্ণ একতলা পোড়োবাড়িতে থাকেন মা ও ছোট বোন। মিতুরা এই ভিটেমাটি আলোকিত করে আছে যেন। তবু নয়ন পড়ালেখা, চাকরিবাকরির নাকানিচুবানিতে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে আসে স্মৃতিময় পাঁচিলে ঘেরা এই জঙ্গলাকীর্ণ ভিটায়।

সন্ধ্যার পর ভরা জ্যোৎস্নায় চারপাশ বেশ উজ্জ্বল। নয়ন ভেবে রেখেছে, মিতুদের সঙ্গে আজ আড্ডা জমাবে খুব। ভাবল, সঙ্গে একটা গল্পের বই পড়লে মন্দ হয় না। অনেক দিন পর আধভাঙা বইয়ের তাকের বইগুলো সমাদরে একটার পর একটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখল সে। বেশ কটা গল্প, উপন্যাসের পৃষ্ঠাগুলো মলাটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কালিদাস পণ্ডিতের ‘ধাঁধার ঝুলি’; রুলটানা কয়েকটা খাতায় পুরোনো দিনের জনপ্রিয় আঞ্চলিক গান। কাঠের এই পুরোনো তাকে বইগুলো বছরের পর বছর পড়ে আছে নির্বাক হয়ে। কিছু বই বয়সের ভারে মলিন আর কিছু ///উইপোকার দখলে। খুঁজতে খুঁজতে একটা বই নয়নের চোখে আটকে গেল; ‘ভালোবাসা, প্রেম নয়’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসটি তুলে নিয়ে নিঃশব্দে খুব আগ্রহভরে দেখছে সে।

বইগুলোর যত্ন করার কেউ নেই। মিতুরও সাহিত্যচর্চার প্রতি ঝোঁক নেই। কোহিনুর বেগমও বাড়ির এদিকটায় তেমন আসেন না। সারা দিন এটা-ওটা করে, ব্যস্ততার মতো দিন কাটে তাঁর। বাড়িতে এলে মাঝেমধ্যে নয়ন পরম সমাদরে বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখে। আর বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে বাবার স্মৃতিগন্ধ লুকিয়ে শোঁকে। হারানো স্মৃতি কুড়ানোর চেষ্টা করে ভীষণ মন খারাপ হয় নয়নের। কল্পনার ক্যানভাসে বাবার ছবির দৃশ্যপট রচনার চেষ্টা করে, কিন্তু সময়ের ধূসরতায় কল্পলোকে রংতুলির আঁচড় লাগাতে পারে না। চিন্তার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ভাবে সেই ভয়াল রোগের কথা; হাঁটুতে ফোঁড়ার অপারেশনের পর ইনফেকশনে নয়নের বাবার মৃত্যু হয়। নয়ন ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে, কী নিষ্ঠুরতম সময়! মানুষ আপন মানুষের প্রতিচ্ছবিকেও এভাবে ভুলে যায়! বাবার আলো-আঁধারি স্মৃতি মনে পড়ে তার। ঠিক স্মৃতি নয়, মায়ের মুখে শুনতে শুনতে হৃদয়ে একটা স্মৃতির অবয়ব তৈরি হয়েছে। এই বারো বছরে পৃথিবীতে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু বাবাকে কাছে পাওয়ার আকুতিটার একটুও পরিবর্তন হয়নি নয়নের। আধা ভাঙা কাঠের তাকে নয়ন বাবার স্মৃতির অনুসন্ধান করতে থাকে, সেখানে ছেঁড়াফাটা কাগজপত্র ছাড়া বিশেষ কিছু নেই।

তিন.
বই হাতে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নয়ন ছাদে উঠে এসে কাঠের চেয়ারে তন্ময় হয়ে বসেছে গা এলিয়ে। ফুরফুরে বাতাসে আশৈশবের কত কী যে মনে পড়ছে তার! স্মৃতিকাতরতায় চোখ বুজে আসে; থালার মতো গোলগাল চাঁদ কেমন উজ্জ্বল হয়ে আলো দিচ্ছে, সেদিকে মোটেও খেয়াল নেই নয়নের। হঠাৎ একটা পেঁচা সশব্দ উড়ে গিয়ে সুপারিবাগানে বসলে ঘোর ভাঙে। বাড়ির ভেতর থেকে হাঁকডাক আসে মায়ের; তখনো নয়ন বইয়ের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে বসে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে।

নয়নের মা ডাকতে ডাকতে ছাদে এসে চকিত গলায় বললেন, ‘নয়ন, এখনো এখানে বসে আছিস, বাবা?’ নয়ন ভারী গলায় উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ মা, বইটা পড়ছিলাম।’ একটু চুপ থেকে পরক্ষণেই মায়ের কাছে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা মা, বাবার নামে এই বই কে উপহার দিয়েছিল?’ কোহিনুর বেগম চুপিসারে আহত মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন ঋজু ভঙ্গিতে।

উৎসর্গের পৃষ্ঠায় মেয়েলি হাতের লেখাগুলো এখনো জীবন্ত। লালের ছিটা লাগা পৃষ্ঠাগুলো কেমন মলিন দেখাচ্ছে, তবু স্পষ্ট। ’৯১ সালে নয়নের বাবার বয়স বড়জোর সতেরো কি আঠারো। তখন বাবার নামে বইটি উপহার দিয়েছিল কেউ একজন ‘দিলজান’ ছদ্মনামে। বইটি পরম যত্নে ছিল এতদিন। নয়ন ভাবনার গভীরে তলিয়ে ভাবতে থাকে, দিলজান নামের মহিলাটি কে হতে পারে?

বইয়ের লেখাটি দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি কোহিনুর বেগম। মুহূর্তেই তাঁর মুখ ছেয়ে যায় বিষণ্নতায়। লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোহিনুর বেগমের চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। মায়ের কান্না সংক্রমিত হয়ে নয়নের চোখকেও আর্দ্র করে তোলে। বাবার শোকে তার হৃদয়ও ভার হয়। নয়নের বুঝতে বাকি থাকে না, তার বাবার স্বপ্নচারিণী কিশোরী দিলজানই মা কোহিনুর বেগম। তখনো লেখাটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কোহিনুর বেগমের দিকে।

‘নাসির,

উপন্যাসের নায়কের মধ্যে কোথাও যেন তোমাকে খুঁজে পেলাম। তবে জীবনে চলার পথে মুদ্রার অন্য পিঠটাকেও সঙ্গে রেখো। তুমি তো জানো, মানুষ একা পথ চলতে গিয়ে একাকিত্ব বোধ করে অবসন্নতাকে সঙ্গী করে নেয়। আমি কখনোই চাই না, তুমি একা হাঁটো। হাঁটতে গিয়ে অদৃশ্য হাতটিকে শক্ত করে ধরবে, তবে পদস্খলিত হবে না...।

ইতি, দিলজান
৭/১২/৯১’

বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা