জিলাপি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘একটা জিলাপি কিইন্না দিবা মা?’ কথাটা বলেই হাসু তার মায়ের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যদিও সে আন্দাজ করতে পারছে, উত্তর কী হবে।
—জিলাপি মানে? আরও কিছুর নাম ক তুই...মিষ্টি, দই, রসমালাই। তিনবেলা পেটে ভাতের জোগাড় করতে পারি না আবার রাজকইন্যা জিলাপি খাইব, শখ দেখলে মরে যাই। বাপটা মরে গিয়ে বাঁইচা গেছে, সব আমার ওপর দিয়ে গেছে। মায়ের মুখে এ রকম কথা শুনে হাসু চোখ মুছতে মুছতে ঘরে চলে গেল।
—হ, পারো তো কিছু কইলেই চোখ থ্যাইকা পানি ফেলতে। এদিকে আমি যে কী কষ্টে দিন পার করতেছি, এই খবর কেউ রাখে!

কুসুম নিজেও জানে কথাগুলো হাসুকে বলে সে শুধু নিজের রাগটাই প্রকাশ করছে। ওই একরত্তি মেয়ে সংসারের কীই–বা বোঝে। তবু কুসুমের রাগ যেন কিছুতেই কমছে না। রাগটা হাসুর ওপর যতটা, তার থেকেও বেশি তার ভাগ্যের ওপর। গত বছর বড় রাস্তার মোড়ে গাড়িচাপায় তার স্বামী মারা গেছে। তার পর থেকে মা-মেয়ের অভাবের সংসার। মানুষের বাড়ি কাজ করে কোনোমতে তিন বেলার খাবার জোটে। কোনো দিন কাজ পায়, কোনো দিন পায় না। কেউই সারা মাসের জন্য কাজের লোক রাখতে চায় না। গ্রামে আর কতই বা কাজ থাকে। যে যারটা করে নেয়, এরই মধ্যে কারও বউ অসুস্থ হলে বা কোনো বিপদ হলে ডাক পড়ে কুসুমের।
পাশের বাড়ির রাহেলাবু একবার বলেছিল শহরে নাকি মেয়েদের অনেক কাজ পাওয়া যায়। কিন্তু স্বামী-শ্বশুরের ভিটেমাটি ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে শহরে যেতে কুসুমের মন সায় দেয়নি কখনো। খাই না খাই, তবু নিজের ভিটায় মরলে শান্তি—এ বিশ্বাসে সে হাসুকে নিয়ে এখানেই দিন পার করছে।
হাসুর কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল কুসুমের। ঘরে গিয়ে দেখল হাসু ঘুমিয়ে পড়েছে, চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকক্ষণ কেঁদেছে মেয়েটা। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। আর দেরি না করে একটা খালি পুঁটলি নিয়ে সে রওনা দিল মুন্সি বাড়ির দিকে।

‘না খাইয়্যাই এই ভরদুপুরে ঘুমাই পড়ছে মেয়েটা, আর খাইবই বা কী, ঘরে তো চাল-ডাল নাই। সকালে একটু পান্তা আর রাহেলাবুর থাইক্যা দুইডা কাঁচামরিচ আইনা মাইয়াডারে খাওয়াইছি। এত বেলা হইছে, সেই পান্তা কি আর পেটে আছে?’ ঘরে চাল নেই দেখে সকালে সিকদার বাড়ি গিয়েছিল কুসুম। সিকদারের বউয়ের একটা কাঁথা সেলাই করে দিয়েছিল গত মাসে। সেটার টাকা এত দিন দেবে দেবে করে ঘোরাচ্ছিল। আজ ওই টাকা দিয়ে চাল কিনবে ভেবেছিল কুসুম, কিন্তু গিয়ে দেখে বাড়িতে তালা ঝুলছে। সিকদারের বউ বাপের বাড়ি গেছে, সঙ্গে স্বামী-সন্তানও। কবে আসবে কিছু বলে যায়নি। মনের দুঃখে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয় কুসুমকে। রাগ, অভিমান আর কষ্ট নিয়ে চুপ করে বসে ছিল। সেই সময় হাসু জিলাপির কথা বলায় সব রাগ তার ওপরই পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে এসব মনে মনে ভাবছে কুসুম।
কখন যে রাস্তা শেষ হয়ে গেল, কুসুম টের পায়নি। মুন্সির বউয়ের কাজের মেয়ে যে নেই, তা নয়। রাসুর মা তাদের ধরাবাঁধা কাজের লোক, বাড়তি কাজের লোক তারা বাড়িতে রাখেনি। এটাও রাখত না কিপ্টে মুন্সি, এখন বউয়ের চাপে পড়ে অনেক ক্যাচাল করে এই একজনকে রাখা হয়েছে। সামনে বাঁশঝাড় ও পুকুর পেরিয়ে কুসুম ঢুকল মুন্সি বাড়িতে। দাওয়ায় বসে পান চিবুচ্ছে মুন্সির বউ। কুসুমকে দেখেই কাছে ডাকল।
—ভালোই হলো তুই এলি। আমি মনে মনে তোকেই খুঁজছিলাম। রাসুর মা আজকে নাকি আর আসতে পারবে না। কলতলায় পড়ে ব্যথা পাইছে। কয়েক দিন আসতে পারবে বলে মনে হয় না। এই কয়টা দিন তুই এসে আমার কাজগুলো একটু করে দিয়ে যাস তো বাপু। কুসুম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। হোক না কয়েকটা দিন, তবুও তো কদিন মেয়েটাকে নিয়ে সে পেটপুরে খেতে পারবে। মুন্সি কিপ্টে হলেও তার বউ নায্য পাওনা দিতে কখনো কৃপণতা করে না।
—কিরে কুসুম? এমন চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস যে? কী বললাম শুনতে পেলি?
—হ্যাঁ বড় মা, আমি আসমু বড় মা, তয় আজ আমার একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওন লাগব, আমি বেবাক কাজ কইরাই যামু, মাইয়াডা আমার না খাইয়া আছে বাড়িতে।
—আচ্ছা ঠিক আছে, কাজ সব করে যেতে পারলে চলে যাবি।
সব কাজ শেষ করে এক সের চাল আর এক পোয়া ডাল নিয়ে যখন চলে আসবে, তখনই মুন্সির বউ পিছু ডাকল।
—হাট থেকে জিলাপি আনাইছিলাম আমার নাতির জন্য, এ কয়েকটা পড়ে আছে, নাতি আর খাবে না, আমি ফেলেই দিতাম। তুই বরং এগুলো নিয়ে যা, তোর মেয়েরে দিস। কৃতজ্ঞতায় কুসুমের চোখ জ্বলে ভরে উঠল—‘এ জিলাপির জন্যই সকালে মাইয়াডারে কত কথা শুনাইছি আমি। ওরই বা কী দোষ। কাউরে খাইতে দেইখা হয়তো খাইতে মন চাইছে।’

মুন্সির বউয়ের কথায় হুস ফিরল কুসুমের,
—আর দেরি করিস না কুসুম, আকাশের অবস্থা ভালো না, তাড়াতাড়ি বাড়ি যা।
সত্যিই তো, আকাশে মেঘ জমেছে, এতক্ষণ খেয়াল করেনি কুসুম। মুন্সি বাড়ি থেকে বের হয়ে জোরে জোরে পা ফেলতে লাগল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ঘনকালো মেঘের জন্য মনে হচ্ছে চারদিকে সন্ধ্যা নেমেছে। ‘আইজকার যেই মেঘ করছে, ঝড় না হইয়া তো যাইব না। ঘরের অবস্থাও ভালো না, মাটির দেয়াল, তা–ও জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরছে, বৃষ্টি আইলে ঘরের ভেতর পানি চুইয়া পড়ে। মানুষ দিয়া ঠিক না করাইলে ঘরে থাকন যাইব না, হাসুর বাপ বাঁইচা থাকলে কি আমারে এত কিছু ভাবতে হয়! উপরে টিনও ঝাঁঝরা হইয়া আছে, টিনের পানি চুইয়া দেওয়া বাইয়া ঘরে চইলা আসে, দেয়ালে কয়েক জায়গায় সাপের গর্তের লাখান হইছে।’ এসব ভাবতে ভাবতে আকাশ অন্ধকার হয়ে বৃষ্টি নামল, সেই সঙ্গে ঝড়।
কুসুম হাতের পুঁটলিটা সাবধানে আঁচলে বেঁধে নিল। পুঁটলিতে আজ সারা দিনের কষ্টের মজুরি চাল-ডাল আর কয়েকটা জিলাপি। এগুলো নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। ঝড়ের বেগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুসুম হাঁটছে, মুন্সি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় খুব ক্লান্ত লাগছিল, সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি, তার ওপর এত কাজ করল, বৃষ্টির পানি শরীরে পড়তেই যেন ক্লান্তি সব ধুয়ে সাফ হয়ে গেল। কষ্ট হচ্ছে, তবু সে আর থামবে না, মেয়েটা একা আছে ঘরে, দুই পা এগোলে বাতাস তাকে আরও দুই পা পেছনে নিয়ে আসছে। মাঝেমধ্যে এত জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে যে কুসুমের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে।

বাড়ির উঠানে পা রাখতেই কুসুমের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ঘরের দুই পাশের দেয়াল ভেঙে পড়ে আছে ঘরের মাঝবরাবর। কুসুমের সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে। হাসু বলে চিৎকার দিয়ে ছুটে গেল ভেঙে পড়া দেয়ালের কাছে। এত ভারী মাটির দেয়াল একা হাতে তোলা কুসুমের পক্ষে অসম্ভব, সে পাগলের মতো মাটি আঁচড়াতে লাগল। মাটির ভাঙা দেয়ালের ওপর পড়ে থাকা ঘরের চালের টিন সরাতেই বুকের মধ্যে ধুঁক করে উঠল কুসুমের।
হাসুর পা দুটি বের হয়ে আছে, শরীরের ওপরের অংশ ধসে পড়া মাটির দেয়ালের নিচে চাপা। কুসুম ধপ করে বসে পড়ল নিচে। পুঁটলিটা খসে জিলাপিগুলো মাটিতে পড়ে গেল। কুসুম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিলাপির দিকে। পাশেই চাপা পড়ে থাকা হাসুর নিথর দেহ যেন বলে উঠল, ‘জিলাপিগুলো ফালাই দিলা মা। আমারে খাইতে দিবা না?’

কার্যনির্বাহী সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা