বিশ্বকাপে আত্মঘাতী গোল ও এস্কোবার হত্যারহস্য

আন্দ্রেস এস্কোবারছবি: সংগৃহীত

আশির দশকের শেষ ভাগ ও নব্বই দশকের শুরুর দিকে দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলে কলম্বিয়ান ফুটবলের জয়জয়কার ছিল। ঘরোয়া ফুটবল ও আন্তর্জাতিক—উভয় ক্ষেত্রেই আলো ছড়াচ্ছিল তারা। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের আগে কলম্বিয়া জাতীয় ফুটবল দল ২৬টি ম্যাচ খেলে মাত্র একটিতে পরাজিত হয়। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে, বুয়েনস এইরেসে স্বাগতিক আর্জেন্টিনাকে ৫-০ গোলের বড় ব্যবধানে হারানোর রেকর্ডও রয়েছে। সেই সময়ে দেশটির অন্যতম বড় তারকা ফুটবলার ছিলেন আন্দ্রেস এস্কোবার। তাঁর হাত ধরে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নও বুনছিলেন দেশটির মানুষ।

তখন কলম্বিয়ান ফুটবলের উত্থানের অন্যতম বড় কারণ ছিল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও সংগঠনের সহায়তা। বিশেষ করে ক্ষমতাধর মাদক ব্যবসায়ী পাবলো এস্কোবার ছিলেন ফুটবলের একনিষ্ঠ সমর্থক। কলম্বিয়ান ক্লাব অ্যাটলেটিকো ন্যাশনালের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। মাদক ব্যবসার মাধ্যমে আয় করা অবৈধ অর্থকে বৈধ করতেন ফুটবলে বিনিয়োগ করে। পাশাপাশি স্থানীয় খেলোয়াড়দের দুর্দান্ত ফুটবল দক্ষতা তো ছিলই। দুইয়ে মিলে নানা সমস্যা ও অরাজকতায় জর্জরিত দেশটি ফুটবলের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে নিজেদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছিল।

অ্যাটলেটিকো ন্যাশনালের ফুটবলার ছিলেন আন্দ্রেস এস্কোবার। সেই ক্লাবের মাঠ, অনুশীলন সুবিধা ও নতুন ফুটবলার তৈরিতে বিনিয়োগ করেন পাবলো এস্কোবার। ফলে সাফল্যও ধরা দেয়। ১৯৮৯ সালে আন্দ্রেস এস্কোবারের নেতৃত্বে ক্লাবটি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ফুটবল আসর কোপা লিবারটাডোর্সের শিরোপা জয় করে। প্রথম কলম্বিয়ান ক্লাব হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করে তারা। কলম্বিয়া জাতীয় দলের আরও কয়েকজন ফুটবলার এই ক্লাবে খেলায় জনগণের প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। সেই প্রত্যাশা নিয়েই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে প্রস্তুতি নিতে থাকে দলটি।

ক্লাব ও দেশের হয়ে সাফল্য
আন্দ্রেস এস্কোবারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মেডেলিন শহরে। স্কুল ফুটবল টিমে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর উচ্চতার কারণে স্থানীয় এক জনপ্রিয় কোচ তাঁকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে খেলার পরামর্শ দেন। সেই থেকে আন্দ্রেসের উত্থান। ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁকে দলে ভিড়িয়ে নেয় অ্যাটলেটিকো ন্যাশনাল। তাঁর বড় ভাই সান্তিয়াগোও একই ক্লাবে খেলতেন। ২০ বছর বয়স হলে একাদশে নিয়মিত খেলার সুযোগ পান। তখনকার অ্যাটলেটিকো ন্যাশনালের কোচ মাতুরানা পরে কলম্বিয়া জাতীয় দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পান। সেই সুবাদে দ্রুতই জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় আন্দ্রেস এস্কোবারের জন্য।

অ্যাটলেটিকো ন্যাশনালের ফুটবলারদের সঙ্গে ফুটবল হাতে ক্ষমতাধর মাদক ব্যবসায়ী পাবলো এস্কোবার
ছবি: সংগৃহীত

১৯৮৮ সালে কানাডার বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ের ম্যাচে অভিষেক হয় তাঁর। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও খেলেছেন। তবে সত্যিকারভাবে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন ১৯৮৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র হওয়ার ম্যাচে। অ্যালেক্সিস গার্সিয়ার কর্নার শটে হেডের মাধ্যমে গোল করেন আন্দ্রেস এস্কোবার। একই বছর ক্লাবের হয়েও তাঁর সাফল্য চলতে থাকে। দেশটির ইতিহাসের প্রথম ক্লাব হিসেবে অ্যাটলেটিকো ন্যাশনাল জয় করে কোপা লিবারটাডোর্স এবং কোপা ইন্টারআমেরিকার শিরোপা। পাশাপাশি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে ইতালিয়ান জয়ান্ট এসি মিলানের বিপক্ষে হেরে রানার্সআপ হয়। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকান দেশটির বড় তারকায় পরিণত হন আন্দ্রেস।

১৯৮৯ সালের সফলতার পর এস্কোবার ইউরোপে পাড়ি জমান। চুক্তিবদ্ধ হন সুইজারল্যান্ডের ক্লাব ইয়াং বয়েজের সঙ্গে। তবে সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। মাত্র ছয় মাস পরই নিজ দেশে ফিরে আসেন। ১৯৯১ সালে কোপা আমেরিকায় কলম্বিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ ও আত্মঘাতী গোল
ফুটবলারদের জীবনে ইনজুরি একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে এস্কোবারকেও। হাঁটুতে ভয়াবহ আঘাত পান তিনি। ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকা (এই টুর্নামেন্টে কলম্বিয়া তৃতীয় স্থান অর্জন করে) এবং ১৯৯৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচগুলো। এই সময়ে কলম্বিয়ান ফুটবলও একপ্রকার অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। তাদের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক মাদকসম্রাট পাবলো এস্কোবার পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

এই অবস্থায় ১৯৯৪ বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার আশাভরসার একমাত্র প্রতীক হয়ে ওঠেন আন্দ্রেস এস্কোবার। টুর্নামেন্টের আগেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি এবং টানা সাতটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। প্রতিটি ম্যাচে জয় দিয়ে প্রস্তুতি সেরে বিশ্বকাপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় লাতিন দেশটি। এর আগে ১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল দলটি। সেই সাফল্যও এবার তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছিল।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ রোমানিয়ার বিপক্ষে। দর্শকসহ সবাই ভেবেছিলেন, সহজেই জিতে যাবে কলম্বিয়া। কিন্তু ৩-১ গোলের ব্যবধানে হেরে যায়। অন্যদিকে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ওই গ্রুপের অন্য দুটি দল যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ড ড্র করে। দর্শকেরা আশা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে পরবর্তী ম্যাচ দুটি জিতলেই টুর্নামেন্টে টিকে থাকবে তারা।

দ্বিতীয় ম্যাচ ঐতিহাসিক রোজ বোল স্টেডিয়ামে, স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। দর্শকদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ-উৎকণ্ঠা। সেই উৎসাহ হয়তো মানসিক চাপ হয়ে ধরা দেয় কলম্বিয়ান ফুটবলারদের মধ্যে! যার দরুন প্রথমার্ধেই একটি আত্মঘাতী গোল করে বসেন আন্দ্রে এস্কোবার। ১-০ পিছিয়ে পড়ে কলম্বিয়া। দ্বিতীয়ার্ধের ৫২ মিনিটে কলম্বিয়ার জালে আরেকটি গোল করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়ারনি স্টুয়ার্ট। ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে কলম্বিয়া। ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের জালে এক গোল পরিশোধ করতে পারলেও তা পয়েন্ট এনে দিতে পারেনি লাতিন দেশটিকে। তৃতীয় ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় পেলেও বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয়ে যায় কলম্বিয়ার।

ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজিক ঘটনা আন্দ্রেস এস্কোবার হত্যাকাণ্ড
ছবি: সংগৃহীত

আন্দ্রেস এস্কোবার হত্যাকাণ্ড
আত্মঘাতী গোলের পর কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন এস্কোবার। বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পর মিয়ামিতে ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। পরবর্তী সময়ে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কলম্বিয়ায় ফিরে যান। তাঁর বাল্যকালের বন্ধু জুয়ান জাইরো গ্যালিয়ানোর ভাষ্য, ‘যখন আন্দ্রেস বাড়ি ফিরে আসে, সে হতাশ ছিল। একই সঙ্গে আশাবাদীও ছিল। কারণ, সে জানত আত্মঘাতী গোল করে কোনো অপরাধ করেনি। এমনকি তাকে খুবই শান্ত এবং শক্তিশালী দেখাচ্ছিল।’

মেডেলিনে ফিরে আসার এক দিন পরই গ্যালিয়ানো ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে একটি নাইট ক্লাবে যান এস্কোবার। তাঁরা যেখানে বসেছিলেন, তার পাশের টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন মাদক ব্যবসায়ী ডেভিড ও সান্তিয়াগো গ্যালন। এস্কোবার হত্যা মামলার প্রসিকিউটর জেসুস আলবেইরো ইয়েপেসের ভাষ্য, ‘ডেভিড ও সান্তিয়াগো গ্যালনের সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। তারা সবাই এস্কোবারকে উদ্দেশ করে বারবার বলছিল, “আত্মঘাতী গোল আন্দ্রেস, আত্মঘাতী গোল”। সারা রাত আন্দ্রেস অস্বস্তিতে ছিল। যখন সে নাইট ক্লাব থেকে বের হয়ে নিজের গাড়িতে গিয়ে বসে, পার্কিং লটে তার সঙ্গে তর্ক করা ওই লোকগুলোও আছে। আন্দ্রেস তাদেরকে চলে যেতে বলেছিল এবং স্বীকার করে, আত্মঘাতী গোলটি তার অজ্ঞাতসারে করা একটি ভুল। তখনই ওই লোকদের একজন বন্দুক বের করে এবং ছয়বার গুলি চালায়। আন্দ্রেসের রক্তাত্ব দেহ গাড়িতে ফেলে রেখে লোকগুলো পালিয়ে যায়।’ হাসপাতাল নেওয়ার পর আন্দ্রেস এস্কোবারকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

সন্দেহভাজন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে খুব বেশি সময় লাগেনি পুলিশের। কলম্বিয়ার একটি শক্তিশালী মাদক সংগঠনের দেহরক্ষী হেমবারতো ক্যাস্ট্রো মুনিজ নামের একজন হত্যার দায় স্বীকার করে। তাঁকে ৪৩ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। যদিও মাত্র ১০ বছর পরই কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন তিনি।

আন্দ্রেস এস্কোবার হত্যারহস্য নিয়ে অনেক ধরনের কথা প্রচলিত রয়েছে। কেউ মনে করেন, সে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল। যদিও হত্যা মামলার প্রসিকিউটররা বিশ্বাস করেন, ডেভিড ও সান্তিয়াগো গ্যালনের নির্দেশেই আন্দ্রেস এস্কোবারকে হত্যা করে ক্যাস্ট্রো মুনিজ। কারণ, গ্যালন ভাইয়েরা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ম্যাচে জুয়া খেলে প্রচুর অর্থ হারায়। সেই ক্ষোভে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। মামলার প্রসিকিউটর জেসুস আলবেইরো ইয়েপেস তাঁদেরকে সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

সূত্র: গোল ডটকম