‘সুতপার ঠিকানা’ আমাদের কাছে একটা বোধ–উত্তীর্ণ চিরকুট রেখে যায়। তা হলো, যার কোনো ঠিকানা নেই, তারও একটা ঠিকানা আছে। এই মহাপৃথিবীর বুকে তার নাম অস্তিত্বের উন্মোচন।
শিরোনামে ‘ঠিকানাহীনা’ শব্দটা লিখে কি ভুল করলাম? নিজের মনে প্রশ্ন জাগল। পরক্ষণেই মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথ তো লিখেছিলেন, ‘...দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে’। আজ তো আমিও এক তুলনাহীন নারীর কথা লিখতে বসেছি। চলচ্চিত্রের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র, নাম সুতপা। সব নারীর জীবনের প্রতিচ্ছবি এই নারীর জীবনের লড়াইকে কেন্দ্র করে অতুলনীয় চলচ্চিত্রটি আমাদের উপহার দিয়েছেন সুজ্ঞানী ঋত্বিকবোদ্ধা চলচ্চিত্র পরিচালক প্রসূন রহমান।
আবার সব নারীর জীবনের প্রতিচ্ছবিই যদি হয়, তবে তুলনাহীন হয় কী করে? আসলে পুরুষতান্ত্রিক বা পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেক নারীর অবস্থান, জীবনসংগ্রাম তো একই রকম। তার মধ্যেও ব্যক্তিবিশেষে লড়াই করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর ঘটনাগুলো আলাদা আলাদা হয়। সুতপাও সেভাবেই অনন্যা হয়ে ওঠে।
মেধাবী পরিচালকের এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মনোগ্রাহী আকর্ষণীয় দিকটি হলো, প্রাজ্ঞ আসাদুজ্জামান নূরের ধারাভাষ্য। এক অনিশ্চিত, লড়াকু সংগ্রামী জীবনের সূত্রধরের, কাব্যময় যাত্রাপথের ধারাভাষ্য। জীবনটা ফুলশয্যা নয় আমরা জানি; ফুল আর কাঁটার সমাহারে ক্ষত আর অক্ষতের জীবনটা অবশ্যই কবিতা। কিংবদন্তি অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে কবিতা শুনে মুগ্ধ হননি, এমন বাঙালি খুব কম আছে। সুতপার জীবনের ধারাভাষ্য কোথাও কবিতার মতো কিংবা কোথাও কবিতার মতো না হলেও সেই পাঠেরই আবেশ ছড়িয়ে দেয়। একটা জীবনের গণ্ডির চৌহদ্দিতে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। শেষ দৃশ্যের যাত্রাপথের মধ্য দিয়ে এক নারীজীবনের যাত্রাপথের প্রতিটি অধ্যায়কে এখানে তুলে ধরা হলো। কারণ, শেষ হয়েও হয় না শেষ। যতক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রতিটি অন্তিম থেকে শুরু করার নামই হলো জীবন।
বাঙালি জীবনে রেলযাত্রা আমরা অপু-দুর্গার চোখ দিয়ে দেখতে শিখেছিলাম। এই চলচ্চিত্রেও রেলযাত্রাকে জীবনের প্রতিরূপ হিসেবে কাব্যে পরিণত করেন পরিচালক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গোটা যাত্রাটাই একটা রেলযাত্রা। ট্রেনকে শেষ পর্যন্ত কোথাও গিয়ে থামতে হয়, জীবনকেও। আবার সেই স্টেশনকে অতিক্রম করার নামও জীবন। এখানে সুতপা যেমন দিশাহীন হয়ে ট্রেনে উঠেছিল, কোথায় গিয়ে নামবে, তা জানত না; জীবনের যেন কোনো গন্তব্যপথ খোলা ছিল না। অথচ শেষ স্টেশন আসার আগেই অচেনা–অজানা স্টেশনে নেমে পড়ল। এই স্টেশনে কোথায় যাবে? কার বাড়িতে উঠবে? কীভাবে অন্ন জুটবে, কিছুই তার জানা নেই। তবে এটুকু নিশ্চিত, মরবে বলে সে এখানে নামেনি। বৃদ্ধ বয়সে নতুন করে লড়াই শুরু করে বাঁচবে বলে নেমেছে। জীবনের একটা ঘড়ি তাকে আবার দুঃসহ সময়ের স্রোতে হৃৎস্পন্দন হয়ে অসীম শূন্যতার ভেতর মাটির বুকে চরণের ছাপ রেখে যাওয়ার সুযোগ করে দিল।
নারী জীবন! মহলে দাসী-বাঁদির মতো থাকবে বলে পুরুষ তাকে ‘মহিলা’ বানিয়েছে! রমণের যোগ্য বলে পুরুষ তাকে রমণীয়, কামনীয়, রমণী করে তুলেছে। সুতপার দুরন্ত শৈশব দোল খায়, গ্রামের মেঠো পথে পথে ধান, ঘাস, লতাপাতা, ফুল, ফলগাছের সঙ্গে সখীর মতো মায়ে–ছায়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়ায়। সুতপা বেড়ে ওঠে। দুরন্তপনা ছাড়ে না। সব মায়ের মতোই মা তাকে বোঝায়, এত বড় মেয়ে, এমন ধেই ধেই করে ঘুরে বেড়ায় না। কিন্তু মন যে তার আবদ্ধ ঘরের জেলখানায় টেকে না। স্বপ্ন দেখে, পড়াশোনা করে একদিন অনেক বড় হবে। আকাশে ডানা মেলবে।
তা সত্ত্বেও বিয়ে নামক শিকলে বন্দী হতে হয় সুতপাকে। মেয়ে দেখতে মুরব্বি নামক পাত্রপক্ষ চিরকাল যেসব বেলেল্লাপনা করে, সুতপার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় না। সুতপা কোরআন তিলাওয়াত করে, ইংরেজি অনুবাদ পারে, জলে ভেজা মাটির ওপর সতর্ক কদমে হেঁটে পুরুষের লকলকে, ছোঁকছোঁকে দৃষ্টির সামনে এপাশ–ওপাশ ধপাস না হয়ে বিএ পাস করে যায়। এই পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক মানসিকতার পাত্রপক্ষের মধ্যে সমাজের উচ্চশিক্ষিত নামক স্কুলশিক্ষক প্রতিনিধিও ছিলেন যিনি সবার সামনে একটি নিরীহ মেয়েকে অনুবাদ জিজ্ঞাসা করেন। পাস করার পর তিনিও নিজের পৌরুষসত্তাকে জয় করে নেন।
এসব নতুন কিছু নয়। তবে সুতপার স্বামীটিও সুতপার মতোই নিরীহ ও শান্ত প্রকৃতির। মেয়েদের ওপর স্বামীর অত্যাচার, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার—সুতপাকে এসব পোহাতে হয়নি। গ্রাম থেকে বধূকে শহরের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে চাকরিজীবী স্বামী। প্রণয়ের বাহুডোরে ভালোই চলছিল ছোট্ট কুঠুরির দুটি পাখির সংসার। একে একে দুই, দুই থেকে তিন হয়। কোল আলো করে সন্তান আসে সংসারে। চারা বড় হতে থাকে।
হঠাৎ স্বামীর বুকে ব্যথা। অফিসফেরত বিছানায় ঢলে পড়ে, আর ওঠে না। গ্রামের কবরে শায়িত হয় দেহ। সুতপা এবার একা, সন্তান বড় করার সব ভার তার কাঁধে। চিঠি আসে, সরকারি আবাসন ছেড়ে দিতে হবে। অথই জলে পড়ে যায় মেয়ে। ভাই এসে তাকে বাপের বাড়িতে নিয়ে যায়। ভাইবোন আর ভাগ্নেকে আগলে রাখে সুতপা। কিন্তু ভাইয়ের বউ এসব মেনে নিতে পারে না। কথায় কথায় মুখঝামটা খেতে খেতে বড় হয়ে ওঠে সুতপার সন্তান।
এ ক্ষেত্রে সুতপা চাকরি করে সন্তান মানুষ করতে পারত। একেবারে নিরক্ষর তো সে নয়। অনেক নারীই স্বামীর মৃত্যুর পর বা সম্পর্কে বিচ্ছেদের পর একা একাই সন্তানকে বড় করেন। পরিচালক ১২ বছর ধরে সুতপাকে সেভাবে লড়াই করতে দেখালেন না। হয়তো পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থানকে দীর্ঘ পরিসরে দেখাবেন বলে।
ছেলে বড় হয়ে চাকরি না করে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে স্বাধীন ব্যবসা করতে চায়। সুতপার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্তানের পৈতৃক জমি বিক্রি করে সেই টাকা জোগাড় করতে হয়। এবার সন্তান নিজের টাকায় কেনা নতুন একটা ফ্ল্যাটে মাকে নিয়ে যায়। লাল টুকটুকে একটা বউ নিয়ে আসে ঘরে। শাশুড়ি বউকে অত্যাচার করবে, সুতপার মতো নিরীহ মেয়ের ক্ষেত্রে তা হওয়ার নয়। নিজের মেয়ের মতো বউকে কাছে টেনে নেয়। উল্টোদিকে বউ শাশুড়িকে অত্যাচার করবে, এখানে তা–ও হলো না। সুন্দর বউটি শাশুড়ির খুব সেবাযত্ন করে।
‘সুতপা’ চরিত্রে অপর্ণা ঘোষ অসাধারণ প্রতিভায় টেনে নিয়ে গেলেন গোটা গল্পটা।
বাদ সাধল বেয়াইন এসে। মেয়ের বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে মেয়ের বাড়িতে থাকতে এসেছে মেয়ের মা। সুতপা খুব ভালোভাবেই নিয়েছিল বেয়াইনকে। কিন্তু বেয়াইন একদিন বলে বসল, ‘আমি কটা দিন এখানে থাকব, আপনি বরং ভাইয়ের বাড়িতে যান।’ এ কথায় সুতপার আত্মসম্মানবোধে লাগে। তার মতো আত্মমর্যাদাবোধপূর্ণ নারীর আত্মসম্মানবোধে কাঁটা লাগলে প্রতিক্রিয়া তো দেখা দেবেই। কিন্তু এই নারী এমনই যে বেয়াইনকে কোনো রকম কটূ কথা না বলে, অসম্মান না করে, নিজেই চুপচাপ কাউকে কিছু না জানিয়ে কাপড়চোপড়, স্মৃতিবিজড়িত ছবি—সব গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। স্টেশন থেকে শুরু হয় অজানার উদ্দেশে যাত্রা।
ছেলের সমবয়সী সহযাত্রী টুকটাক কথা বলে আলাপ জমাতে চায়। অথচ আত্মগোপন করে থাকা নারী কিছুই প্রকাশ করতে রাজি নয়। একসময় বলে ওঠে, কোথায় যাবে, কোথায় নামবে, সত্যিই সে কিছু জানে না। দেবরের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, যদি আগে মারা যায়, স্বামীর কবরের পাশে তার কবর হবে। এখন সে জায়গাও অনিশ্চিত।
জীবন আর মরণের মাঝখানে এখন একেবারে একটা ঝুলন্ত সাঁকোর ওপর এসে দাঁড়িয়েছে সুতপা। আমরাও বাক্রুদ্ধ। এ রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করে পরিচালক আমাদেরও স্তব্ধ করে দিয়েছেন। কবর একটা মানুষের অন্তিম ঠিকানা। সেই ঠিকানারও মাটি অনেকের জন্য থাকে না। কী হতে চলেছে? কী হতে পারে? অনেক কিছুই ভাবার অবকাশ থেকে যায়। কিন্তু দীর্ঘ যাত্রার পর অন্তিম স্টেশন আসার আগেই ঘটে গেল উত্তরণ। মৃত্যুর ওপারে যে বাস্তবের জীবন, দুবেলা মরার আগে না মরতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকেও এক বৃদ্ধ নারীর জীবনপথে ঘটে গেল ভিন্ন জাগরণ।
‘সুতপা’ চরিত্রে অপর্ণা ঘোষ অসাধারণ প্রতিভায় টেনে নিয়ে গেলেন গোটা গল্পটা। কোথাও কোথাও অভিনয় একটু আড়ষ্ট লেগেছে। একটা মানুষের জীবনের সব কটা বাঁক–প্রতিবাঁককে বয়সের সঙ্গে ধরে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য। সব সময় মুখে সংলাপ না দিয়ে ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিচালক সুতপাকে বেশ সুযোগ করে দিয়েছেন। অবশ্য নীরব অভিনয়েও অপর্ণা তুলনাহীন। বৃদ্ধ বয়সের সুতপার রূপসজ্জাশিল্পীকেও ধন্যবাদ জানাতে হয়। কাঁচাপাকা চুলের সুতপাকে এত সুন্দর রূপ দিলেন তিনি, ভারতে হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘আরাধনা’ চলচ্চিত্রের শর্মিলা ঠাকুরকে মনে পড়ছিল। সেই চলচ্চিত্রেও এক নারীর জীবনযুদ্ধের গল্প আছে। অবিবাহিতা শর্মিলার অপরূপ সুন্দর লাবণ্য আর তাঁর পাশে বৃদ্ধ জীবনদীর্ণ শর্মিলাকে রূপসজ্জাশিল্পী অনবদ্য রূপ দিয়েছিলেন।
‘সুতপার ঠিকানা’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, সংলাপ থেকে শুরু করে ক্যামেরার ভাষা, দৃশ্যপট নির্মাণ—সবই বেশ উচ্চ মানের। কুমার বিশ্বজিতের সুরারোপ অবশ্যই এই ইতিহাস হতে বসা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল বাতিস্তম্ভ হয়ে থাকবে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম শহরে কৈশোরযাপনে কুমার বিশ্বজিতের একটি গান অন্য অনেকের মতো আমিও মনে মনে গুনগুন করতাম। ‘তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে…’ গানটা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্ভবত একটা শেভিং ব্লেডের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রের মূল ভাবটিকে বজায় রেখে সুরারোপ করার ক্ষেত্রে তিনি সফল।
‘সুতপার ঠিকানা’ আমাদের কাছে একটা বোধ–উত্তীর্ণ চিরকুট রেখে যায়। তা হলো, যার কোনো ঠিকানা নেই, তারও একটা ঠিকানা আছে। এই মহাপৃথিবীর বুকে তার নাম অস্তিত্বের উন্মোচন।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত