শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে। প্রকৃতি সবেমাত্র তার নতুন রূপে সাজতে শুরু করেছে। মধুর খোঁজে মৌমাছির লোভাতুর চাহনি, কোকিলের কুহুতান, স্নিগ্ধ ফুলের সুবাস—সবকিছু কেমন জানি আজ বিষণ্ন লাগছে। সহকারীকে বলে দিয়েছি রোগীর সিরিয়াল নেওয়া বন্ধ রাখতে। তাই আজ চেম্বারে রোগীর চাপ নেই।
একজন ভদ্র মহিলা এক বয়স্ক লোককে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। সহকারী আমার অনুমতি না পেয়ে তাঁদেরকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রেখেছে। আমার জন্ম সাল দুইটি। মানে আমি দুবার জন্মগ্রহণ করেছি! প্রথমবার যখন জন্মগ্রহণ করেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল শূন্য বছর, শূন্য মাস, শূন্য দিন। মা-বাবাসহ সবাই খুশিতে আত্মহারা। বিশাল আয়োজন করে আমার নাম রাখা হলো। দাদু-ঠাকুমা সবাই এলেন। মায়ের মুখ থেকে শুনেছি তাঁরা আমার জন্য অনেক উপহারও নিয়ে এসেছিলেন।
আর দ্বিতীয়বার যখন জন্মগ্রহণ করেছি, তখন কাকতালীয়ভাবে আমার বয়স হলো সতেরো বছর, এগারো মাস, ত্রিশ দিন। তখন বড় কোনো আয়োজন ছিল না। ছিল না হাজারখানেক অতিথিও। সেদিনও ঠাকুমা-ঠাকুদাদু এসেছিলেন। তবে অনুষ্ঠানে নয়, তাঁরা এসেছিলেন আমাকে সান্ত্বনা দিতে। তাঁদের কাছে আমাকে নিয়ে যেতে। সে সময় বাবা ছিলেন না পাশে। মা ছিলেন। তিনি সেদিন কোনো কথা বলেননি। একদম চুপচাপ। একবার ফিরেও তাকালেন না। আমি তো কোনো অপরাধ করিনি।
আমার জীবন বড় অদ্ভুত। অনেক সুন্দর একটা পরিবার ছিল। মা-বাবা আর তাঁদের আদরের একমাত্র সন্তান নিয়ে তাঁরা বেশ সুখী। আমাকে নিয়ে যত আয়োজন। রোজ বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার জন্য যখন মা ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন, তখন বায়না ধরতাম স্কুলে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু মা এক একটা মজার জিনিসের লোভ দেখিয়ে ঠিকই স্কুলে পাঠাতেন। অনেক যত্নে তৈরি করে দিতেন টিফিন। বাবা অফিস শেষে হাতভর্তি করে নিয়ে আসতেন প্রিয় জিনিসগুলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাবার গলা জড়িয়ে কপালে চুমু খেতাম। ছুটির দিনে বাবা-মেয়ে ঘুরতে গিয়ে কত যে মজা করতাম তার কোনো হিসাব নেই! পরিবারে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। আমিও ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। একটা সময় পর মাঝেমধ্যে মাকে কেমন জানি বিষণ্ন দেখতাম। বাবাও পাল্টে গেলেন। মা-বাবার ঝগড়া শুরু হলে শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখতাম না। একটা সময় সেই ঝগড়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখতাম।
কী কারণে তাঁদের এমন আচরণ কিছুই বুঝতাম না। বাবা কথায় কথায় মাকে বলতেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে সংসার করতে না চাইলে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও।’ মা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতেন, ‘তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করাটাই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।’
বাবা রেগে গিয়ে মায়ের গায়ে হাত তুললে তিনি কোনো প্রতিরোধই করতেন না। বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করে বাবাকে হাতজোড় করে বলতেন, ‘তুমি আগের মতো হয়ে যাও।’
মায়ের অনুরোধ কানেই তুলতেন না বাবা। মা এত কিছুর পরও বাবার বিরুদ্ধে কারও কাছে কোনো দিন নালিশ করেননি। শুধু দেখতাম মা মনমরা হয়ে বসে আছেন অথবা মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। আবার হঠাৎ হঠাৎ দেখতাম ভগবানের উদ্দেশে কী যেন বলছেন। বাবার প্রতি মায়ের এমন ভালোবাসা দেখে অবাক হতাম। কিন্তু মায়ের প্রতি এমন অবহেলা দেখে বাবার প্রতি তখন আমার ছোট্ট মনে একধরনের ঘৃণা জন্মাতে লাগল। ভাবতাম এটাই কি আমার সেই বাবা! ধীরে ধীরে তিনি নেশার প্রতি চরমভাবে আসক্ত হয়ে পড়লেন। মায়ের ওপর শারীরিক নির্যাতনও বেড়ে গেল।
মামার বাড়িতে ঠাঁই হলো আমাদের। এমনও দিন-মাস গেছে, বাবা একবারও আমাকে দেখতে আসেননি। খোঁজখবর নেননি। তবু মা আমার কথা ভেবে খুব করে চাইতেন সংসারটা টিকিয়ে রাখতে। নিয়তি বলে একটা বিষয় আছে, যা কেউ চাইলেও এড়াতে পারে না। বাবার চেহারা ধীরে ধীরে ভুলে যেতে লাগলাম। ঠিক যেভাবে বাবাও ভুলে গেলেন আমাকে। মা মরে গিয়ে বেঁচে থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনলেন তাঁর প্রিয় স্বামীর জন্য। কিন্তু বাবা, মায়ের সেই ভালোবাসার প্রতিদানে কিছুই দেননি। মা যখন জানতে পারলেন তাঁর প্রিয় মানুষটি দ্বিতীয় সংসার শুরু করেছেন, তখন তিনি আমার আঠারো বছর পূর্ণ না হওয়া অবধি অপেক্ষা করলেন। তিলে তিলে আমাকে গড়ে তুললেন। যেদিন আমি আঠারোতে পা রাখব, এর আগের দিনই মা ফুলের মতো স্নিগ্ধ চোখ দুটি মেলে আর তাকালেন না। সেদিন পাগলের মতো মাকে অনেকবার ডেকেছি। কপালে হাজারখানেক চুমুর পরশ বুলিয়ে দিয়ে হৃৎপিণ্ডে হাত রেখে পরখ করে দেখেছি। যদি একবার মায়ের হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করে উঠে সেই আশায়! এরপর কাকতালীয়ভাবে দ্বিতীয়বার জন্ম হলো আমার।
নিয়তির খেলায় আজ আমি বসে আছি আমার চেম্বারে। সহকারীকে বললাম বয়স্ক লোক আর ভদ্র মহিলাকে চেম্বারে নিয়ে আসার জন্য। লোকটি চেম্বারে ঢুকতেই টেবিলের ওপর কাচের ফ্রেমে বাঁধানো মায়ের স্নিগ্ধ মুখের ছবিটি দেখে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। একবারও সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না, ‘উনি আপনার কী হন?’