রোকেয়া দিবস ও বেগম রোকেয়ার সংগ্রাম

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনফাইল ছবি

১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়। তার আগপর্যন্ত সেটা ছিল নারীদের কাছে নিষ্ঠুর ও সর্বোচ্চ নির্মম কাজ। তবু তা চলে আসছিল; রাজা রামমোহন রায়ের মতো কিছু মানুষ এর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ান। বিধবাবিবাহ প্রচলনও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। যুগে যুগে যত নিষ্ঠুর প্রথার আবির্ভাব ঘটেছে, যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিহ্ন বলে পরিচিত; তার সবই নারীদের শোষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের মঙ্গলের জন্য ছিল কেবল অন্দরমহল।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের হাত ধরে নারীরা ভাঙার সাহস পেয়েছিলেন বন্দী দেয়াল। নিজের অধিকার আদায়ের কথা বলার শক্তি জুগিয়েছিল বেগম রোকেয়ার রচনা। নারীরা যে পুরুষের দাসীমাত্র নন, অর্ধাঙ্গিনী, সে কথা বুঝতে শিখেছিলেন তাঁর হাত ধরেই। শত বছর আগে নারীদের ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্নবীজ তিনি বুনেছিলেন, আজ আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই। বিশ্বনেতৃত্বে ক্ষমতায়নে আজ নারীর জয়জয়কার। এটাই হয়। স্বপ্ন দেখান একজন। সেই স্বপ্ন হাজার চোখে ঘুরতে ঘুরতে কোনো এক সময় তা বাস্তবে রূপ নেয়। বেগম রোকেয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। ‘সুলতানাস ড্রিম’ বা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বেগম রোকেয়ার এক অনন্য সৃষ্টি। নারীবাদী সাহিত্যে, নারী চেতনার জাগরণে এটি অন্যতম রচনা। এ ছাড়া ‘অবরোধবাসিনী’, ‘পদ্মরাগ’, ‘মতিচূর’ ইত্যাদি গ্রন্থেও তিনি তাঁর চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন নিপুণভাবে।

আজ থেকে ১০০ বছরের বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়া যে সাহসিকতা, উদার মনোভাব দেখিয়েছেন, তা আজও নারীদের অগ্রযাত্রায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়।

রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রাম। ১৮৮০ সাল। নারীরা আজও জন্ম নেন, তখনো জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে পার্থক্য বিশাল। আজ নারীরা ঘরের কাজ আর বাইরের কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারছেন। মাতৃদায়িত্ব থেকে শুরু করে মহাকাশে কাজ করে চলেছেন। কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যখন অপসংস্কৃতি ও নারীবিদ্বেষী নিয়মের বেড়াজালে বন্দী ছিলেন, তখন বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। সমাজের কাঠামো এমন স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছিল, যেখানে নারীদের কঠোর নিয়মের মধ্যে জীবন যাপন করতে হতো। জ্ঞানতৃষ্ণা পূরণ করাও বেশ দুরূহ ছিল। বেগম রোকেয়াকে নারী আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়। কেন তাঁকে অগ্রদূত বলা হয়, তা তাঁর জীবন আলোচনা থেকেই বোঝা যায়। তিনি যে সময় জন্ম গ্রহণ করেন, সে সময় ইংরেজি শিক্ষা তো বহুদূরের কথা, মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণই ছিল নিষেধ। মেয়েদের কাজ ছিল সন্তান জন্মদান, লালন-পালন ও গৃহের কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি নিজ পরিবারেও মতামত প্রকাশ করা ছিল কঠিন কাজ। বাইরের জগতে বের হওয়ার সুযোগও ছিল খুব কম। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করলেন, বাইরের পৃথিবীটা তাঁর জন্য নয়। সেটা শুধুই পুরুষদের দখলে। তাঁকে ঘরের ভেতরই আরবি ও উর্দু শিক্ষা দেওয়া হলো। জ্ঞানের নেশা যাঁকে পেয়ে বসে, তাঁকে থামানো যায় না। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম ছিলেন আধুনিক মনস্ক। তিনিই বেগম রোকেয়াকে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। তবে তা পরিবারের অন্য সদস্যদের অন্তরালে।

আজ থেকে ১০০ বছরের বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়া যে সাহসিকতা, উদার মনোভাব দেখিয়েছেন, তা আজও নারীদের অগ্রযাত্রায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। নারীরা যে কেবল ভোগের সামগ্রী নন, সে কথা তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে গেছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণায় তখনকার নারীদের চেয়ে ছিলেন অনেক অনেক এগিয়ে। এমনকি আজকের আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও অনেক নারী তাঁর অধিকারের কথা বলতে দ্বিধা করেন। অথচ বেগম রোকেয়া বুঝিয়ে গিয়েছিলেন যুগ কোনো বাধা নয়, বাধা হলো ইচ্ছাশক্তি, প্রকাশ করার মানসিকতা। তিনি সামাজিক ও সাংগঠনিক কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।

বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন থেকে প্রসারিত হওয়া নারী অধিকার বাস্তবায়নের আজ অনেকটা পথ এগিয়ে চলেছে। যদিও সেই ভোগবাদী মানসিকতা আজও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবু নারী অধিকার আদায়ে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, সে কথা বলাই যায়।

পাবনা সদর, পাবনা