ঝালমুড়িওয়ালা

প্রতীকীছবি: দীপু মালাকার

প্রতিদিন বিকেলে বাসা থেকে বের হলেই একজন ঝালমুড়িওয়ালাকে দেখতে পাই।
চুল-দাড়ি সব পেকে গেছে। আশপাশের ছোট-বড় সব বয়সী ছেলেমেয়েকে দেখি— বিকেল হলেই তাকে ঘিরে ধরে। এই বৃদ্ধ ঝালমুড়িওয়ালাও আপনমনে ঝালমুড়ি বিক্রি করে চলে। বাচ্চাদের সঙ্গে মজাদার কৌতুক, হাসিঠাট্টায় মেতে থাকা মানুষটিকে প্রায়ই লক্ষ করি। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার কারণে ভাজাপোড়া খাওয়ায় মানা বলে ‘খাই খাই’ করেও আর খাওয়া হয় না। আম্মা সেদিন বললেন, ‘ওই লোকটার ঝালমুড়ি অনেক স্বাদের।’

সেদিন আকাশ কালো করে এসেছে। একটু পরেই আকাশ ভেঙে নামবে বৃষ্টি। গলির মোড়ে মাচা পেতে দাঁড়িয়ে থাকা ঝালমুড়িওয়ালা ঠিকই একা দাঁড়িয়ে। বৃষ্টি আসবে আসবে এমন আবহাওয়ার কারণেই হয়তো এই মুহূর্তে কোনো খদ্দের নেই। লক্ষ্য করলাম, মানুষটির দুই পাটির কোনোটিতেই দাঁত নেই। হাতের চামড়া আঙুলগুলোকে ঢেকে রাখলেও ঢাকতে পারেনি অভাবকে। নেহাত বিপদে পড়েই এই বয়সে ঝালমুড়ি বেচতে আসা।

গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা, কেমন আছেন?’ লোকটি হা করে বিপন্ন ভঙ্গিতে আকাশ দেখছিল। আমি যেতেই সম্বিৎ ফিরে বলল, ‘কত টাকার ঝালমুড়ি দেব?’ মৃদু হাসলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঝালমুড়ি না কিনলে কি আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে না?’ বেচারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল মনে হয়। বলল, ‘না না, কেন কথা বলা যাবে না! বলুন কী জানতে চান।’ ‘চাচা, আপনি এই বয়সে এখনো কেন ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন? বাচ্চাকাচ্চা নেই? আপনার ছেলেমেয়ে....’
এতদিন যার মুখে শিশুসুলভ হাসি লেগে থাকত আঠার মতো, তার সেই হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। মাথা নিচু করে জবাব দিল, ‘আছে, বাবা। সবাই আছে। সমস্যা হচ্ছে, থেকেও নেই।’ জানতে চাইলাম, ‘মানে?’ চাচা জবাব দিল, ‘ছেলেকে আইয়ে পাশ করানোর পর বিদেশ পাঠাইসিলাম ঋণ করে। অবৈধ হওয়ায় কিছুদিন জেল খেটে দেশে ফিরে আসে। ঢাকায় এক মেয়েকে বিয়ে করে এখন সে আমাদের কোনো খোঁজ রাখে না। এখনো ছেলের ঋণ টানতে হচ্ছে আমাকে। মেয়েকে পাঠাইসিলাম গার্মেন্টেসে। সেও দিনাজপুরের এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। এখন বাড়িতে দুই বুড়াবুড়ি। ঝালমুড়ি বেচেই দিনানিপাত করি।’ চাচা কথাগুলো বলছিল আর চোখ থেকে অশ্রুবৃষ্টি ঝরছিল।

সেদিনের আকাশের মেঘ শুধু মেঘ ছিল না। এক বৃদ্ধের অন্তরের মেঘও জমেছিল খুব করে। পরে বৃষ্টি হয়েছিল কিনা জানি না। কারণ, বিশ টাকার ঝালমুড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এর আগে বৃদ্ধ চাচার অশ্রুবৃষ্টিতে আমি ভিজেছিলাম, ভীষণ রকম ভিজেছিলাম।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেদিনের পর থেকে এই বৃদ্ধ ঝালমুড়িওয়ালকে আর আমাদের বাসার গলির মুখে দেখিনি!

নগুয়া, কিশোরগঞ্জ