নব্বইয়ের দশকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের শৈশব ও ভালোবাসা। তখন চ্যানেল ছিল একটা, বিটিভি। সবাই অপেক্ষা করতাম বাংলা ছায়াছবি দেখার জন্য। তখন প্রতি মাসে একবার ছায়াছবি দেখানো হতো। বিশেষভাবে দেখানো হতো ঈদে।
গ্রামে সবার বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, দু-একটা বাড়িতে ছিল। এখনকার মতো সবার ঘরে ঘরেও টেলিভিশন ছিল না। পুরো গ্রাম মিলে একটি বা দুটি টিভি, তা–ও সাদা–কালো। যেদিন টিভিতে ছায়াছবি থাকত, সেদিন মা-কাকিমাদের দেখতাম সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সব কাজ সেরে ফেলত; যাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে টিভির সামনে বসতে পারে। সঙ্গে আমরাও দেখতাম।
জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছিল ইত্যাদি। টিভিতে দেখানো হতো হুমায়ূন আহমেদের লেখা নানা জনপ্রিয় নাটক। ঈদের সময় আনন্দমেলা ও ছায়াছন্দ অনুষ্ঠানও বেশ জনপ্রিয় ছিল। আমাদের সময় পছন্দের টিভি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন বিপাশা, শমী, মিমি, বিজরী, সুবর্ণা মুস্তাফা, নিমা রহমান, লাকী ইনাম, সারা যাকের, শম্পা রেজা, শান্তা ইসলাম, মেঘনা, মুনিরা ইউসুফ, আজিজুল হাকিম, শহীদুজ্জামান সেলিম, তৌকীর আহমেদ, জাহিদ হাসান, হেলাল খান, তারিক আনাম, আলী যাকের, মনোজ সেনগুপ্ত, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, আবুল হায়াতসহ আরও অনেকে। মডেলদের মধ্যে ছিলেন তানিয়া, সুইটি, মৌ, নোবেল, শিমুল, পল্লব ও ফয়সাল।
শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্কুলের স্মৃতি। মনে পড়ে টিফিন ছুটির ফাঁকে বিভিন্ন খেলায় আমরা অংশ নিতাম। স্কুলের সামনে বসত আচার, আমড়া ও আইসক্রিমওয়ালারা। আট আনায় কাঠিযুক্ত বরফের আইসক্রিম খেতাম। ঈদের সময় নায়ক-নায়িকাদের ছবিযুক্ত কার্ড দেওয়ার রীতির প্রচলন ছিল। গ্রামে আসত লেইসফিতাওয়ালা; মা-চাচিদের দেখতাম ওদের কাছ থেকে চুড়ি, নেইলপলিশ, ক্লিপ ও টিপের পাতা কিনতে। এখন গ্রামেও শহরের মতো অনেক বড় বড় মার্কেট হলেও লেইসফিতার সেই স্মৃতিগুলো মনে দাগ কেটে আছে। তখন প্রসাধন হিসেবে কিউট ও কোহিনূরসামগ্রী বেশ জনপ্রিয় ছিল। তা ছাড়া লিভার ব্রাদার্সের নানা পণ্যও সবাই ব্যবহার করত।
শীতকালে গ্রামে পিকনিকের হিড়িক পড়ে যেত। মাইক বাজিয়ে সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে এই পিকনিকের আয়োজন করত গ্রামের যুবকেরা। মায়ের হাতের নানা পিঠাপুলির স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে যেন। তখন পরিবারগুলো এতটা সচ্ছল ছিল না। এখনকার মতো ঘরে ঘরে ফ্রিজ বা মাছ-মাংস সংরক্ষণ করা হতো না। কমবেশি সবার বাড়িতে মাসে একবার মাংস রান্না করা হতো। গ্রামে পুকুর থাকায় প্রচুর পরিমাণে টাটকা মাছ পাওয়া যেত। তখন গ্রামে মাছ বিক্রেতা, কাপড় বিক্রেতা ও হাঁড়িপাতিল বিক্রেতারা আসত।
মনে পড়ে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা। আমরা অংশ নিতাম। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরি, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। স্কুল পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমরা আমাদের স্কুলের জন্য অসংখ্য পুরস্কার এনেছিলাম। তখন স্মারকের বদলে বই উপহার দেওয়ার প্রচলন ছিল। গ্রামভিত্তিক ফুটবল খেলত ছেলেরা। সূর্যখোলা নামে হিন্দুদের একটি মেলা হতো, যেখানে মাটির জিনিস, খেলনা, খাবার, মুড়ি, নাড়ু, জিলাপি ছাড়াও ঝাড়ু, পাটি, মোড়া ও নানা প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যেত।
নব্বইয়ের দশকে গ্রামের হাটবাজার বেশ জমজমাট ছিল। শীতের বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো ছিল বেশ জনপ্রিয়। গ্রামভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করত, বিশেষ করে পয়লা বৈশাখে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমাদের সময় গ্রামে এক মাস আগে থেকে নাচ-গান ও নাটকের মহড়া শুরু হয়ে যেত। অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে থেকে মা-চাচিদের কাছ থেকে চেক শাড়িসহ নানা জিনিস সংগ্রহ করে রাখতাম। তখন এখনকার মতো সবকিছু সবার বাড়িতে থাকত না।
গ্রামে কেউ মারা গেলে বেলাবিস্কুট দিয়ে চা দেওয়ার রীতি ছিল। তা ছাড়া নানা অনুষ্ঠানে সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হতো। তরকারি হিসেবে থাকত ডাল, সবজি, মাছের মাথা দিয়ে আলু ও মাছ। এখনকার মতো ঘরে ঘরে টিউবওয়েল ছিল না। পাড়ায় একটি বা দুটি। বিকেলে বাড়ির বউ-ঝিয়েরা কলসিতে পানি নিয়ে আসত। শীতের দিনে তিব্বত পমেড ও ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ক্রিমের বেশ কদর ছিল।
নব্বইয়ের দশকে লাটিম, মার্বেল ও ইয়োইয়ো খেলার প্রচলন ছিল অনেক বেশি। মেয়েরা দড়ি ও কড়ি দিয়ে খেলত। কলম ছিল ইকোনো ডিএক্স। নানা ছবির বাঁধাই করা খাতা দোকানে পাওয়া যেত। গ্রামের দোকানগুলোতে ছোট ছোট সন্দেশ, টুকটুকির ডিম, বাবলগাম, বাহা বা ছোট জেম বিস্কুট ও সন্দেশ পাওয়া যেত। কম-বেশি অনেকের বাড়িতে রেডিও থাকত। তিন ব্যাটারিযুক্ত টর্চ ব্যবহার করত সবাই। ভিসিআর ক্যাসেট প্লেয়ার ও ছোট টেপ রেকর্ডারের প্রচলন ছিল।
নব্বইয়ের দশক আমাদের শৈশব, আমাদের ভালোবাসা ও স্মৃতির পাতায় আজও জ্বলজ্বল করে, নিয়ে যায় সুখময় অনুভূতিতে। তখন বিনোদনমূলক নানা ম্যাগাজিন পাওয়া যেত। সূর্যোদয়, যায়যায়দিন ও সুগন্ধা ম্যাগাজিন ছিল। যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিঠি, মানি অর্ডার ও পার্সেল। গ্রামে গ্রামে ছিল বায়োস্কোপ, টকি সিনেমা; জারি, সারি, পট, গাজির গান ও কবিগানের আসর বসত। আমরা বছরে একটি বা সর্বোচ্চ দুটি জামা পেতাম বাবার কাছ থেকে। এখন আলমারিভর্তি পোশাক থাকলেও তখনকার মতো আমেজ আর নেই। নব্বইয়ের দশকের অনেক স্মৃতি এখনো মনে দাগ কাটে।
নন্দনকানন, চট্টগ্রাম