মৃত্যু–পরবর্তী জীবন নিয়ে আমাদের কত কৌতূহল। মৃত্যুর পর আমরা কোথায় যাব, কী হবে, আবার জন্ম হবে কি ইত্যাদি প্রশ্নগুলো প্রতিনিয়তই আমাদের মনের মধ্যে আসে। অথচ জীবিত অবস্থার কর্মফলই আমাদের মৃত্যু–পরবর্তী অবস্থা নির্ধারণ করে। কামনাবশত হয়ে আমরা এই জগতের বিষয়–সম্পত্তির ওপর লোভ–লালসা কমাতে পারি না। আবার ঈশ্বরের কাছে স্বর্গ সুখও চাই। সবকিছু তো একসঙ্গে পাওয়া সম্ভব নয়। মানুষ মরে গেলে তার দেহ নষ্ট হলেও আত্মা একই থাকে। সময়, পরিস্থিতি, কর্মফল ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে সেটা আবার নতুন দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আত্মার শুদ্ধতার ওপরই নির্ভর করে মুক্তির। আত্মার মুক্তি হলে জীবকে আর জন্ম নিতে হয় না। আত্মা উচ্চস্তরে চলে গেলে আর জন্ম নেয় না। বারবার জন্ম নেয় নিম্নস্তরে থাকা আত্মারা।
‘দেবযান’ উপন্যাসে পুষ্প, যতীন, আশা ইত্যাদি প্রধান চরিত্র ছাড়াও অন্য চরিত্রের মাধ্যমে লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুর পর জীবের জীবনধারণ, চিন্তাচেতনা কেমন হয় তার কাল্পনিক একটা রূপরেখা তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন ধর্মে একেকভাবে মৃত্যু–পরবর্তী রূপ তুলে ধরা হয়েছে। এই গল্পেও ঠিক সে রকম একটা নিজস্ব মতামত উঠে এসেছে। মৃত্যুর আগে ও পরে মায়া বলে মানুষ কী কী কাজ করে থাকে, তার অনেকটা সংক্ষিপ্ত রূপ ফুটে উঠেছে এই লেখার মধ্য দিয়ে।
যতীন একা একা মারা যায় তার নিজ ঘরে। পুষ্প অনেক আগেই রোগে মারা যায়। পবিত্র আত্মা বলে সে সাতটা স্তরের মধ্যে তৃতীয় স্তরে এসেছে। পুষ্প তার নিজের ক্ষমতাবলে যতীনকে নিজের চিন্তার পরিবেশে এনে রেখেছে। মৃত্যুর পর আত্মা তার নিজের চিন্তাশক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট পরিবেশে থাকতে পারে। যেমন এখানে পুষ্প তার স্মৃতিশক্তির সঙ্গে চিন্তা সমন্বয় করে গঙ্গার ঘাট ও বুড়ো শিবতলার ঘাট তৈরি করে রেখেছে। ইচ্ছেমতো সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত করতে পারে। যতীনের প্রথম প্রথম অন্য রকম মনে হলেও পরে সে সব বুঝতে পারে।
যতীন প্রায়ই তার স্ত্রী আশার অবস্থা দেখার জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে। এতে তার আত্মার মুক্তি তো হয়ই না, বরং সে আবার নতুন করে পুনর্জন্ম লাভ করে। পুষ্প নিষেধ করলেও লাভ হয় না। যতীন বারবার পৃথিবীতে আসতে চায়। এই হলো মায়া, জগতের মায়া কাটানো বড় দায়। নিম্নস্তরের আত্মাগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। তারা এই মায়া, মোহ ত্যাগ করতে পারে না বলেই উচ্চস্তরে যেতে পারে না। তাদের নরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
দেবদেবীর সন্ধানও পাওয়া যায় এই মৃত্যু–পরবর্তী জীবনে। কত সাধন পথের পথ ও পথিকের সম্পর্কে জানা যায়। ভাগ্য ভালো ও আত্মা উচ্চস্তরের হলে তাদের সাক্ষাৎও পাওয়া যায়। গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ, আলোকরশ্মি ইত্যাদি নানা জগতের রূপরেখা উঠে এসেছে গল্পের নানা ধাপে।
অবশেষে যতীন ও আশার পুনরায় জন্ম হয়। পুষ্প তা দেখেও আসে। এই জন্ম-মৃত্যু হয়তো চলতেই থাকবে যতক্ষণ না আত্মার মুক্তি মেলে। দেবযান হয়তো তাদের ওঠানামার দিনক্ষণ কখনো মিলিয়ে নিয়ে যাবে কোনো স্বর্গরাজ্যে। আর হয়তো ফিরতে হবে না ক্ষণজীবনের এই পৃথিবী নামক গ্রহে অথবা অন্য কোনো গ্রহে। জীবন, মৃত্যু, পুনর্জন্ম, সাধনা ইত্যাদি চক্রে এই আত্মা ঘুরতে থাকে আর মুক্তির সন্ধান খুঁজে।