কাশ্মীর, মন পড়ে আছে যেখানে!

পেহেলগামে বেতাবভ্যালি, অরুভ্যালিতে লেখকের স্ত্রী-কন্যা
ছবি: লেখক

ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, পৃথিবীর স্বর্গ কাশ্মীর। কেউ কেউ প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডও বলে থাকেন। তাই কাশ্মীরের সৌন্দর্য নিজ চোখে দেখার লোভ সব সময়ই ছিল।

কিছু গাড়ি আছে, ঠেলে স্টার্ট দিতে হয়। একবার স্টার্ট নিলে মোটামুটি ভালোই চলে। আমিও অনেকটা সে রকম। আমার ছোট মেয়ে এবং তার মায়ের ধাক্কায় স্টার্ট নিতে বাধ্য হলাম এবং একটি ট্যুরিজম কোম্পানির সহায়তা নিয়ে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই কাশ্মীর ভ্রমণের সব ব্যবস্থা করে ফেললাম। ছোটদের মতো বায়না ধরল মেয়ের বড় মামা। অগত্যা তাকেও সঙ্গী করতে হলো।

১২ জুন, ২০২৩ ভিসতারা এয়ারলাইনসের বিমানে দিল্লি, তারপর সেখান থেকে স্পাইসজেটে চড়ে শেষ বিকেলে শ্রীনগর পৌঁছালাম। রাতে লম্বা ঘুম দিয়ে পরদিন সকাল সকাল গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম পেহেলগামের উদ্দেশে। পথে যাত্রাবিরতি দিয়ে ড্রাইভার কাম গাইড মোস্তাক সাহেব আমাদের দেখালেন অবন্তীপুরে ঝিলাম নদীর তীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবন্তীস্বামী মন্দির এবং অনন্তনাগে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা। কিছু দূর যাওয়ার পর আরেকটি বিরতি দিয়ে স্থানীয় কুকিজসহ (স্বাদ অনেকটা আমাদের বাকরখানির মতো) বিখ্যাত জাফরান চা পান করার সুযোগ করে দিলেন।

অবন্তীপুরে ঝিলাম নদীর তীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবন্তীস্বামী মন্দির
ছবি: লেখক

স্বর্গ কেমন? ছোটবেলায় এই প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেত। কিছুটা স্কুলের দিদিমণির কাছ থেকে শুনে এবং বাকিটা নিজে কল্পনা করে স্বর্গের একটি ছবি মনের মধ্যে এঁকে ফেলেছিলাম। কী ছিল সেই ছবিতে? পাহাড়, ঝরনা, নদী, ফুলের বাগান, ফলের বাগান, পাখির কলকাকলি এবং আরও কিছু নৈসর্গিক চিত্র। কাশ্মীরের পেহেলগামে বেতাবভ্যালি, অরুভ্যালি এবং আরও কিছু দর্শনীয় স্থানে গিয়ে স্বর্গের সেই ছবির কথা মনে পড়ে যায়। মাঝেমধ্যে চোখধাঁধানো অপরূপা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সন্দেহ হচ্ছিল, এসব কি পার্থিব? আমি কি পৃথিবীতে আছি, নাকি অন্য কোথাও!

অপরূপা পেহেলগামকে বিদায় জানাতে হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু পৃথিবীর নিয়ম এটাই, সুন্দর সময় খুব ক্ষণস্থায়ী। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ডাল লেক এবং লেকের হাউসবোটে রাতযাপন। জম্মু-কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর আর শীতকালীন রাজধানী জম্মু। ডাল লেককে বলা যায় শ্রীনগরের রাজকন্যা। সন্ধ্যার একটু আগে আমরা পৌঁছালাম ডাল লেকের ৯ নম্বর ঘাটে। লেকের দিকে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। এ এক ভিন্ন সৌন্দর্য। পাহাড় এত কাছে মনে হয়, লেকটা যেন পাহাড়ের সন্তান, মায়ের কোলে বসে আছে। সাগরের মতো বিশাল বড় জলাধার। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো নৌকা। একদিকে সারি সারি হাউসবোট। হাউসবোটগুলো থেকে আলো এসে পড়ছে লেকের পানিতে। মনে হচ্ছে একটা ভাসমান শহর। ১৫ মিনিট পর হাউসবোট থেকে একটি ছোট নৌকা এল আমাদের নিতে, এই বিশেষ নৌকাগুলোর নাম শিকারা।

ডাল লেক
ছবি: লেখক

হাউসবোটে পৌঁছে খুব রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। নৌকাবাড়িতে রাতযাপন! কি মজার ব্যাপার, না! হাউসবোটে অভ্যর্থনা জানালেন খেদমতকারী খান সাহেব। আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, যখন যা দরকার হয়, আমাকে শুধু ডাকবেন। আর ডিনার খাওয়ার আধঘণ্টা আগে জানাবেন। নৌকাবাড়ির ভেতরে ঢুকে মনেই হলো না যে আমরা নৌকায় আছি! মনে হচ্ছে পরিপাটিভাবে সাজানো একটি অ্যাপার্টমেন্ট। লিভিংরুম, বেডরুম, টয়লেট, কিচেন—সব আছে। ডিনার করার পর হাউসবোটের ব্যালকনিতে বসে চা পান করতে করতে রাত একটা পর্যন্ত উপভোগ করলাম ডাল লেকের রাতের অপার সৌন্দর্য।

সকালে নাশতা সেরে আবার সেই বেদনাময় বিদায়ের পালা। নৌকায় উঠে দেখলাম, লেকের আরেক রূপ। পুরো লেকটাই যেন বাজার। দূরে দেখলাম, শাকসবজি আর ফলমূলের বিশাল বাজার। নৌকা নিয়ে হাউসবোটগুলোতে চা-কফি বিক্রি করছেন কেউ কেউ। অনেক ফেরিওয়ালা নৌকা নিয়ে ফেরি করছেন মনিহারি, জুয়েলারিসামগ্রী। আমার মেয়ে এবং তার মা বেশ কিছু জুয়েলারি কিনে ফেলল চলন্ত অবস্থায়।

মোহনীয় নিশাত গার্ডেন
ছবি: লেখক

ঘাটে গিয়ে দেখি, গাইড মোস্তাক সাহেব হাজির। গাড়িতে উঠতেই বললেন, ‘আপনাদের এখন নিশাত গার্ডেনে নিয়ে যাব। কাশ্মীর যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত, তেমনি ফুল ও ফলের জন্যও বিখ্যাত। শ্রীনগরে রয়েছে অনেকগুলো বাগান। মোহনীয় নিশাত গার্ডেন সেগুলোর একটি।’

গুলমার্গকে বলা যায় বরফের রানি। গুলমার্গ শহর ভারতের সুদূর উত্তর প্রান্তের রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত। কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে ৮ হাজার ৮২৫ ফুট ওপরে এই হিল স্টেশনে গেলে দ্বিধা সৃষ্টি হবেই, স্থানটি গুলমার্গ নাকি সুইজারল্যান্ডের কোনো বরফঢাকা অচেনা শহর। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় বরফ আর মেঘ খেলা করে। আপনি যেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন, সামনে তাকালেই অভিভূত হয়ে যাবেন গুলমার্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। অতিরিক্ত শীতের কারণে এখানে জনবসতি অনেক কম। শুধু যাঁরা পর্যটনশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। শীতের সময় পাহাড়গুলো যখন বরফে ঢেকে যায়, তখন স্কিইং খেলার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হয় এই গুলমার্গ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্কিইং-প্রেমীরা ছুটে আসেন এখানে। গুলমার্গে রয়েছে প্রাকৃতিক সবুজে আচ্ছাদিত পৃথিবীর বৃহত্তম গলফ কোর্স। ১০০ বছরের পুরোনো ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি ছোট রোমান ক্যাথলিক গির্জা রয়েছে গুলমার্গে, যা পর্যটকদের নজর কাড়ে। এ ছাড়া আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে।

এবার দেশে ফেরার পালা। বরাবরের মতোই মনে হলো, আর কয়েকটা দিন থাকতে পারলে ভালো হতো। অনেক কিছুই তো দেখার বাকি রয়ে গেল!

তেজকুনিপাড়া, তেজগাঁও, ঢাকা