বৃষ্টি দেখি, নাকি স্মৃতি খুঁজি

বৃষ্টিফাইল ছবি

বাইরে ঝুম বৃষ্টি! এত দিনের দাবদাহে ঝলসে যাওয়া জনজীবনে একটু শীতলতার পরশ দিতে আকাশ যেন পরম মমতায় তার বুক খুলে দিয়েছে। বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। গ্রিলের ফাঁক গলে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা এসে শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ এক অন্য রকম অনুভূতি।

পাশের বাসার আঙ্কেল তাঁর ৮-১০ বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভিজছেন। নিজ হাতে লাগানো গাছগুলোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে রাখছেন। আঙ্কেলদের বাসার পাশের ফাঁকা প্লটে পানি জমে ছোটখাটো একটা পুকুর হয়ে গেছে, আশপাশের বাচ্চারা সেই পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। কিছু কিছু পথচারী প্রয়োজনের তাগিদে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ছাতা মাথায় এদিক–সেদিক যাচ্ছেন। আমার থেকে কয়েক হাত দূরে জানালার গ্রিলে বসে কয়েকটি চড়ুই ডানাঝাপটে ভিজে যাওয়া পালক শুকাচ্ছে আর কুইকুই আওয়াজ করে একে অন্যের পাশ ঘেঁষে বসছে। দেখে মনে হচ্ছে, ওদের বেশ শীত লেগেছে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখছি। হঠাৎ বড় ভাইয়ের মেয়ে কোথা থেকে যেন দৌঁড়ে এসে আমার হাত ধরে একপ্রকার টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেল, ভেজার জন্য। আজ ছাদের গাছগুলোকে অনেক সবুজ আর প্রাণবন্ত লাগছে। বৃষ্টির পরশ পেয়ে গাছগুলোও যেন নব আনন্দে জেগে উঠেছে, সদ্যফোটা গোলাপ আর আলকানন্দার গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা জমে মুক্তার দানার মতো ঝলমল করছে। আশপাশের ছাদগুলোতেও বৃষ্টিতে ভেজার উৎসব লেগেছে। কচিকাঁচা আর বুড়ো-খোকা—সবাই এই উৎসবে অংশ নিয়েছে। আমিও বাচ্চাদের মতো ওদের সঙ্গে ছাদে জমে যাওয়া পানিতে লাফাচ্ছি, দৌড়াচ্ছি, ভিজছি। শেষ কবে নিজে থেকে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, ঠিক এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।

স্কুল-কলেজে থাকাকালে বৃষ্টি হলে অনেক ভিজতাম, কারণে-অকারণে ভিজতাম, সময়ে-অসময়ে ভিজতাম। এমনও হয়েছে, বৃষ্টির মধ্যে বাড়িতে ফেরার জন্য গাড়ি অথবা দাঁড়ানোর জায়গা থাকা সত্ত্বেও ব্যাগ কাঁধে এবং চটিযুগল হাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়িতে ফিরতাম। চায়ের দোকান, শপিং কমপ্লেক্স কিংবা যানবাহনে থাকা উৎসুক জনতা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ভেবে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত; অবশ্য সেই সময় আমাকে নিয়ে কে কী ভাবছে, তা নিয়ে ভাবার ফুরসত ছিল না। একমনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গন্তব্যের দিকে হেঁটে যেতাম। এসব নিয়ে মা–বাবার কত যে বকা খেয়েছি, তার হিসাব নেই। অথচ এখন বকা দেওয়ার মানুষ নেই, কিন্তু আর ভেজা হয় না। সময়গুলো এভাবেই হারিয়ে যায়, আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের শারীরিক ক্ষমতা, মানসিক শক্তি। হরেক রকম অজুহাত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে, ভয়েরা এসে দখলদারি নিয়ে নেয় মনের। আমরা তখন ভয় আর অজুহাতকে সঙ্গে করে সুস্থ থাকার আশায় বেঁচে থাকতে শুরু করি।

বনশ্রী, ঢাকা