অদম্য কিশোর খোরশেদ আলম ও মুক্তিযুদ্ধ

বীর মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম দেওয়ান
ছবি: সংগৃহীত

চারদিকে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। কূটকৌশল শুরু করে তৎকালীন পাকিস্তানের অবৈধ সরকার। পূর্ব পাকিস্তানে বাড়তে থাকে ইপিআর সদস্যদের আনাগোনা। দেশবিরোধী বনে যায় অনেকে। দেশে শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খল সময়। ভয়ে কাতর হয়ে পড়েন অনেক নাগরিক।

তবে এত কিছু সত্ত্বেও ভয় পাননি লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোর খোরশেদ আলম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ভাষণ রেডিওতে শোনেন কিশোর খোরশেদ। মাথায় ঘোরে নানা চিন্তা। মনে পড়ে ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) কর্মরত বাবার কথা। বাবা সুবেদার মেজর লনিমিয়া দেওয়ান তখন চট্টগ্রামের হালিশহর সেনা ক্যাম্পে কর্মরত। বাবাকে দেখতে ১৫ মার্চ ছুটে যান চট্টগ্রামের হালিশহর। পরদিন সকালে দেখলেন ১০-১৫ জন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের একটি গাড়ি। সুবেদার মেজর লনিমিয়া দেওয়ানসহ অন্য সৈন্যরা তাঁদের সালাম দিলেন। এদেশীয় এক ইপিআর সদস্য তখন বলে ওঠেন, ‘নতুন অনেক পাকিস্তানি সেনা আসতেছে। দেশে কিছু একটা মনে হয় হবে।’ বাবার পরামর্শে তিন দিন পর ১৮ মার্চ কিশোর খোরশেদ রায়পুরে ফিরে আসেন।

কৌতূহলী হয়ে এক মধ্যবয়স্ক লোকের কাছে জানতে চান, বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় থাকেন? মূলত বাবাকে দেখার জন্য তাঁর এই কৌতূহল। তখন মুক্তিযোদ্ধারা জিজ্ঞেস করেন, বাবাকে দেখলে তিনি চিনতে পারবেন কি না। তাঁরা আরও জানতে চান, খাওয়াদাওয়া কোথায় হচ্ছে? অকপটে জানান, শরণার্থীশিবিরে।

১৯ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত বাড়িতে অবস্থান করেন খোরশেদ। পরে ১৩ মে একা পৌঁছান ফেনীর শুভপুর সীমান্তে। শুভপুরের পাশের বাজারে একটা ক্যাম্পে থেকে একা চলে যান ভারতে। দেশটির শ্রীনগরের একটি ক্যাম্পে পৌঁছান। গিয়ে দেখেন, সেখানে অনেক শরণার্থী। কৌতূহলী হয়ে এক মধ্যবয়স্ক লোকের কাছে জানতে চান, বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় থাকেন? মূলত বাবাকে দেখার জন্য তাঁর এই কৌতূহল। তখন মুক্তিযোদ্ধারা জিজ্ঞেস করেন, বাবাকে দেখলে তিনি চিনতে পারবেন কি না। তাঁরা আরও জানতে চান, খাওয়াদাওয়া কোথায় হচ্ছে? অকপটে জানান, শরণার্থীশিবিরে।

ভারতের শ্রীনগরের সেই ক্যাম্পে থেকেই রাইফেল চালানো ও গ্রেনেড ছোড়াছুড়ির প্রশিক্ষণ নেন কিশোর খোরশেদ। প্রশিক্ষণ চলাকালে একদিন সন্ধ্যায় বাবার সন্ধান পান। আবেগে জড়িয়ে ধরেন। চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে। কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পর চলে যান ভারত সীমান্তবর্তী শুভপুর (ভারত অংশ) অঞ্চলে। সেখানে অবস্থান করেন ৪৫ দিন। চালাতে শেখেন থ্রি নট থ্রি পিস্তল। দেড় থেকে দুই মাস পর ফিরে আসেন রায়পুরে। তবে এলাকায় ফিরলেও কেউ তাঁর ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানত না। তিনি তথ্য গোপন রেখে জানার চেষ্টা করেন—কেউ ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেবেন কি না। পরে বড় ভাই মোহাম্মদ আলম, জেঠাতো ভাই নজির আহম্মেদ, চাচা আয়াত উল্লাহ, মফিজ উল্লাহ, সেলামত উল্লাহকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।

তাঁদের পাঁচজনের সঙ্গে আরেকজন ছিলেন শফিকুর। অন্য আরেকজনের নাম স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর এসে স্মরণ করতে পারছেন না মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দুরন্ত এই কিশোর। পথিমধ্যে দেখেন একটি গাড়ি। সাতজন মিলে গাড়িতে উঠতেই বুঝতে পারেন, সেটা রাজাকারদের। ভয় পেলেও সাহস হারাননি। গাড়িতে আগে থেকেই ছিলেন রাজাকার কমান্ডার নজরুল। ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কই যাস তোরা?’ জবাবে তাঁরা বলেন, ‘মজুর হিসেবে ধান লাগাতে যাচ্ছি চৌমুহনী।’ গাড়ি চৌমুহনীতে পৌঁছালে তাঁদের নামিয়ে দেওয়া হয়। চৌমুহনী থেকে ফেনীর শুভপুর পর্যন্ত পরের রাস্তাটা হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেন তাঁরা।

রাত তখন আনুমানিক ১১টা। শুভপুর থেকে গেলেন ভারতের হরিণা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানে পরিচয় হয় আয়াতউল্লাহ নামের এক প্রশিক্ষকের সঙ্গে। তাঁর বাড়িও লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে। তাঁর মাধ্যমে জানতে পারেন, হরিণা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ আপাতত সম্ভব নয়। পরে তাঁরা পৌঁছান ভারতের পালাটনা নামের অন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানেও একই অবস্থা। জায়গা না পেয়ে ভারতের উদয়পুরের একটি দীঘির পাড়ে পড়ে থাকেন প্রায় দুই দিন। এরপর ওম্পিনগর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান নেন। সেখানে টুইনস মোটর, গ্রেনেড, থ্রি নট থ্রি পিস্তল চালনাসহ শেখেন যুদ্ধের নানা কৌশল। প্রায় এক মাস পর যান ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানে কিশোর খোরশেদকে দেওয়া হয় এসএমজি রাইফেল। এরপর আরেকটি ক্যাম্পে যান তাঁরা। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির দায়িত্বে ছিলেন রায়পুরের ৭ নম্বর বামনী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফজল মিয়া।

এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়। সেপ্টেম্বর মাস চলছে। দেশে তখন যুদ্ধ তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ দল দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। সঙ্গে থাকা শফিকুর কৌতূহলবশত পিস্তল লোড করতে গিয়ে ফায়ার করে বসেন। টের পেয়ে সতর্ক হয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। হানাদারদের সঙ্গে আধঘণ্টাব্যাপী লড়াই চলে। সেবার আর দেশে ঢুকতে পারেননি তাঁরা। আবারও ভারতে ফিরে যান। পরে একদিন গুপ্তচরের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান জেনে দেশে ফিরে আসেন। প্রথমেই আক্রমণ করেন লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের টাংকির হাট এলাকায়। ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টি হয়। সেই অপারেশনে তাঁদের সঙ্গে আরও অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পরবর্তীকালে জেলার রায়পুর-রামগঞ্জ অঞ্চলে আরও অনেক সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তাঁরা। শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে রায়পুর মুক্ত হয়। এর পরদিন ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর। ২ নম্বর সেক্টরের অধীন যুদ্ধ করেন তিনি। লক্ষ্মীপুর তখন নোয়াখালী জেলার অংশ ছিল। দেশ স্বাধীনের পর কিশোর খোরশেদ আলমের বাবা সুবেদার মেজর লনিমিয়া দেওয়ান বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বীর প্রতীক খেতাব পান। যুদ্ধে যোগ দিতে মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলমের অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর বাবা। সেদিনের সেই কিশোর এখন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। বাড়ি রায়পুর উপজেলার ১০ নম্বর রায়পুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামে। যুবক বয়সে বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে রায়পুর পৌরসভার টিসি রোডে ছেলের ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দোকানে বসে অবসর সময় কাটান।

বন্ধু, লক্ষ্মীপুর বন্ধুসভা