কথা রয়ে যায়

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসে জীবনের গতিপথ নতুন করে ভাষা পায়। দৃপ্ত শপথে জেগে উঠি।’ নীলাকে বলছিলেন বড় নানা। তিনি সিফাতের দাদার বন্ধু। তাঁকে বড় নানা বলে ডাকে সিফাত। দাদা ও তিনি একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। দাদা বেঁচে থাকতে মাঝেমধ্যে আসতেন। মারা যাওয়ার পর প্রথম এলেন।

‘সময় কত দ্রুত চলে যায়। ছোট্ট সিফাত বড় হয়েছে! বিয়ে করেছে, ব্যবসা করছে, সংসার সামলাচ্ছে। বেশ, বেশ!’ নাতির পাশে গিয়ে বসতেই আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন বড় নানা।

‘কেন আসো না তুমি? বন্ধু নেই বলে আমাদের কথা কি মনে পড়তে নেই!’ গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে সিফাত।

‘তোর মামারা একা ছাড়তে চায় না। কী করব বল, হাইপ্রেশার, ডায়াবেটিস, নানাবিধ সমস্যা, দুই বেলা ওষুধ খাই। তারপরও নিস্তার নেই, কখন কী হয়। বয়স হলে বুঝবি, বড় হতে হতে মানুষ শিশু হয়ে যায়!’

দাদা ও বড় নানার যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছে নীলা। বিয়ের পর সিফাত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিবারের ইতিহাস সব বলেছে তাঁকে। ইচ্ছা ছিল বড় নানার সঙ্গে দেখা হলে যুদ্ধদিনের গল্প শুনবে। তাই দেখা হতেই ইচ্ছার কথা জানায়। একগাল হেসে বড় নানাও বলতে শুরু করেন।

‘সম্মুখসমরে যুদ্ধ করেছি আমরা, বাঁচা–মরার ভয় ছিল না। কত কাদা, রোদ, বর্ষা শরীরের ওপর দিয়ে গেছে। কখনো কষ্ট হয়নি। কেবল একটাই লক্ষ্য ছিল, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। কত প্রিয়জন চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, কত জীবন, রক্ত, মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আজকের এ স্বাধীনতা। ভাবতেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। পাকিস্তানিদের অত্যাচারের কথা মনে পড়তেই আগুনের ফুলকি জ্বলে ওঠে চোখে।’

কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে নানার। পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় নীলা। বিরতি দিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘ভালোবাসা, আবেগ, কষ্টের সঙ্গে স্মৃতির ক্রমবিন্যাসের কি কোনো যোগসূত্র আছে! যদি না থাকে, তবে চোখ বুজলেই কেবল ওই দিনের ছবি কেন দেখতে পাই! আরও তো কত ভয়াবহ স্মৃতি আছে!’ ‘কোনো বিশেষ কিছু ঘটেছিল কি, যা মনে করতে চান না?’ বিনীত স্বরে জিজ্ঞেস করে নীলা।

‘মনে করতে চাই না, ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। তবে ঘটনাটা কাউকে বলতে পারিনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, যে যখন আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে, বরাবর ঘটনাটা বলতে চেয়েছি। কিন্তু প্রতিবার শব্দশূন্য হয়ে যাই। একটা শব্দও গলা দিয়ে বেরোয় না।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নানা। দুচোখভর্তি অশ্রু। টুপটাপ ছন্দে নুয়ে পড়ছে গালের ওপর। নীলা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু নানা বলতে শুরু করায় থামল সে।

‘মেহতাব আমার দুই বছরের ছোট। এক গাঁয়ে বাড়ি। সে বড় দুঃখী ছিল। জন্মের সময় মা মারা যায়, এরপর বাবা। মামার বাড়িতে মানুষ। বড় মামির ছেলেপুলে ছিল না। মেহতাবকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন। আমাদের বয়সের পার্থক্য থাকলেও পূর্ণহৃদয় বন্ধুত্ব ছিল। যুদ্ধে যাব, মেহতাবকে বলতেই একপায়ে রাজি। দুই বন্ধু বুকে বুক ঠেকিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছি। বিভিন্ন সময় আলাদা হয়ে যুদ্ধ করতে হয়েছে। মনে হয়েছে আর বোধ হয় দেখা হবে না। কিন্তু আমাদের দেখা হয়েছে। মনে আছে, শেষবার যখন দেখা হলো, তার কিছুদিন পর একই দিনে আমার বাঁ হাতে আর মেহতাবের বাম কাঁধের নিচে গুলি লাগে। দ্বিতীয় দিন আমি একটু সুস্থ বোধ করলেও মেহতাবের অবস্থা গুরুতর। তখন সন্ধ্যা হবে হবে প্রায়, মেহতাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। হঠাৎ আমার ডান হাত তার ডান হাতের মধ্যে নিয়ে সে বলে, “রক্ত বৃথা যায় না, যাবে না। স্বাধীনতা আসবেই। কিন্তু আমি যদি না থাকি, তুমি একটা কাজ করে দেবে আমার, কথা দাও…।”’

বলতে বলতে মেঝেতে পড়ে যান বড় নানা। চিৎকার দিয়ে ওঠে নীলা। বড় নানা নিস্তব্ধ, সাড়া নেই। মুখজুড়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘাম। ‘ছয় ঘণ্টা অতিবাহিত না হলে কিছু বলা যাচ্ছে না,’ চিকিৎসকের জবাব। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে নীলার বুকের ভেতর। সে বসে আছে বড় নানার মাথার শিয়রে। চোখের কিনার ভর করে আছে থোকা থোকা অশ্রু।

সাধারণ সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা