একাত্তরের চিঠি

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

১৯৭১ সাল। আশ্বিনের অমাবস্যার রাতে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁঝিঁর শব্দে অন্ধকারের রং যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠছে। পুকুরপাড়ে কচুরিপানার ঝোপে একটি ডাহুক টানা ডেকেই চলছে। হেমন্তের শুরুতেই গ্রামে শীত পড়েছে। রাতের দ্বিপ্রহর কেটে গেলেও ঘুমহীন জেগে বসে আছে পারুল। সারা রাত হাত দুটো ধরে মায়াভরা করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রিয়তম স্বামীর দিকে।

চার মাস আগেই তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরপর ঢাকায় স্বামীর কর্মস্থলের পাশেই ভাড়া বাসায় সংসার পেতেছিল তারা। সারা দিন অফিস করে সামাদ বাসায় ফিরলে উত্তরের বারান্দায় বসে দুজন গল্প করতে করতে চা খেত। পুবের জানালা খুলে বসে তারাভরা আকাশে চেয়ে থেকে কথা–কবিতায় রাত কাটিয়ে ভোরের দিকে ঘুমাত। নতুন বিয়ে, নতুন সংসারে সারাক্ষণই সুখ–তৃপ্তির মগ্নতায় ডুবে থাকত পারুল। সামাদও নিখাদ প্রেমের সুবাসে মোড়ানো কামনায় সুবাসিত করে রাখত স্ত্রীকে। প্রগাঢ় ভালোবাসায় মত্ত নবদম্পতির জীবনের বাঁক হঠাৎ থমকে যায় বিয়ের মাত্র চার মাসের মধ্যেই।

নাতনিরা ঘুমিয়ে পড়লে খাটের নিচ থেকে টিনের বাক্সটা টেনে বের করে পারুল। বাক্সটা খুলে পুরোনো ডায়েরিটা বের করে।

শহরের অবস্থা খুব খারাপ। চারদিকে জলপাই রঙের ট্যাংক টহল দিচ্ছে দিনের বিভিন্ন সময়ে। আশপাশে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। চারদিকে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। এটা শুরু হয় ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের পর থেকেই।

শহরে গন্ডগোল বেশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় শাশুড়ির জোরাজুরিতে সপ্তাহখানেক হলো তারা গ্রামে চলে এসেছে। এর মধ্যেই গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গী হয়ে সামাদ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। শাশুড়ি বারবার ছেলেকে বুঝিয়ে বলছেন, ‘বউমা দুই মাসের গর্ভবতী। কখন কী হয় কে জানে! এমন সময়ে তুই কোথাও যাসনে বাবা! আমি বুড়ো মানুষ, এই যুদ্ধকালে কী থেকে কী সামলাব, বল? বাড়িতে একটা পুরুষ মানুষ নেই। আমরা বউ-শাশুড়ি একা এই নির্জন বাড়িতে কী করে থাকব? তুই বরং সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে অন্যভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা কর।’

কিন্তু সামাদ কারও কোনো কথাই কানে তোলে না। এক কথা, সে যুদ্ধে যাবেই। দেশের এই সংকটকালে মা ও স্ত্রীর কথা ভেবে ঘরে বসে থাকতে পারবে না। একদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে পারুলের চোখের পানি মুছে দিয়ে, দেশকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করার ব্রত নিয়ে সামাদ ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে মুক্তির চেতনা বুকে নিয়ে।

২০২৩ সাল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতেও তেমন শীত নেই ঢাকা শহরে। চারদিকে বিজয় দিবস উদ্‌যাপনের উৎসবমুখর পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ২০ বছরের যমজ দুই নাতনি বেলি আর কলিকে তাদের রুমে বসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছে পারুল। নাতনিরা গর্ব করে দাদির কাছে আবদার করে, ‘দিদা! আমাদের দাদাজানও তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দাদাজানের গল্প বলো না কেন?’

হঠাৎ পারুলের গলা ধরে আসে। চোখের কোণ ভিজে উঠে। অশ্রু লুকিয়ে নাতনিদের বলে, ‘আজ ঘুমিয়ে পড়ো, দাদুমণিরা। আগামীকাল আবার তোমাদের নতুন কোনো গল্প শোনাব।’

নাতনিরা ঘুমিয়ে পড়লে খাটের নিচ থেকে টিনের বাক্সটা টেনে বের করে পারুল। বাক্সটা খুলে পুরোনো ডায়েরিটা বের করে। শাড়ির আঁচলে চশমার গ্লাস পরিষ্কার করে ডায়েরিটা নিয়ে ব্যালকনিতে বসে সে। পাছে নাতনিদের ঘুম না ভেঙে যায়! সতর্কতার সঙ্গে বারান্দার দরজাটা চাপিয়ে দেয়। লাইট জ্বেলে ডায়েরির ভাঁজ থেকে চিঠি দুটি বের করে আলতো হাত বুলায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কখনোই চিঠি দুটি পারুল পুরোপুরি পড়তে পারেনি। চিঠি খুলে বসলেই চোখ উপচে অশ্রুর ঢল নামে। শুধু কিছুক্ষণ হাত বুলিয়েই তৃপ্ত হয়।

যুদ্ধ চলাকালে সামাদ গ্রামের এক বন্ধুর হাতে প্রথম চিঠিটা পাঠিয়েছিল। পরের চিঠিটা পারুল হাতে পেয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই মাস পর। একজন এসে তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বলেছিল, কোনো এক অপারেশন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয় সামাদ। মৃত্যুর আগমুহূর্তে সহযোদ্ধার হাতে রক্তমাখা চিঠিটা দিয়ে আকুতি করে বলেছিল, ‘আমার পারুলের কাছে পৌঁছে দিয়ো...ভাই!’

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে পারুলের ছেলের জন্ম হয়। শখ করে নাম রাখে স্বাধীন। সে ইচ্ছা করেই ছেলের এই নাম রেখেছিল। ভেবেছিল, সামাদ খুশি হবে। পারুলের শাশুড়ি সারাক্ষণ নাতিকে আগলে রাখে ছেলের আমানত ভেবে। সারা দিন যত্ন করে। সামাদের গল্প শোনায় দুই মাসের শিশুকে। শিশু স্বাধীন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে দাদির দিকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই মারা যায় শাশুড়ি। ছেলের না–ফেরার শোক সইতে পারেনি বৃদ্ধ মা। পারুল একদমই একা হয়ে যায়। পরে গ্রামের একটি স্কুলে চাকরি করে ছেলেকে একাই মানুষ করেছে সে।

হঠাৎ ছেলে স্বাধীনের ডাকে পারুলের স্মৃতির দুয়ারে যেন পর্দা টেনে যায়। ভাবনায় ছেদ পড়ে। ‘মা, কোথায় তুমি?’
‘এই তো বাবা, কেন ডাকছিস? আমি বারান্দায়।’
‘শীতের মধ্যে বারান্দায় বসেছ যে! ঠান্ডা লাগবে।’
ছেলের ডাক শুনে কৌশলে ডায়েরিটা আঁচলতলে লুকিয়ে ফেলে পারুল। কিন্তু ছেলের চোখ এড়াতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই মাকে দেখছে সে। মাঝেমধ্যেই চিঠি দুটি হাতে নিয়ে রাত জেগে বসে থাকে। কান্না করে। তখন স্বাধীনেরও মন খারাপ হয়। তাই আজও সে অভিমানের স্বরেই মাকে বলে,
‘তুমি কেন চিঠিগুলো নিয়ে রাত জেগে বসে থাকো? তোমার বয়স হয়েছে, আগের মতো অনিয়ম কি এখন শরীর সইবে? তা ছাড়া চিঠিগুলো তো মলিন হয়ে গেছে, অক্ষরগুলোও অস্পষ্ট। তুমি পরিষ্কার অক্ষরই চশমা ছাড়া তেমন দেখতে পাও না। আমি জানি, এই চিঠির কিছুই তুমি পড়তে পারো না। অযথাই রাত জেগে শরীর খারাপ করো। উঠো মা, বিছানায় যাও। এমন রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।’

ছেলের কথা শুনে পারুল উত্তর দেয়, ‘তুই ছোটবেলা থেকেই প্রশ্ন করিস, আমি এই অস্পষ্ট চিঠিগুলোতে তাকিয়ে থাকি কেন, কী দেখি? শোন বাবা, আমি এই চিঠিতে আজও তোর বাবাকে দেখতে পাই। গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সামাদের মুখ দেখতে পাই। পলকহীন তাকিয়ে থেকে চিঠি দুটিতে আমি লাল–সবুজের মানচিত্র আঁকা পতাকা দেখি, দেখি বাংলার স্বাধীনতা।’

সেক্টর ১৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা