হাসির বিড়ম্বনা

যখন বোর্ডিং স্কুলে পড়তাম, রুমমেটদের মধ্যে আমার হাসি নিয়ে বেশ আতঙ্ক ছিল। তারা আতঙ্কে থাকত, এই বুঝি আমি হেসে উঠি! রাতের বেলায় এই আতঙ্ক বেশি কাজ করত।

হাসির অলৌকিক এক ক্ষমতা আছে, যা দিয়ে খুব সহজেই মানুষকে মোহিত করা যায়। যাঁরা ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে অনর্গল কথা বলতে পারেন, তাঁদের কথা অন্যরা মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকেন। হাসি দিয়ে নাকি চাইলে বিশ্ব জয় করাও সম্ভব; কিন্তু এ কথাটা আমার বেলায় বড্ড বেমানান। ছোটবেলা থেকেই নিজের হাসি নিয়ে নানাভাবে বিড়ম্বনায় পড়েছি। অন্যের হাসির শব্দে মানুষের কানে প্রশান্তি জাগলেও আমার হাসির শব্দে মানুষের পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড় হতো।

যখন কোনো কারণে খুব হাসি পায়, তখন কোথায় আছি, কী করছি—এসব বেমালুম ভুলে বিকট শব্দে হো হো করে হাসতে থাকি। আমার বিশ্বাস, তখন যদি আশপাশে আলিফ-লায়লার জিনের বাদশাহও থাকে, সে–ও আমার হাসির শব্দ শুনে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পগারপার। ছোটবেলায় দাদা বলতেন, আমি নাকি ইবলিসের মতো শব্দ করে হাসি। জানি না, জীবদ্দশায় দাদার সঙ্গে ইবলিসের দেখা হয়েছিল কি না! তবে আমি নিশ্চিত, তিনি সরাসরি ইবলিসের হাসির শব্দ না শুনলেও আমার হাসির শব্দ শুনে আন্দাজ করেছেন ইবলিস মনে হয় এভাবেই হাসে।

যখন বোর্ডিং স্কুলে পড়তাম, রুমমেটদের মধ্যে আমার হাসি নিয়ে বেশ আতঙ্ক ছিল। তারা আতঙ্কে থাকত, এই বুঝি আমি হেসে উঠি! রাতের বেলায় এই আতঙ্ক বেশি কাজ করত। যে রুমে থাকতাম, ঠিক এক রুম পরেই গাইড টিচারের রুম ছিল। রাতে পড়াশোনা শেষে যখন গাইড টিচার আমাদের ঘুমানোর জন্য তাগাদা দিয়ে নিজে ঘুমাতে যেতেন, তখন আমরা জেগে উঠতাম এবং গল্প করতাম। এ সময় যদি কোনো কারণে আমার হাসি আসত, আমিসহ সবার পশ্চাৎদেশ লাল হতো; আমার পিলে চমকানো হাসি রাতের নীরবতার সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে আরও বিদঘুটে হয়ে যেত। হাসির শব্দ শুনে পাশের রুমে থাকা গাইড টিচার দুঃস্বপ্ন দেখেছেন ভেবে ঘুম থেকে উঠে এসে আমাদের পশ্চাৎদেশে জোড়া বেতের আঁকিবুঁকি করতেন।

এক মেয়ে বন্ধু আছে, ওরও আমার মতো হাসির ব্যামো আছে। আমরা একে অন্যকে ভালো বুঝতে পারতাম। আমার মন খারাপ থাকলে মাঝেমধ্যেই আয়োজন করে হাসার জন্য ওদের বাসায় যেতাম। দুজন যখন একসঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসতাম, মনে হতো জিনের বাদশাহ আর মালেকা-হামিরা একসঙ্গে হাসছে। এমন জঘন্য হাসির শব্দ আর অঙ্গভঙ্গি দেখে বান্ধবীর বড় আপু বলতেন, তোদের এই জীবনে বিয়েশাদি হবে না; মানুষ ভাববে তোদের মধ্যে জিন-ভূতের আছড় আছে।

পথচারীরা আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে পাগল ভেবে চলে যেত। মানুষের এমন আচরণ দেখে আরও জোরে শব্দ করে হাসতাম।

আপুর কথা শুনে আরও বিদঘুটে শব্দে হাসতাম। আমরা একসঙ্গে কলেজে যেতাম আর সারা রাস্তা, ক্লাসরুম সব জায়গায় এভাবে দাঁত কেলিয়ে হাসতাম। ওর অদ্ভুত এক গুণ ছিল, খুব সহজেই মানুষের কথা ও অঙ্গভঙ্গি নকল করতে পারত। দেখা যেত রাস্তায় হাঁটছি, এমন সময় ওর হাসির কোনো ঘটনা মনে পড়েছে; তখন আমরা বেমালুম ভুলে যেতাম রাস্তায় আছি। রাস্তায় দাঁড়িয়েই ও অভিনয় করে দেখাত, অভিনয় দেখতাম আর দুজন মিলে হো হো করে হাসতাম। পথচারীরা আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে পাগল ভেবে চলে যেত। মানুষের এমন আচরণ দেখে আরও জোরে শব্দ করে হাসতাম।

এই হাসির ব্যামো আমাকে বেশ বিড়ম্বনায় ফেলেছে। ক্লাসের সবচেয়ে বদমেজাজি স্যারের সামনেও হেসে উঠতাম; এটা আরও ভয়ানক রূপ নিত, যখন শত চেষ্টায়ও হাসি আটকে রাখতে ব্যর্থ হতাম। তবে এখন হাসির মাত্রা অনেক কমে গেছে। খুব একটা শব্দ করে হাসা হয় না। মাঝেমধ্যে বাসায় শব্দ করে হাসলে ভাবি বলেন, ভিলেনের মতো করে হাসি। তখন মনে হয় আমার পদোন্নতি হয়েছে! ইবলিস থেকে ভিলেন হতে পেরেছি; কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে ঘুরেফিরে সেই নেগেটিভ চরিত্রেই আটকে আছি।

ব্লক-জি, বনশ্রী, ঢাকা