ট্রেন

অলংকরণ: তুলি

রাস্তাজুড়ে অন্ধকার। কয়েকটি ল্যাম্পপোস্টের মিটমিটে আলোয় শুধু রাস্তাটা কোনো রকম বোঝা যাচ্ছে এ–ই যা। এগুলো না থাকলেই বরং ভালো হতো, মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে! আবছা হলুদ আলোয় কেমন গুমোট বিষণ্নতা চারপাশে। আমার মোটা কাচের চশমা রাস্তার শেষ কোথায়, ধরতে পারল না। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।

রাত কেবল ১২টা। ঢাকা শহর এই সময়ে এত নীরব হবে কেন! একটার ট্রেন ধরব, গন্তব্য চট্টগ্রাম; আমার নতুন চাকরির শহর। আগের চাকরিটা ভালোই ছিল, নেহাতই ঢাকার হাওয়ায় মানিয়ে নিতে পারছিলাম না বলে ছেড়ে দেওয়া। ট্রেনস্টেশনে এসে বসতেই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা অল্প কিছু যাত্রী চোখে পড়ল। এদিক–সেদিক তাকাতে একটা মজার দৃশ্য চোখে পড়ে। কলাপাতা সবুজ কাতান শাড়িতে বউয়ের সাজে গাভর্তি গয়না নিয়ে ১৮-১৯ বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা মাঝারি আকারের ব্যাগ, কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে সম্ভবত। মেয়েটার জন্য মায়া লাগল। হাসিও পাচ্ছে, বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো কী প্রচণ্ড সাহস নিয়ে বাঁচে!

বড় মামার মেয়ে নার্গিসও এভাবে একবার পালিয়ে গিয়েছিল। নার্গিস ছিল বেশ অদ্ভুত ধরনের মেয়ে। পড়াশোনার বাইরে ওর কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ ছিল না। স্বাভাবিক কোনো কিছু সে বুঝত বলেও আমার মনে হয় না। বৃষ্টিতে ভেজার কথাই ধরি, ছোটবেলায় বৃষ্টির সময় মামিসহ আমি আর মামার বাকি দুই ছেলে–মেয়ে সবাই ভিজতে যেতাম, মামি খুব একটা আমাকে পছন্দ না করলেও বৃষ্টির দিনে তাঁর মনমেজাজ ভালো থাকত। কিশোরীর মতো হাসি হাসি মুখ করে ডাকতেন, ‘নীহারিকা, বাইরে আসো, কী সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে দেখে যাও!’

আমি যেতাম। আমাদের ছাদে একটা বাতাবিলেবুর গাছ আছে, মায়ের হাতের লাগানো। বৃষ্টিতে ভিজলে গাছটা থেকে লেবুর কড়া ঘ্রাণের সঙ্গে আরেকটা পরিচিত ঘ্রাণ পাওয়া যেত। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ। অবশ্য এটা আমার কল্পনাও হতে পারে। আকাশ কালো করা মেঘের নিচে মামি তাঁর ছেলে–মেয়ের হাত ধরে শিশুর মতো আনন্দ নিয়ে ভিজতেন, আমি বৃষ্টি দেখতাম, কালো আকাশ দেখতাম, ভিজে রং ফিরে পাওয়া বাতাবিলেবুর গাছ আবার কখনো গাছের নিচে ভিজে জবুথবু হয়ে বসে থাকা একটা শালিক; আর দেখতাম মামিকে। লেবুর পাতার মতো তাঁর গাঢ় সবুজ শাড়ি বৃষ্টিতে ভিজে রং ফিরে পেত, চোখের কাজল লেপটে ছড়িয়ে পড়ত, মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের আমার সঙ্গে কার্নিশের নিচে বসিয়ে উনি গলা ছেড়ে গান গাইতেন। আমি ওনার মতো সুখী হতে চাইতাম। এমন হুটহাট বৃষ্টিবিলাসে মামাও মাঝেমধ্যে অংশ নিতেন। কিন্তু একজন কখনই আসত না, নার্গিস।

মামার বাড়িটা আমার মায়েরই। মা–বাবা মারা যাবার পর মামার পরিবার নিজ থেকেই আমার দায়িত্ব নিতে চলে আসেন। বাবার বাড়ির কেউই আমার খোঁজ তেমন একটা নিতে চায়নি। সেই থেকে মামাদের সঙ্গে রয়ে গেলাম। মামার পুরো পরিবারের মধ্যে নার্গিস আমার সবচেয়ে পছন্দের। ভালো লাগার চেয়ে মায়াই বোধ হয় বেশি লাগত। ও ছিল বয়সে আমার চার বছরের ছোট। ছোটবেলায় বাচ্চারা ওকে খেলতে নিতে চাইত না। একবার খেলতে গিয়ে নাবিল নামের এক ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে চলে এল। নাবিলের মা-বাবা এলেন। ওনারা কিছুটা অবাকও হলেন, কেন নার্গিসের মতো শান্তশিষ্ট বাচ্চা এমন করবে! প্রায় আধঘণ্টা তাকে শাসানো হলো, শেষমেশ মামা বেশ জোরে চড় মেরে ওর ঠোঁট কেটে ফেললেন। নার্গিস একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল। এইটুকুই। সাত-আটজন স্তব্ধ মানুষকে বসিয়ে রেখে নির্বিকার ভঙ্গিতে ১০ বছরের ছোট্ট নার্গিস নিজের ঘরে গিয়ে অঙ্ক করতে বসে গেল।

এই মেয়ে কোনো রকম আভাস ছাড়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, কেউ ভাবেনি। মামা পুলিশে খবর দিলেন, মামি দু-তিনবার জ্ঞান হারালেন। শেষমেশ ওকে খুঁজে পাই আমি। আমাদের পরের লেনে হাবিবের টংদোকানে বসে ছিল, মুখ হাসি হাসি। আমাকে দেখে হাত নাড়ল, আমি এগিয়ে গিয়ে বসলাম।

পুলিশ খুঁজছে তোকে।
পুলিশ আমাকে পাবে কোত্থেকে? আমি তো এদিকটাতেই ছিলাম।
গেলি কেন এভাবে না বলে?
এমনি আপা। শোনো এখন, আমি এখানে আরও কিছুক্ষণ বসব। তুমি চাইলে থাকতে পারো, চলে যেতে চাইলে যেতেও পারো।
আচ্ছা, বসে থাক। কিন্তু লোকজন তাকিয়ে আছে, দেখছিস তো?
থাকুক।
হাসছিস কেন? মামি যে অসুস্থ হয়ে গেছেন, জানিস?
তুমিও হাসছ আপা। আর মায়ের কথা রাখো। চলো রিকশায় ঘুরি কিছুক্ষণ।
আমার মনে হলো, ও বলতে চায় কিছু। বললাম, চল।

রিকশাওয়ালা এ গলি থেকে ও গলি করে বোধ হয় বিরক্ত হচ্ছিল। নার্গিসও কোনো কথা বলছে না। প্রায় ২০ মিনিট চুপ থাকার পর আমি বললাম, কেন পালিয়েছিস?
পালালাম কোথায়? ওকে দেখে মনে হলো খুব মজা পাচ্ছে। হাসি হাসি মুখ।
তোর তো কারণ ছাড়া এমন করার কথা নয়।
কেন?
তুই তো এমন না।
নার্গিস শূন্য গলায় বলল, আমি কেমন? খেয়াল করে দেখলাম, ওর চোখমুখ শক্ত হয়ে আছে। একসময় বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামল। রিকশা থেকে নামার আগে ও বলল, আমাকে তোমরা চেনো না আপা।
আমি কিছু বলার আগেই ও নেমে চলে গেল। বাড়িতে ফিরে স্বাভাবিকভাবে নিজের ঘরে চলে গেল, যেন কিছুই হয়নি। মামা চড়থাপ্পড় দিয়েও কোনো কথা বের করতে পারলেন না।

এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর থেকে নার্গিসের অস্বাভাবিক আচরণ শুরু। পড়াশোনায় মন নেই, নাওয়া–খাওয়া ছেড়ে দিল। ঘর থেকে সহজে বের হয় না। আমরা ধরেই নিলাম, ছেলেঘটিত ব্যাপার হবে। মামা-মামি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিরাজি চিকিৎসা চালালেন। লাভ হলো না। এর মধ্যে ওর শরীর খারাপ করতে শুরু করে। প্রায় এক মাস এভাবে চলার পর একদিন দুপুরে খেতে খেতে ও বলল কথা আছে। আমরা আগ্রহ নিয়ে বসে থাকলাম।
‘আমি কনসিভ করেছি। চার মাস হলো। বাচ্চাটা আমি রাখব।’ ওর মধ্যে ভয়, জড়তা কিছুই ছিল না।

মামা নিজের ভাতের প্লেট ওর মাথায় ছুড়ে মারলেন, সঙ্গে সঙ্গে রক্ত পড়তে লাগল। এর পরের ঘটনা আমার ভাবতে ইচ্ছা করে না। নার্গিস অনেক যুদ্ধের পর বাচ্চাটা জন্ম দেয়। খুব মিষ্টি দেখতে হয়েছিল। ঠিক সাত দিন পর বাচ্চাটার লাশ পাওয়া যায় বাড়ির নিচে। এর রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়নি। পরিবারের অনেকের ধারণা, মামি এই কাজ করেছেন। আমার কোনো ধারণা নেই। কোনো কিছুতেই আমি ধারণা করি না। কী লাভ?

এর এক মাস পর নার্গিস মারা গেল প্রচণ্ড বৃষ্টির দিনে। মামি সেদিনও আনন্দ নিয়ে ভিজলেন, আমি কার্নিশের নিচে বসে তার ভেজা চোখে কাজল লেপটে যেতে দেখলাম। তাঁকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল। মারা যাওয়ার আগমুহূর্তে নার্গিস প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মামাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল। মামা শূন্য দৃষ্টিতে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন। নার্গিসকে হাসপাতালে নেওয়ার কোনো ব্যাবস্থা করা হয়নি। মামা চাননি লোকে জানুক, এ বাড়িতে একটা মেয়ে সন্তান হারিয়ে বিষ খেয়েছে। মাগরিবের পরপর নার্গিসের যন্ত্রণার অবসান ঘটল, মামা একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে চলে গেলেন ওকে মাটি দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে। মামি মেয়ের ঠান্ডা হাত ধরে অপেক্ষা করতে থাকলেন।

নার্গিসের কথা মনে পড়লেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কী প্রচণ্ড সাহস ছিল ওর! মারা যাওয়ার আগে ও পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল, মাঝরাতে বারান্দায় বসে চুল মেলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। আমি গেলে সহজ ভঙ্গিতে আমার সঙ্গে গল্প করত। কীভাবে প্রেমে পড়ল, প্রেগন্যান্সি টের পেয়ে ছেলেটার সঙ্গে পালাতে চেয়েছিল, প্রতারণার স্বীকার হয়েছিল—সব। শুধু ছেলেটার ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে চোখমুখ শক্ত করে বলত—
‘ওর ব্যাপারে কিছু জানতে চাইবে না, আপা। নোংরা মানুষদের নিয়ে আমার কথা বলতে ইচ্ছা হয় না।’
মাঝেমধ্যে দেখতাম, অন্ধকারে বসে একা একাই কথা বলত। বারান্দার হালকা আলোয় ওকে দেখাত পরির মতো।

ট্রেন চলে এসেছে, লোকজনের ভিড় না থাকায় সবাই বেশ ধীরেসুস্থে উঠে পড়ল। আমি উঠলাম একটা মোটামুটি সাইজের সেকেন্ড ক্লাস কামরায়। বগির নাম ঘ। এখানেও মানুষজন তেমন নেই। হাতে গোনা কয়েকজন—তিন–চারটা ছেলেমেয়ে, খুব সম্ভবত ভার্সিটিপড়ুয়া, একজন স্যুট-টাই পরা মধ্যবয়স্ক লোক, একটা পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চাসহ ছোট্ট পরিবার আর সেই কলাপাতা শাড়ি পরা মিষ্টি দেখতে বউ—এই কজনই। মেয়েটা এত রং থাকতে এই কটকটে রংটা কেন বেছে নিল, জানতে ইচ্ছা হচ্ছে।
তুমি যাচ্ছ কোথায়? হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠলাম। বাচ্চা মেয়েটা উঠে এসেছে। সাদা একটা ফ্রক গায়ে, জামার ফিতা চিবোতে চিবোতে কথা বলছে। ‘চিটাগং যাচ্ছি, বাবা। তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
‘দাদুবাড়ি।’ বলতেই মায়ের ধমক খেয়ে দৌড়ে চলে গেল। আমি হাসলাম।

ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে প্রথম ও শেষবার ট্রেনে চড়েছিলাম। জানালার বাইরে মাথা দিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। ট্রেন থেমেছিল গফরগাঁও স্টেশনে। বানান করে স্টেশনের নামটা পড়ি। মা-বাবার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল মনে নেই, শুধু ঝাপসা বর্ষণের মতো তাঁদের হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন! মায়ের পরনে সুন্দর লাল রঙের শাড়ি ছিল।
বউ মেয়েটার কান্নার শব্দ বেড়ে গেছে এখন। আশপাশের লোকজন কানাঘুষা করছে। আমি টিস্যু এগিয়ে নিয়ে মেয়েটার পাশে বসলাম।
থ্যাংকস।
যার আসার কথা ছিল আসেনি?
আসবে, একটু সময় লাগছে।
কিন্তু ট্রেন ছাড়ার সময় তো হয়ে এল।
মেয়েটা কিছু বলল না।
কিছু মনে কোরো না, তুমি করে বলছি। কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?
এবার এইচএসসি দিয়েছি।
তোমার কি কলাপাতা রং প্রিয়?
মেয়েটা বেশ শব্দ করে হেসে ফেলল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলল—
এটার দাম কম ছিল। টিউশনির টাকা দিয়ে কিনেছি। আমাকে মানিয়েছে। তা–ই না, বলুন?
হ্যাঁ। খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।
মেয়েটা মুচকি হাসল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে মাত্র, মেয়েটা মলিন মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।
হঠাৎ গলা ফাটিয়ে একটা ভরাট কণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, নার্গিইইইইইস!!!

মেয়েটার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। দৌড়ে চলে গেল গেটের কাছে। বগির বাকি লোকজনের মতো আমিও উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে চাইলাম, ঘটনা কী। ঘটনা খুবই সুন্দর, একটা ২২-২৩ বছরের ছেলে এসেছে, মেয়েটার যার সঙ্গে যাওয়ার কথা। গায়ে একটা সাদা পাঞ্জাবি, হাতে ব্যাগ। ট্রেনের গতি বাড়ার আগেই তাকে হাত ধরে টেনে ওঠানো হলো। মেয়েটা হাসি-কান্না এক করে ছেলেটাকে জাপটে ধরে রাজ্যের অভিযোগ শুরু করল। ছেলেটা জিজ্ঞেস করল—
এই রঙের শাড়ি কেনার কারণ কী?
এটায় আমার গায়ের রং ফুটেছে। ফুটেছে না?
হ্যাঁ।
লাল পরলে গায়ের রং দেখাত ময়লা। বিয়ের দিন গায়ের রং পরিষ্কার দেখানো দরকার। এটাই কারণ।
তোমাকে সুন্দর লাগছে নার্গিস।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। খুব সুন্দর জোছনা বাইরে। হঠাৎ মনে হলো, ট্রেনের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হলে এই মেয়েটাকে ঠিক আমাদের নার্গিসের মতো দেখাত।