ছায়ামূর্তি

অলংকরণ: তুলি
দীর্ঘদিন ধরে সৈকত মেম্বার অসৎ উপায়ে প্রাসাদপুর গ্রামে আছে। যত ধরনের নিন্দনীয় কাজ আছে সব তার দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছিল। এলাকার মানুষ থানা–পুলিশ তো দূরের কথা, কেউ তার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করার সাহসই পায় না।

শানবাঁধানো পুকুর। পুকুর ভরা জল। জলের ভেতর মাছ। মাছগুলো গিজগিজ করছে। নীলা বসে আছে জলের ঘাটে। পরনে নীল রঙের শাড়ি। শাড়ির পাড়ে মেঘলা আকাশের জমিন। কপালের ভাঁজে ছোট্ট একটা টিপ। ভ্রু দুটি কাজলে আঁকা। চোখের পাপড়িতে লেগে আছে জলের ছোঁয়া। চুলগুলো খোঁপার বাঁধন খুলে আলগা করে দিল। দূরের হাওয়া বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছে চুলগুলোকে। শান্তশিষ্ট চুলগুলো তার কোনো কথায় শুনছে না আজ। ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। মাছগুলো তাকিয়ে জলকন্যার হাসি দেখছে। সে হাসলে আরও সুন্দর দেখায়। সরু সরু দাঁতগুলো মুক্তোর মতো চিকচিক করে ওঠে। নীলা জমিদারবাড়ির পুকুরপাড়ে দুই পা ডুবিয়ে বসে আছে।
শেফালী বেগম চিৎকার করে বলল, ‘মা নীলা, আর কত জলের মধ্যে বইসে থাকবি। উঠে আয়। পাছে ঠান্ডা জ্বর বাঁধিয়ে ফেলবি।’

নীলার বয়স খুব বেশি না, পনেরো-ষোলে। বাতাবিলেবুর মতন কেবল বুক ফুলে ফেঁপে উঠছে। আজ শাড়ি পরার কারণে তাকে অনেকটাই বড় বড় লাগছে।
সৈকত মেম্বার পুকুরের পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখ পড়ল নীলার দিকে। নীলার ভেজা শাড়ি শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। জল থেকে উঠতেই কোমরের ওপরে একটুখানি শাড়ি সরে গেল। সে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে রইল। নীলা ওপরে উঠল। সে পথ আটকে দাঁড়াল। নীলা বলল, ‘পথ ছাড়েন, আমারে যাইতে দেন। ত্যক্ত করবেন না।’
‘তোরে আমার খুব মনে ধরছে। আমি আজই তোর মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠামু।’
‘আপনের ঘরে তিন তিনটে বউ থাকতে আরও বিয়ে করতে চান? বুড়া হয়ে গেছেন এখনো ভালো হইলেন না, কয়দিন পর মইরে যাইবেন চরিত্রটাও ঠিক করতে পারলেন না!’
হাত ছাড়েন, ছাড়েন কইলাম। চিৎকার দিয়ে লোকজন ডাকমু। সৈকত মেম্বার পথ ছেড়ে দাঁড়াল।
নীলা এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে গেল।

বটতলা বাজার থেকে হাটবাজার করে ফিরছিল রফিক ব্যাপারী। সৈকত মেম্বারকে দূর থেকেই লক্ষ করছিল। কাছে এসে বলল, ‘কী মেম্বার সাহেব, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আশপাশে তো কাউকে দেখতেছি না!’
‘এই যে পুকুরপাড়ে মাছদের একটু খোঁজখবর নিতে আইছিলাম আরকি।’
‘যা–ই করেন মেম্বার সাহেব, দেইখে শুইনে কইরেন। সামনে কিন্তু ইলেকশন। গতবারের মতো এবারও আকাম-কুকাম কইরেন না। পাছে পুরো এলাকায় জুতার মালা...’
রফিক ব্যাপারী কথা শেষ করতে পারল না। রাগে গজগজ করতে করতে মেম্বার বলল, ‘রফিক মিয়া, তোমার কিন্তু খবর আছে। আজ রাতটুকু তোমারে আমি দান করলাম।’
‘তুই আমারে কী করবি মেম্বার? আমি পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে দিমু তোর বদমায়েশি।’
পরদিন ভোরে জমিদারবাড়ির পুকুরে ভেসে উঠল রফিক ব্যাপারীর লাশ।

দীর্ঘদিন ধরে সৈকত মেম্বার অসৎ উপায়ে প্রাসাদপুর গ্রামে আছে। যত ধরনের নিন্দনীয় কাজ আছে সব তার দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছিল। এলাকার মানুষ থানা–পুলিশ তো দূরের কথা, কেউ তার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করার সাহসই পায় না।

রফিক হত্যার দিন দশেক পর। গভীর রাত। সৈকত মেম্বার আর তার কাজের ছেলে হাশমত গেল পুকুরঘাটে। পাশেই নীলাদের ছোট্ট একটা ঘর। আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। দূরে কোথাও খেঁকশিয়াল অনবরত ডেকে যাচ্ছে। গা কাঁপানো সুর। সৈকত মেম্বার হাশমতকে বলল, ‘হাশু, আরেক বোতল দে। পেটে ঢালি।’
‘স্যার, আইজ পেটে বেশি পইড়ে গেছে। আর খাইয়েন না।’
হাশমতের জামার কলার ধরে বলল, ‘হাশু, আজ এত খাইতাছি মাতাল হইতাছি না। কারণ কী জানস? আমার মাতাল হওয়ার জিনিস তো ওই সামনের ঘরে দেহ বিছায়ে শুয়ে আছে। হাহা। ওর কাছে গেলেই আমি মাতাল হয়ে যামু।’ হাসতে হাসতে এলোমেলো করে হাঁটতে লাগল।
‘স্যার আপনে পুকুরে পইড়া যাবেন। আমি বাড়ি নিয়ে যাই। কাঁন্ধে হাত রাখেন।’
‘তুই ছাড় আমারে। আমি মাতাল হইবার চাই।’

সৈকত মেম্বার ঘরের দরজায় ঠকঠক করতে লাগল বারবার। নীলা ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কে? কারে চান? আম্মা ঘরে নাই। পরে আসেন।’
সৈকত মেম্বার চুপ করে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। নীলা দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকে গেল। সে বলল, ‘কী রে, তোর মা কই?’
‘আম্মা ঘরে নাই। বাইরে গেছে। এখনই এসে পড়ব।’
‘গত সোমবারে তোর মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিছিলাম। মুখের ওপর থুতু মাইরে দিছে। আজ তোর মারে কঠিন শিক্ষা দিমু, দ্যাখ।’
সৈকত মেম্বার দেরি না করে নীলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নীলা হাতজোড় করে মাফ চাইল। সে মাফের ধারেকাছেও গেল না। কোনোভাবেই নীলা যখন নিজেকে রক্ষা করতে পারল না, ঠিক তখনই আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার দিল। সৈকত মেম্বার বাঁ হাত দ্বারা নীলার মুখ চেপে ধরার চেষ্টা করল আর ডান হাতে থাকা মদের বোতল দেয়ালে ভেঙে অর্ধেক বোতল ঢুকিয়ে দিল নীলার তলপেটে। নীলা হাউমাউ করে চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে গেল। নীল হয়ে গেল নীলার মুখ। নিস্তেজ হয়ে গেল তার দেহ।
নীলার মায়ের কণ্ঠ শুনে সৈকত মেম্বার দৌড়ে পালিয়ে গেল ঘর থেকে।

বছর পাঁচেক পর। সৈকত মেম্বার বসে আছে বারান্দায় ইজিচেয়ারে। দোল খাচ্ছে আপনমনে। হাশমত চা নিয়ে এসে বলল, ‘স্যার, আকাম-কুকাম যা করছেন আজ থেকে সাফ মনে তওবা করেন। আপনের শরীরের অবস্থা তো দ্যাখতেই পারতেছেন। দিন দিন খারাপ হয়ে যাইতেছে। কখন কী হয় কে জানে। আমি আপনের লগে থাইকে বিরাট পাপ কামাইতাছি। আর না। আজই গ্রামের বাড়িতে চলে যাইতেছি। মাফসাফ কইরে দিয়েন।’
‘এই নেন চা। দ্রুত চা-টা শেষ করেন। চায়ের হায়াত ফুরায়ে গেলে শরবত হয়ে যাইব।’
সৈকত মেম্বার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লেবুতলায়। হাশমতের একটা কথাও তার কানে পৌঁছল না। হাশমত পা বাড়াল রান্নাঘরের দিকে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়তে উড়তে চায়ের হায়াত ফুরিয়ে গেল। সৈকত এক চুমুক দিয়েই মুখ বিকৃত করে কাপ রেখে দিল। ইজিচেয়ারে বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গেল বুঝতেই পারল না।

ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পরপর। চারিদিকে কোনো হইচই নেই। পাখিদের কলরব নেই। সবাই নীরব। হাশমত বিকেলেই হয়তো চলে গেছে। ঘরে বাতি দেওয়া হয় নাই। থাকলে এতক্ষণ ঘরে বাতি জ্বলে উঠত। উঠানের এক পাশেই লেবুতলা। বিশাল বড় লেবুবাগান। লেবুতলায় কয়েকটা ঝিঁঝি পোকা ডেকে যাচ্ছে। কান জ্বালাপোড়া করছে। আকাশে মেঘ জমেছে। কালো মেঘ। চারিদিকে অমাবস্যা রাতের মতো অন্ধকার নেমে এল। প্রচণ্ড হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে সবকিছু।
সৈকত মেম্বার উঠানে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সে একবুক সাহস নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘কে, কে ওখানে? নীলা না? তুই এখনো বাঁইচে আছস?’ ছায়াটা সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল।

ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এল ভয়ংকর হাসির শব্দ। হাসির শব্দ দোল খেতে লাগল সারা বাড়িতে। সৈকত মেম্বার ভয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগল। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সে আয়াতুল কুরসি মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু মনে করতে পারল না। সে দ্রুত বের হতে গিয়ে বারান্দায় পিছলে পড়ে গেল। কয়েকবার ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু উঠতে পারল না। মনে হচ্ছে তার সারা দেহে উঠে বসার শক্তিটুকু আর অবশিষ্ট নেই। পুরো বাড়িটা চরকির মতো চারদিকে ঘুরতে লাগল। তার নাড়িভুঁড়ি পাকিয়ে বমি আসছে। সব গলায় আটকে আছে। এক্ষুনি হয়তো পুরো বারান্দা ভাসিয়ে দেবে। একটু বমি হওয়ার দরকার। বমি হলে তার ভালো লাগত। শরীরটা হালকা লাগত। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। লেবুতলার ঝিঁঝি পোকারা যেন মাথার ভেতর ঢুকে হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙছে। ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল।

মেঝেতে শুয়ে থেকে বমি করার আপ্রাণ চেষ্টা করল। বমির পরিবর্তে রক্ত বের হলো। রক্ত দেখে সে ভড়কে গেল। ইজিচেয়ারে নীলার দোলা খাওয়া দেখে সে ভীষণ ভয় পেল। হাতজোড় করে বারবার ক্ষমা চাইল। কিন্তু...
ক্লান্ত অবসাদ দেহ নিয়ে পড়ে রইল বারান্দায়। খানিক বাদেই তার দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে গেল।

শিক্ষার্থী, বাইতুস সালাম অ্যারাবিক ইউনিভার্সিটি উত্তরা, ঢাকা