‘জলবায়ু কন্যা’ নাম শুনেই খানিকটা আঁচ করতে পারা যায় বইটা কী সম্পর্কে হতে পারে। বইটিতে তরু ও লতা নামে যমজ ভাইবোনের খুনসুটি দিয়ে শুরু হয়। দুজনই পড়াশোনায় ভালো।
উপন্যাসের শুরুতেই গার্লস স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষককে দেখতে পাই, যিনি দায়িত্ব পান বিতর্ক প্রতিযোগিতার। স্কুলে তিনি বিষয়টি জানান এবং বাছাই করেন কে কে থাকতে পারবে প্রতিযোগিতায়। বিতর্কের বিষয় নির্ধারিত হয়, ‘জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ করতে পারি শুধু আমরাই।’
শিক্ষার্থীরা জলবায়ু বিষয় শুনে পিছিয়ে গেলেও কয়েকজন আগ্রহী নাম লেখায় তাদের। তারা দশম শ্রেণির লতা, ছন্দা ও মালা। প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে ও ক্লাস শেষে ওরা জলবায়ু নিয়ে আলোচনা করতে থাকে, বই-নোটস দেয় এবং সর্বোপরি একে অপরকে মনোবল জোগাতে থাকে।
লতা তার নানুভাই সাঈদ সাহেবের কাছেও কথা বলে জলবায়ু বিষয়ে জানার জন্য। এভাবে সে জানা-অজানা অনেক তথ্য পেয়ে যায়।
উপন্যাসের শেষ অংশে দেখতে পাই, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। অবশেষে তথ্যবহুল বক্তব্য উপস্থাপন, যুক্তি প্রদর্শন ও খণ্ডন, ভাষার দক্ষতা, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি দেখে লতাকে শ্রেষ্ঠ বক্তা ঘোষণা করে এবং জয়লাভ করে।
চরিত্রায়ণ
লতা: কিশোরী লতা দশম শ্রেণির ছাত্রী। অজানাকে জানার, শেখার অদম্য ইচ্ছাশক্তি রয়েছে তার। পুরো উপন্যাসে তার মেধা, বাচনভঙ্গি, চঞ্চলতা, সাহসিকতা, ধৈর্যশীলতা, বন্ধুত্বপরায়ণ বজায় রেখেছে।
তরু: উপন্যাসের শুরুতে খুনসুটিতে মেতে থাকলেও পরে তাকে দায়িত্বশীল ভাই হিসেবেই দেখা যায়।
সাঈদ সাহেব: তরু ও লতার নানা হচ্ছেন সাঈদ সাহেব। তিনি লতার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথা শুনে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।
ফয়জুল ও নাজমা: তরু ও লতার বাবা-মা এনারা। অন্যান্য বাবা-মায়ের মতোই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় ছাড় দিতে রাজি নন।
ছন্দা ও মালা: ছন্দা কিছুটা ভিতু স্বভাবের হলেও একদিন রিহার্সাল করেই সে আর ততটা ভয় পায় না। আর মালাকে প্রথম থেকেই কিছুটা আশাবাদী দেখা যায়।
উপন্যাসটি পড়া শুরু করি শেখার প্রত্যয়ে। ধরেই নিয়েছিলাম জলবায়ুসম্পর্কিত খুঁটিনাটি প্রয়োজনীয় সব তথ্য জানতে পারব, আর হয়েছেও তা–ই। চমৎকার একটি কিশোর উপন্যাস। প্রতিটি চরিত্র এত গোছালোভাবে সাজানো। নিঃসন্দেহে শিশু-কিশোর-বয়োবৃদ্ধ সবাই পছন্দ করবে পড়তে। কোনো চরিত্রই অপ্রয়োজনীয় মনে হবে না বা পড়তে একঘেয়ে লাগবে না।
এ ছাড়া বিতর্ক প্রতিযোগিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি আর ভেবেছি কৈশোরে যদি এমন বান্ধবী পেতাম, যারা সাহস দেবে, বই দিয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে। এমন শিক্ষক যদি পেতাম, গর্ব করার মতো কাজ অবশ্যই করতে পারতাম। এমন সাপোর্টিভ বড় ভাই যদি পেতাম। আর শিক্ষকতুল্য নানুকে পেতাম, যিনি এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ, ধৈর্য ধরে দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করলেন নাতনিকে বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্য। সত্যিই ধন্য হতাম, আর পড়ার সময় লতার জায়গায় নিজেকে দেখছিলাম যেন, একজন সফল কিশোরী বিতার্কিক রূপে। যে পরিবেশ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে, পরিবেশকে ভালোবাসে এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মানতেই হবে এই কিশোর-কিশোরীদের হাত ধরেই আমরা সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারব ইনশা আল্লাহ।
বইয়ের কিছু উল্লেখযোগ্য লাইন
‘গল্পবাজ, গল্পবাজ বলছিস, যেদিন আমি থাকব না সেদিন বুঝবি গল্পবাজের কদর।’
‘আমার সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পদ দিয়ে আশপাশের দশটি গ্রামে দশটি নলকূপ স্থাপন করে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার জন্য দান করে গেলাম।’
‘তোকে কেউ হারাতে পারবে না, বয়েজ স্কুল জিতলে বলবি আমাদের স্কুল জিতেছে আর গার্লস স্কুল জিতলে বলবি আমার বোন জিতেছে। তোর তো দুদিকেই জেতা।’
‘পৃথিবীর উপরিভাগের পানি যাকে আমরা সারফেস ওয়াটার বলি। মানুষকে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে পৃথিবীর উপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।’
‘দেশের সব নদী গভীর করতে হবে, দুপাড় উঁচু করে বাঁধ দিতে হবে, কিছুদূর পরপর নদী থেকে কৃত্রিম শাখা বের করে ড্রেন, সাবড্রেন করে সেই পানি দিয়ে কৃষিকাজ করতে হবে।’
‘মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ধারণের একটা সীমা আছে, সেই সীমা অতিক্রম করলে তো মানুষ মারা যাবেই। এটা আগে ছিল না। ইদানীং শোনা যাচ্ছে হিটস্ট্রোকে মানুষ মারা যাচ্ছে। এটাও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে।’
‘সময় এসেছে সন্তানদের একাডেমিক শিক্ষার বাইরেও যে বিশাল জ্ঞানভান্ডার আছে, সন্তান লালন-পালনের উদ্দেশ্য যে শুধু সরকারি চাকরি করার জন্য নয়, সেটা অনুধাবন করার। সন্তানদের শেখানোর সময় এসেছে লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়ার।’
একনজরে
বই: জলবায়ু কন্যা
লেখক: জিল্লুর রহমান
ধরন: কিশোর উপন্যাস
প্রকাশনী: অন্বেষা প্রকাশন
প্রকাশকাল: অমর একুশে বইমেলা ২০২৫
প্রচ্ছদ: আল নোমান
মূল্য: ২৭০
পৃষ্ঠা: ১১২
সাধারণ সম্পাদক, গাইবান্ধা বন্ধুসভা