খাবার আমাদের জীবন। প্রতিদিন যা খাচ্ছি, তা আমাদের শরীর ও মনকে গঠন করছে। খাবার শুধু স্বাদের জন্য খাওয়া হয় না, এটা শরীরের প্রতিটি ধমনিতে বয়ে চলা শক্তি ও পুষ্টির প্রধান উৎস।
কিন্তু যখন সেই খাবারেই মেশানো হয় নীরব বিষ, তখন ধীরে ধীরে শরীরের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়, অসুস্থতা হয়ে ওঠে নিত্যদিনের সঙ্গী।
বাইরের খাবারে সুগন্ধ আছে, কিন্তু গুণ নেই
রাস্তার ফুটপাতে বিক্রি হওয়া খাবার থেকে শুরু করে বাসার রান্নাঘরের খাবার, সব জায়গায় মিশে আছে অজানা বিপদ। এখন শহর থেকে গ্রাম—সবখানে গড়ে উঠছে ঝলমলে রেস্টুরেন্ট। সুগন্ধে ভরা খাবারের থালা- মচমচে ফ্রায়েড চিকেন, রোস্টের কী সুন্দর লোভনীয় রং! ফুটপাতের খাবারগুলো দেখতে আরও সুস্বাদু, কিন্তু এর বিপদেরও সীমা নেই। জিলাপি, চটপটি, বিরিয়ানি—এসব দেখলে ভোজনরসিকদের জিহ্বায় জল চলে আসে। এই বাহ্যিক চাকচিক্যের আড়ালে কী লুকিয়ে আছে, তা আমরা অনেকেই জানি না বা জানতে চাই না। এই বিরিয়ানির সুগন্ধ কি শুধুই মসলার, নাকি পুরোনো বাসি চালের গন্ধ লুকিয়ে রাখার কৌশল? রোস্টের উজ্জ্বল রং কি স্বাভাবিকভাবে হয় নাকি কাপড়ের রং থেকে?
এসব খাবারের মধ্যে কেমিক্যালের ব্যবহার অনেক বেশি হয়, যাতে খাবার দেখতে সুন্দর ও লোভনীয় দেখায়। ফ্রিজে জমে থাকা বছরের পর বছর পুরোনো পচা মাংস, যা এক টুকরা মসলা আর তেলের পরত দিয়ে পরিবেশন করা হয় ‘টাটকা’ ফ্রেশ, অথবা তাজা খাবারের নামে। এসব পুরোনো তেলে ভাজা খাবারে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়, যা হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং শরীরের ক্ষতিকর মেদ বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়া অনেক রেস্তোরাঁ বা স্ট্রিট ভেন্ডর অপরিষ্কার পানি ব্যবহার করে শরবত বা পানীয় তৈরি করে, যা পেটে অনেক রকম সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এসবই তো আমাদের প্রতিদিনের খাবার। কারণ, আমরা স্বাদ খুঁজি, চকচকে খুঁজি; স্বাস্থ্যের কথা ভাবার ফুরসত কই! এসব ক্ষতিকর খাবার আমাদের জীবনে নিয়ে আসছে অজানা রোগ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি। এসবের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে।
খাবারে রাসায়নিকের ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি
নিষিদ্ধ রাসায়নিক ও কেমিক্যালমিশ্রিত খাবার লিভারের কোষ নষ্ট করে, যার শেষ পরিণতি হতে পারে লিভার সিরোসিস। অতিরিক্ত লবণ আর কৃত্রিম সংরক্ষণ উপাদান কিডনির ভার বইতে না পেরে একদিন কিডনি অকেজো করে দেয়। অস্বাস্থ্যকর চর্বি রক্তনালি বন্ধ করে দেয়, রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, হৃদ্রোগের পথ খুলে দেয়। এসব খাবারের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো—এর প্রভাব এক দিনে বোঝা যায় না, বরং এটি ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট করে। একসময় অসুস্থতা স্থায়ী হয়ে যায়। ফুটপাতের অধিকাংশ খাবারেই ভেজাল ও কেমিক্যালের ব্যবহার রয়েছে।
• ফরমালিন: মাছ, ফল ও সবজিতে অনেক সময় ফরমালিন মেশানো হয়, যা শরীরে প্রবাহিত হলে কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করতে পারে, এমনকি ক্যানসারের কারণও হতে পারে।
• ক্যালসিয়াম কার্বাইড: কাঁচা ফল পাকাতে এই কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যা গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে এবং কিডনির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করতে পারে।
• ইন্ডাস্ট্রিয়াল রং: অনেক মিষ্টি, বিশেষত জিলাপি তৈরিতে জটিল রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হয়, যা লিভার ড্যামেজ করে এবং শরীরে বিষক্রিয়া তৈরি করে।
• ইউরিয়া: দুধ ঘন করতে ব্যবহৃত হয় ইউরিয়া, যা হরমোন সমস্যা সৃষ্টি করে এবং স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
• শরীরের ওপর প্রভাব: ভেজাল ও কেমিক্যালমিশ্রিত খাবারগুলো শরীরে যেসব সমস্যা তৈরি করে, তা দীর্ঘমেয়াদিভাবে আরও গুরুতর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
• হজমের সমস্যা: ভেজাল খাবারের কারণে পেটের অসুবিধা হতে পারে। যেমন গ্যাস্ট্রিক, আলসার ও পেট ফাঁপা।
• ত্বকের সমস্যা: এসব খাবারের কারণে ত্বকে ব্রন, অ্যালার্জি ও অন্যান্য সমস্যা হতে পারে।
• মানসিক স্বাস্থ্য: অস্বাস্থ্যকর খাদ্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা ডিপ্রেশন ও মনোযোগের অভাবে পরিণত হতে পারে।
• শিশুদের বিকাশে সমস্যা: ভেজাল খাবার শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, যা তাদের বৃদ্ধি থামিয়ে দিতে পারে।
রান্নার ভুলে বিপদ
অনেকেই ভাবেন, রান্না একটি সাধারণ কাজ। এটি আসলে একটি শিল্প ও বিজ্ঞান। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নিরাপদ রান্নার প্রক্রিয়া মেনে রান্না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বাস্তবে, বেশির ভাগ খাবারের প্রস্তুতি হয় অত্যন্ত অজ্ঞতার মধ্যে। সঠিকভাবে রান্না না করলে শুধু পুষ্টিগুণই হারায় না, খাদ্যও হয়ে ওঠে বিষাক্ত। বিশেষত, অনেক রান্না করা হয় অপরিষ্কার জায়গায়, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। রান্নার উপকরণ যদি অপরিষ্কার থাকে, তবে সেটা খাবারের ভেতরে জীবাণু বা ক্ষতিকর উপাদান যোগ করে। খাবার প্রস্তুতির সময় তাপমাত্রার ব্যবস্থাপনা না করলে, এমনকি উপকরণের সময়ও কম বা বেশি হলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি মাংস সঠিক তাপমাত্রায় রান্না না হয়, তবে সেটা ই.কোলি জীবাণুর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে, যা পেটের সমস্যা, ভাইরাল ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে।
খাদ্য প্রস্তুতির সময় হাইজিন মানা অত্যন্ত জরুরি। খাবার মূলত কাঁচা হিসেবেই থাকে। আর কাঁচা মাংস বা সবজি সবকিছুতেই ব্যাকটেরিয়া ও বিভিন্ন জীবাণুর জন্য আদর্শ স্থান। আমাদের হাতেই থাকে লক্ষ জীবাণু। তাই রান্নাঘর থেকে শুরু করে রন্ধন প্রক্রিয়া সঠিক না হলে, তৈরি করা খাবার আর খাবার থাকে না, হয়ে ওঠে বিষ। প্রথমত, রান্নার আগে হাত ভালোভাবে ধোয়া জরুরি। রান্নাঘরের স্যানিটেশন অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে—যেমন কাঁচা ও রান্না করা খাবারের উপকরণ আলাদা রাখা এবং নিয়মিত জীবাণুনাশক ব্যবহার করা। বিশেষ করে মাছ, মাংস ও সবজি পরিষ্কারভাবে ধোয়া প্রয়োজন। কাঁচা মাছ বা মাংসের অমিশ্রিত উপাদান রান্নার জন্য ব্যবহৃত হলে তা অতি সহজেই রোগের সৃষ্টি করতে পারে। সংরক্ষণ পদ্ধতি যদি ঠিক না হয়, তবে খাবার সহজেই সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে।
খাদ্যের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার উপায়
নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। খাদ্য আইনকে আরও কঠোর করতে হবে, সরকারিভাবে নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে প্রতিটি রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকান। যারা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করছে, তাদের বিরুদ্ধে নিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। শুধু আইন নয়, সচেতনতার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে প্রত্যেক মানুষের মনে। মানুষকে জানতে হবে কোন খাবার নিরাপদ, কোন খাবার তাদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নিরাপদ খাদ্যের চর্চা শুরু করতে হবে ঘর থেকেই, পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর, বিশুদ্ধ উপকরণ আর প্রশিক্ষিত রাঁধুনির মাধ্যমে। রেস্টুরেন্টে কাজ করা প্রত্যেক কর্মীকে প্রশিক্ষিত করতে হবে, তাঁদের হাতে দিতে হবে খাদ্য নিরাপত্তার সার্টিফিকেট। শুধু খাবার তৈরি করলেই হবে না, জানতে হবে সেই খাবারের পুষ্টিগুণ ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে।
প্রশিক্ষিত রাঁধুনির গুরুত্ব
একজন পেশাদার রাঁধুনি রান্নার সময় নিরাপদ খাদ্য প্রস্তুত করার নিয়ম, সঠিক তাপমাত্রায় রান্না, হাইজিন বজায় রাখা এবং খাবারের পুষ্টি ঠিক রাখা নিশ্চিত করতে পারেন। তাঁদের প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে অত্যন্ত বেড়ে গেছে। বিশেষ করে হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোর জন্য, যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার প্রস্তুতি এবং সার্বক্ষণিক খাবার নিরাপত্তা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। একজন প্রশিক্ষিত রাঁধুনি খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়ায় ভেজালমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে পারেন এবং খাদ্য সুরক্ষা বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম।
খাবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সুস্থতা এক দিনে আসে না, এটি প্রতিদিনের অভ্যাসের ফল। তাই আমাদের বেছে নিতে হবে নিরাপদ পথ, বিশুদ্ধ খাবার। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সঠিক হাইজিন, ভেজালমুক্ত উপকরণ ব্যবহারের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত রাঁধুনির মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে খাবার পরিবেশন করা, সংরক্ষণ করা সবার দায়িত্ব। যদি আমরা নিজে সচেতন হই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিরাপদ খাদ্যসংস্কৃতি পাবে। কিন্তু যদি আমরা অবহেলা করি, তবে তাদের জন্য রেখে যাব অসুস্থতার অভিশাপ। তাই আসুন, খাবারকে শুধু স্বাদের জন্য নয়, সুস্থতার জন্য বেছে নিই। নিরাপদ খাবারের চর্চা করি, পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তুলি।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিসিএ প্রফেশনাল কুকিং একাডেমি