ফকির লালন: মানবধর্মের মহিমায় উদ্ভাসিত এক বলিষ্ঠ লোকনায়ক

ফকির লালন সাঁই
সত্যি বলতে, অবিভক্ত বঙ্গদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে লালন এক মহারহস্যময় চরিত্রের নাম। তাঁকে ঘিরে তর্কবিতর্ক আছে, ধোঁয়াশা আছে; আছে দারুণ বর্ণাঢ্যতা। আছে লাঠালাঠি, আছে কাদা–ছোড়াছুড়ি।

মানুষের কৌতূহল বোধ হয় কখনো ফুরোয় না, ফুরাতে চায় না। মানুষের সেই অনন্ত কৌতূহল আর অজানাকে জানার সূত্র ধরে ধরে আমি কেবলই তত্ত্ব খুঁজে বেড়াই। কখনো আখড়া-আশ্রমে, কখনো মেলা-পার্বণে। নইলে এত বছর পর আবার কেন লালনকে নিয়ে লিখতে হবে? আর পাঁচজন গবেষক-পণ্ডিত কিংবা লোকসংস্কৃতিবিদের মতো দোলপূর্ণিমায় বা কার্তিকের তিরোধান দিবসে ছেঁউড়িয়ায় কিংবা নদীয়ার আসাননগরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের লালনোৎসবে গিয়ে সাহিত্যের পণ্ডিতদের দু-একটা জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনলেই তো জানা-বোঝা হয়ে যায়! অথবা ভক্তিমান সাধুগুরু-ভক্তদের মতো আখড়ায় গিয়ে প্রণাম নিবেদন কিংবা সাধুসঙ্গ করলেই তো সব পাট চুকে যায়! আমিও তো অন্যদের মতো বলতে পারতাম, লালন ফকির উচ্চ স্তরের সুফি সাধক ছিলেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায় অনুপ্রাণিত হয়ে সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন। আমিও তো মেহেরপুরের কাজীপুর গ্রামের ফকির দবিরউদ্দিন শাহের মতো বিশ্বাস করতে পারতাম, ‘লালন একজন আল্লাহর অলি ছিলেন।’ কুষ্টিয়ার ফকির মন্টু শাহের মতো মনে করতে পারতাম, ‘সিরাজ সাঁই বলে কোনো লোক ছিলেন না।’ সিরাজ আসলে লালনের কাল্পনিক গুরু। কারণ, লালন নিজেই কলিযুগের অবতার। (আজাদ রহমান: লালন মত লালন পথ। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১০, পৃষ্ঠা: ৩০)

কোনো কোনো ভাবশিষ্য বলেছেন, ‘লালন স্বয়ং মহাভাবসমুদ্র, এ কারণেই তিনি জগৎগুরু, ত্রাতা ও দাতা। প্রকৃত বিচারে ফকির লালন মাতৃযোনিসম্ভূত সাধারণ মানবসন্তান নন, তাঁকে অযোনিসম্ভূত বলে সিদ্ধ সাধকগণ উল্লেখ করেছেন। শাব্দিক ব্যাখ্যা দিয়ে লালনকে বোঝানোর সাধ্য নেই এ নরাধমের। তাঁর এককণা শ্রীচরণধূলির যোগ্যও আমি নই। তিনি দয়াল, এই ভরসায় বাঞ্ছা করি তাঁর মহানাম কীর্তনের। বিশ্বাস করি, জগৎবাসীর আত্মমুক্তির শেষ উপায় বা সর্বোত্তম পন্থা এটিই।’ (আবদেল মাননান: লালন দর্শন, ঢাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা: ১৮) কিন্তু সব মত খারিজ করে দিয়ে গ্রাম-জনপথে ঘুরে বেড়ানো তার্কিক কুদ্দুস ফকির কিংবা বাদল শাহ বলেছেন, লালন একজন সাধারণ মানুষ, কেবলই মানুষ।

সত্যি বলতে, অবিভক্ত বঙ্গদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে লালন এক মহারহস্যময় চরিত্রের নাম। তাঁকে ঘিরে তর্কবিতর্ক আছে, ধোঁয়াশা আছে; আছে দারুণ বর্ণাঢ্যতা। আছে লাঠালাঠি, আছে কাদা–ছোড়াছুড়ি। একসময় দুই বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠী লালনকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করত। কেউ আবার তাঁকে অলি মনে করে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করত। তবে দেশভাগ, সমাজ-রাজনীতির ভাঙাগড়া এবং পরিবর্তনের আপতিক মোচড়ে মানুষের ধ্যানধারণা অন্য রকম হয়ে গেছে। তারপরও লালনকে নিয়ে জনমনে ও বুদ্ধিজীবী মহলে ঔৎসুক্য কমেনি। বরং তাঁকে ঘিরে প্রতিদিন জন্ম হচ্ছে ধোঁয়াশা, নতুন নতুন তর্ক। লালনকে নিয়ে চাপান-উতোর, তর্ক-প্রতর্ক, অনিঃশেষ কৌতূহল প্রমাণ করে যে লালনের জীবনকাহিনির মধ্যে বেশ কিছু নাটকীয়তা আছে। তাঁর গানের ভেতরে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা মানবমনের চিরন্তন জিজ্ঞাসা উসকে দেয়। তা না হলে তাঁকে নিয়ে এত কৌতূহল, এত তর্কবিতর্ক থাকবে কেন? কেন বাঙালি জাতিসত্তার উজ্জীবনে তাঁকে সামনে নিয়ে আসা হবে? হাল আমলের নাগরিক বুদ্ধিজীবীরাও তাঁকে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধির সমাজ গড়ার সারথি হিসেবে দেখে। সেই দিক থেকে লালন আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সংস্কৃতিসেবীদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন। ঢুকে পড়েছেন সদর রাস্তা থেকে সটান অন্দরমহলে।

এখানে রামকৃষ্ণদেবের উদাহরণ দেওয়া যায়। স্কুল-কলেজে তিনি পড়েননি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বহরও তাঁর ছিল না। তারপরও তিনি গদাধর থেকে রামকৃষ্ণদেব হয়েছিলেন। একপর্যায়ে তাঁর ধর্মভাবনা বিবেকানন্দের পশ্চিমা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তিনি গ্রামে জন্মেছিলেন, কিন্তু পরিপুষ্ট হন কলকাতার শহুরে এলিটদের নিবিড় পৃষ্ঠপোষকতায়। রানী রাসমণির বদান্যতা, কেশবচন্দ্র সেন, বিদ্যাসাগর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো মানুষের সাহচর্য এবং গিরিশ ঘোষ-বিবেকানন্দের মতো শিষ্যদের নিঃশর্ত আনুগত্য পেলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও একজন মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণদেব হতে পারেন। কিন্তু এক দুর্গম ও প্রত্যন্ত গ্রাম-জনপদের বিত্ত-বৈভবহীন পরিবারে জন্ম নেওয়া এবং অকুলীন পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা এক গেঁয়ো-নিরক্ষর বাউল কী করে ফকির লালন সাঁই হয়ে উঠলেন, তা এক বিস্ময়কর রহস্য। তাঁকে নিয়ে যাঁরা গবেষণা বা লেখালেখি করেছেন, তাঁরা সেই রহস্যের জট খুলতে পারেননি আজও।

ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে ভক্ত-অনুরাগীদের ভিড়। কুষ্টিয়া
ছবি: তৌহিদী হাসান

লালন নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে বসন্তকুমার পাল ও মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন অগ্রগণ্য। বসন্তকুমার যেভাবে লালনের জীবনকাহিনি বয়ান করেছেন, তাতে গবেষক মনসুরউদ্দিনের সমর্থন ছিল। দুজনের ভাষ্য সংক্ষেপ করে বলা যায়:
লালন ফকির অবিভক্ত নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ার অন্তর্গত কুমারখালীসংলগ্ন গড়াই তীরের ভাঁড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম কায়স্থ পরিবারে, পদবি কর (মতান্তরে রায়)। বাবার নাম মাধব ও মাতা পদ্মাবতী। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান লালন শৈশবে বাবাকে হারান এবং সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। চাপড়ার ভৌমিকরা তাঁর মাতুলবংশ। তাঁর ধর্মভাব ছিল স্বভাবগত। অল্প বয়সে পিতৃহীনতার কারণে সংসারে জড়িয়ে পড়েন এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে বিরোধের কারণে স্ত্রী ও মাকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী দাসপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। বারুণী তিথি উপলক্ষে সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে বহরমপুরে গঙ্গাস্নানে যান এবং ফেরার পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। অচেতন লালনকে তাঁর সঙ্গীরা জলে ভাসিয়ে দেয় এবং গ্রামে ফিরে তাঁরা রটিয়ে দেয় যে লালন মারা গেছেন। মা, স্ত্রী ও গ্রামবাসী এই মিথ্যা রটনা বিশ্বাস করে নেয়। মিথ্যা হলেও গ্রামবাসী এটিকে সত্য বলে মেনে নেয় তৎক্ষণাৎ।

লালনের জীবনকাহিনি বাঁকবদল করে বা নতুনভাবে নির্মিত হয় কুমারখালীর নিকটবর্তী কালীগঙ্গার তীরে, যেখানে তিনি অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। এক স্নেহশীলা মুসলমান নারীর নিবিড় পরিচর্যা ও মমতায় সুস্থ হয়ে ওঠেন, লাভ করেন এক নতুন জীবন। কিন্তু গুটিবসন্ত তাঁর শরীর ও মনের ওপর যে দগদগে ক্ষত এঁকে দেয়, তা সারা জীবনেও মোচন করতে পারেননি। সুস্থ হয়ে লালন বাড়ি ফিরলেন বটে, কিন্তু শাস্ত্র, ধর্ম ও সমাজের বিধান অনুসারে তিনি সেখানে আশ্রয় পেলেন না। কেননা যার নামে শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন হয়েছে এবং যিনি যবন-মুসলমানের গৃহে অন্ন গ্রহণ করেছেন, হিন্দুশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী, তাঁর জাত চলে গেছে; তিনি হয়ে গেছেন অস্পৃশ্য। হিন্দু সমাজ তাঁকে গ্রহণ করতে পারে না। সমাজ ও পরিবারের এ রকম নিষ্ঠুর আচরণে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত লালন চিরদিনের জন্য গৃহত্যাগ করেন। ক্ষতবিক্ষত হয়ে ফিরে আসেন গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছে। সিরাজ সাঁই তাঁকে বায়াত করেন এক নতুন লোকায়ত মানবধর্মে। এই ধর্মের কোনো শাস্ত্র কেতাব নেই, কোনো মহাপুরুষ নেই। সাম্প্রদায়িক মত ও প্রথাগত ধর্ম পরিত্যাগ করে সিরাজের প্রেরণা ও কারিগর সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী ছেঁউড়িয়া গ্রামে তিনি একটি আখড়া গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে, ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে দলে দলে মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর শিষ্যরা অধিকাংশই ছিলেন গরিব মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দু। অভিজাত শ্রেণি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেননি। একজন মারফতি সাধক এবং নীলকর-সামন্তবাদ-শোষক-জমিদারবিরোধী প্রতিবাদী ব্যক্তি হিসেবেও তাঁর লোকপ্রিয়তা ক্রমাগত বিস্তৃত হয় অবিভক্ত বঙ্গদেশের পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে। গড়ে ওঠে বিশাল শিষ্যমণ্ডলী।

ইচ্ছে করেই লালন তাঁর জাতি পরিচয়টা গোপন রেখেছিলেন। এর পেছনে হয়তো অনেকগুলো কারণ ছিল। প্রথমত, তিনি হয়তো সবার মধ্যে নিজের একটি গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি চাইতেন ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সব নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষ যেন তাঁর সম্প্রদায়ভুক্ত হয়।

অনুমান ও লোকশ্রুতিনির্ভর এমন লালন-জীবনকাহিনি সর্বাংশে সত্য এমন কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই। লালনকে বোঝার জন্য তাঁর জীবনকাহিনি যে খুব জরুরি, তা–ও নয়। তিনি যে জাতপাত, ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি, সাম্প্রদায়িকতাকে খারিজ করে দেওয়া, বিশুদ্ধ মানবধর্মে আস্থাশীল সাহসদীপ্ত ব্যক্তি ছিলেন সেটাই জরুরি। কিন্তু অজ্ঞ-অন্ধ কিংবা ধান্ধাবাজ মানুষ লালনের জাতিত্ব নিয়েই টানাটানি করে চলেছেন, একের পর এক নির্মাণ নিয়ে করে চলেছেন নানা কেচ্ছাকাহিনি। লালনের জীবনকাহিনির ওপর একটি প্রলেপ আছে, সেই সঙ্গে রয়েছে নানা বিতর্ক ও মতান্তর। এসব কাহিনির মধ্যে কোনো মিথ্যাচার বা বিভ্রান্তি নেই। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে একদল নতুন গবেষক এবং কিছু সাধুগুরু মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। লালনের হিন্দু পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলতে চাইছেন, লালন জন্মসূত্রে মুসলমান। ১৯৬৩ সালে গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলী এম এ হাইয়ের নকশা অনুসারে লালনের সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এটি দেখলে দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মকবরার কথা মনে পড়ে। এভাবেই পাকিস্তানি শাসনামলে লালনের ইসলামীকরণ শুরু হয়। পাঞ্জু শাহের পুত্র খোন্দকার রফিউদ্দিনও তাঁর ভাবসংগীত গ্রন্থে লালন ফকিরকে মুসলমান হিসেবে দাবি করেছেন। সত্যিই কি তিনি মুসলমান ছিলেন? আবার খোন্দকার গোত্রভুক্ত? তাহলে তো তিনি খান্দান মুসলমান ছিলেন? কিন্তু অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ের মতো গবেষকেরা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ও যথাযথভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষা চালিয়ে বলছেন অন্য কথা। তিনি ভারতী পত্রিকায় লিখেছেন: ‘লালন অতি উদার ও সরল ছিলেন। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না, হিন্দু-মুসলমানকে সমভাবে দেখিতেন ও শিষ্যদিগের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান সকল জাতিকেই গ্রহণ করিতেন। লালন হিন্দু নাম, শাহ উপাধি মুসলমানজাতীয়; সুতরাং অনেকেই তাঁহাকে জাতির কথা জিজ্ঞাসা করিত। তিনি উত্তর না দিয়া স্বপ্রণীত নিম্নলিখিত গানটি শুনাইতেন:
‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন কয়, জাতের কীরূপ দেখলাম না এ নজরে।’

ইচ্ছে করেই লালন তাঁর জাতি পরিচয়টা গোপন রেখেছিলেন। এর পেছনে হয়তো অনেকগুলো কারণ ছিল। প্রথমত, তিনি হয়তো সবার মধ্যে নিজের একটি গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি চাইতেন ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সব নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষ যেন তাঁর সম্প্রদায়ভুক্ত হয়। এ কারণে কখনোই নিজেকে কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি। এমনকি বাউল সাধক কিংবা সুফি সাধক হিসেবেও উপস্থাপন করতে চাননি।

আসলে লালন ছিলেন উদার ও নির্ভীক চিত্তের ব্যক্তি। ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত ও প্রত্যাখ্যাত মানুষ, তাই শোষণ, পীড়ন, অসাম্য ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটিয়ে একটি বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। জন্মসূত্রে তিনি মুসলমান হতে পারেন, আবার হিন্দুও হতে পারেন। তাঁর জন্ম খান্দান-খোন্দকার বংশে কিংবা কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত উচ্চবর্ণে হলেও হতে পারে। কিন্তু যাপন করতেন নিম্নবর্গের বেশরা বা অবৈদিক জীবন। এক গাঢ় অভিমান ও ব্যথা নিয়ে প্রথাগত ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেছে নিয়েছিলেন গভীর নির্জন পথ। গ্রহণ করেন নিগূঢ় লোকায়ত ধর্ম, যার অপর নাম হিউম্যানিজম। কৌশলগত কারণে অথবা ক্ষুব্ধ অভিমানে জন্ম, ধর্ম, বংশ ও পারিবারিক পরিচয় ঊহ্য রেখেছিলেন। জনারণ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে খুঁজতে চেয়েছিলেন এক নিঃসীম একাকিত্ব। ডুব দিতে চেয়েছিলেন মনের অতলে। খুঁজতে চেয়েছিলেন অরূপরতন। কিন্তু কালের বৈরী প্রতিক্রিয়া, বিশেষত শোষণ, পীড়ন, নারীনিগ্রহ, জাতের নামে বাড়াবাড়ি, জমিদার-নীলকর সাহেবদের নির্মম অত্যাচার এই আত্মনিমগ্ন সাধককে রূপসাগরে ডুব দিয়ে থাকতে দেয়নি। বরং একতারা ফেলে আখড়া থেকে বেরিয়ে বাধ্য হন প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্দৈব তাণ্ডব রুখতে। অন্যায়-অবিচার, অসাম্য, ভেদবুদ্ধি, শক্তিমানদের তাণ্ডব রুখতে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ‘মানুষ সত্যের উপাসক’। নির্দ্বিধ হয়েই বলা যায়, তিনি ছিলেন মানবধর্মের মহিমায় উদ্ভাসিত এক বলিষ্ঠ লোকনায়ক।

সভাপতি, মেহেরপুর বন্ধুসভা ও সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ