রাজীবের ডান হাত

দুই বাসের ফাঁকে আটকে পড়েছিল কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের ডান হাত। বাসের চাপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল হাতটি। দুই সপ্তাহ পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনিফাইল ছবি

Tragedy satisfies us even in the moment of distressing -Lascelles Abercrombie (1881-1938)

পত্রিকার প্রথম পাতায় তিন কলামজুড়ে থাকা একটি সাধারণ ছবি। ছবিতে কোনো মানুষ নেই, এনভায়রনমেন্ট নেই, নেই কোনো অ্যাকটিভিটি। যেন স্টিললাইফ ফটোগ্রাফ। তবে বোঝা যাচ্ছে, দুটি নাগরিক বাসের একাংশের ক্লোজআপ এটি। একটি বাস আরেকটি বাসের সঙ্গে লেপটে রয়েছে। তারই মাঝখানে আটকে আছে একটি হাত! মানুষের তাজা হাত! চেয়ার থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ার অবস্থা। শুধু হাত কেন! মানুষটা কোথায়! নেই তো! থাকার কোনো সম্ভাবনাও নেই—দুই বাসের মাঝখানে যে এক মিলিমিটার জায়গাও নেই। আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না, ওখানে শুধু হাতটিই আটকে আছে। হাতটি রয়ে গেছে আমাদের চোখে পট্টি বাঁধা প্রশাসনের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে যে এই দেশে মানুষের দাম কতটা নিচে নেমে গেছে।

নাগরিক অরাজকতা-নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা ও অসারতার প্রতীক হয়ে দুই বাসের মাঝখানে টিকে আছে হাতটি। হাতটি আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে, প্রশ্নের মুখোমুখি করে, ডাকে! এই আবহই তৈরি হতো না যদি সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দী না করতেন। তিনি আলোকচিত্রী নন। কিন্তু তাঁর ছবি তা বলে না। স্পট নিউজ কাভার করতে গিয়ে অনেক পেশাদার আলোকচিত্রীও ঘাবড়ে যান। কিন্তু জনাব মিজান যেহেতু একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক, সেহেতু তিনি জানেন এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। তিনি ঠান্ডা মাথায় ছবিটি তুলেছেন, ঘটনাটি বর্ণনাও করেছেন। তাঁর মধ্যে অস্থিরতা ছিল না বলেই হয়তো তাঁর অজান্তেই ছবিটির কম্পোজিশন অনন্য উচ্চতায় স্থান পেয়েছে। খুবই রিয়ালিস্টিক ছবি। একজনের শরীর থেকে একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তা ঝুলে আছে দুই বাসের পেটের মাঝখানে। ছবিটি সত্যিকার অর্থেই ‘বীভৎস’ দৃশ্যের প্রতিলিপি হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। ছবির কোথাও এক ফোঁটা রক্ত নেই। হাতটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো আলামতও নেই (যদিও তা হয়েছে)। একাধিক উজ্জ্বল রঙের মাঝখানে একটি স্থবির হাত—যেন ইনস্টলেশন (দৃশ্য শিল্পকর্ম)। এখানেই ছবিটির শক্তি। একটি হার্ডকোর নিউজ ছবি হয়েও তা দৃশ্য শিল্পকর্মের মতো দেখায়। হাতটির ভঙ্গিও দর্শককে টানে, যেন তা বাঁচতে চাইছে। যাঁর হাত, সেই রাজীব হোসেন তো প্রাণে বেঁচে নেই। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাহলে হাতটি আবার কোন বাঁচার কথা বলছে? এই ছবি আমাদেরকে জানিয়ে দিল, মুখ নয়, বিশেষ সময়ে মানুষের হাতও কথা বলে ওঠে। ছবিটিতে চোখ রেখে আমাদের কষ্ট হয়, আমরা মূক হয়ে রাজীবের ডান হাতের চাপাস্বরের কথা শুনি। আসলে এ ধরনের শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়িয়েও আমরা রস গ্রহণ করি। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা এই রসের নাম দিয়েছেন করুণ রস।

কলেজছাত্র রাজীব হোসেন
ফাইল ছবি

করুণ রস পাই, কারণ কারও করুণ অবস্থা দেখে আমরা তার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করি এবং ওই অবস্থায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করে আমরা ভীতি অনুভব করি। করুণ অবস্থায় না পড়েও আমরা সেই অবস্থাটা অনুভব করি।

সুতরাং এই ছবি শুধু সংবাদই বহন করে না, একটি সার্থক শিল্পকর্মের বিভিন্ন উপাদানও বহন করছে। এটি সিটিজেন জার্নালিজমেরও উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রাযুক্তিক যুগে ঘটনা আর পেশাদার ফটোসাংবাদিক, ক্যামেরাপারসন ও প্রতিবেদকের জন্য অপেক্ষা করে না। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে ভিডিও, স্থিরচিত্র ও টেক্সট ফরম্যাটে। মিজানুর রহমান খানও তাঁর পত্রিকার ফটোসাংবাদিক বা প্রতিবেদকের জন্য অপেক্ষা করেননি, তিনি নিজেই তাঁর সঙ্গে থাকা মুঠোফোন ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছেন, তথ্য নিয়েছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ খবর পাঠকের কাছে সরবরাহ করেছেন। ফটোসাংবাদিকের অপেক্ষায় থাকলে এই ‘মোমেন্ট’ হারিয়ে যেতে পারত, তখনো হয়তো আমরা খবর পেতাম, ছবিও দেখতাম; কিন্তু হয়তো তা আমাদের সেভাবে নাড়া দিত না, ভাবাত না—এখন যেভাবে আমার বোধকে নাড়িয়ে দিল।

কোন আলোকচিত্র টিকে থাকবে, কোনটি কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সময়ই তা বলে দেয়। আলোকচিত্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, যে ছবি মানবিক, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিবেককে নাড়া দেয় এবং যে আলোকচিত্রের বিষয় সর্বজনীন ও সর্বকালীন, তা টিকে থাকে, মনে থাকে। অনেক কারণেই আলোচিত ছবিটি দীর্ঘদিন টিকে থাকবে। অস্থির ও অপরিকল্পিত নগর এবং বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত নাগরিক জীবনের প্রতিনিধিত্ব করছে এই ছবি। শিগগিরই সুশীল হয়ে যাচ্ছে না আমাদের দৈনন্দিন জীবন। সুতরাং এই ছবিও আমাদের স্মৃতিতে থেকে যাবে। এটিই এ ছবির টিকে থাকার প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি।

লেখক, সাংবাদিক

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, সপ্তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৮ থেকে নেওয়া।