রাত্রিজুড়ে বিষাদ

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

রোজকার দিনের মতো বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে পুণ্য। গোলকধাঁধার এই শহরে দিনকে দিন রোবটে পরিণত হয়ে পড়ছে সে। জীবনকে উপভোগ করার বয়সে নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত তার দিনকাল। নিঃসঙ্গ জীবনের একেকটা রাত্রি যেন দীর্ঘ বিষাদের গল্প শোনাতে হাজির হয়। ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাতে জমাতে ভোরের আলো এসে জানালার কাচ ভেদ করে স্বাগতম জানায়। নিঃসঙ্গতার অসহনীয় যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে নতুন এক দিন শুরু হয় তার।

বাবাকে হারিয়েছে ছোটবেলায়। স্মৃতিতে অপরিস্ফুট হয়ে ধরা দেয় বাবার অবয়ব। পৃথিবীকে বুঝতে শেখার বয়স থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে মমতাময়ী মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা। অর্থকড়ির সমস্যায় জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও দিব্যি মা ও ছেলে সুখে-শান্তিতে জীবনকে যাপন করতে থাকে। কোনোরকমে কলেজ পাস করে সোনার হরিণের অন্বেষণে শহরমুখী হয় পুণ্য। মায়ের লড়াইয়ে সে–ও সহযোদ্ধা হতে চায়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কপালে জুটে যায় একটি চাকরি। মন কেমনের দিনগুলোতে মাকে কাছে না পেলেও পুণ্যর জীবনে আর্বিভাব ঘটে এক তরুণীর। মেয়েটির নাম মধুমিতা। আদর করে মধু বলে ডাকে সে। ধীরে ধীরে পুণ্যর নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে সে। বাসে যেতে যেতে মনে পড়ে মধুর সঙ্গে কাটানো শেষ বিকেলবেলার কথা।

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। কর্মঘণ্টা শেষ করে মধুর সঙ্গে দেখা করতে বেইলি রোডে ছুটে যায় পুণ্য। কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়ে নীল শাড়ি পরিহিত স্বর্গের এক অপ্সরীর। হৃৎপিণ্ডের বাঁ অলিন্দে ধাক্কা অনুভব করে সে। কী অপরূপ সাজে সেজেছে মধু! মাথায় শিউলি ফুলের মালা, গলায় মুক্তোর হার, ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক, কপালজুড়ে লাল টিপ। দুই হাতের তালু মেহেদি রঙে রাঙানো, পায়ে আলতা। মধুর রূপ-লাবণ্যে দগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। জীবনে আরও একবার অনুভব করতে পারল, সত্যি সত্যি প্রেমে পড়েছে সে। রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছে! পাশাপাশি মনের গহিন কোণে এক প্রশ্নের জন্ম হয়, হঠাৎ আজ মধু এমনভাবে নিজেকে সাজাল যে!

সেদিন প্রশ্নের উত্তর না পেলেও পরবর্তী সময়ে কারণটি বুঝতে পারে পুণ্য। মানুষ শেষনিশ্বাস ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে অবচেতন মনে যেমন চোখের আশপাশে আপনজনের আনাগোনা অনুভব করতে চায়, তেমনি মধুও হয়তো চেয়েছিল অন্তিম সেই মুহূর্তকে স্মৃতিবহুল করে তুলতে।

পুরোনো স্মৃতির সাগর থেকে বেরিয়ে অফিসে প্রবেশ করেছে পুণ্য। টেবিলে বসেই নিত্যদিনের মতো পত্রিকায় চোখ রাখে সে। শেষ পৃষ্ঠার একটি শিরোনামে চোখ আটকে যায়। ‘বাঁচতে চায় ক্যানসার আক্রান্ত মধুমিতা’—লেখাটি পড়ে পুণ্যর শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। টেবিলে রাখা বোতল থেকে পানি পান করে সে।

জীবন থেকে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মানুষেরাই কি আবার হুটহাট করে জীবনে ফিরে আসে? কেন এভাবে দূরে চলে গিয়েছিল মধু? তবে কি নিজের অসুস্থতা লুকাতে গিয়েই আড়াল হয় সে? প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরে পুণ্য। মুঠোফোনের স্ক্রিনে দেখতে পায় অচেনা এক নম্বর থেকে যেন বার্তা এসেছে—‘চলে যাওয়ার প্রহর গুনছি। আর কখনই দেখা হবে না আমাদের। তুমি ভালো থেকো। আমি তো ভালো রাখতে পারলাম না। কেউ একজন আসুক, যে তোমাকে মধুর চেয়েও বেশি ভালোবাসবে।’

চোখের কোণে অশ্রু উঁকি দেয় পুণ্যর। এমন সময় মায়ের কল। চোখ মুছে কল ধরে সে। নিত্যদিনের মতো ছেলের খোঁজখবর নিয়ে মা নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলেন, ‘বাজান, তুই কি মেলা ব্যস্ত? কদিনের লাইগ্যা আহন যায় না গেরামে? কদিন থাইক্যা রাইতে স্বপনের মাঝে তর বাপে আমারে ডাকাডাকি করে…’ হঠাৎ কল কেটে যায়। ইচ্ছা করেই আর কল করে না পুণ্য।

রাত বাড়ছে। চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধতা। নিজেকে বড্ড একা লাগছে পুণ্যর। এই পৃথিবীতে যেন কোথাও কেউ নেই তার। দখিনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের তারা গুনতে গুনতে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘রাত্রিজুড়ে বিষাদ নামুক। নামুক, তবে তা কেবল আমার বেলায়।’

সহসভাপতি, সিলেট বন্ধুসভা