আঁরার ঐতিহ্য আঁরার বলীখেলা

ব্রিটিশবিরোধিতা এবং স্বদেশি ঐতিহ্যের নতুন বীরগাথা রচনার প্রয়াসে শুরু হয়েছিল জব্বারের বলীখেলাছবি: সৌরভ দাশ

‘ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান, ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান,
দইজজার কূলত বসত গরি শিনাদি ঠেগাই ঝড় তুয়ান’

মেজ্জান, বলীখেলা, সাম্পান, শুঁটকি, বেলা বিস্কুটের কথা উঠলে কোনো কথা নেই আঁরা চাটগাঁইয়া। এই শব্দগুলো এখন শুধু ঐতিহ্য বহন করে না, পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির অংশও বটে। বলীখেলার নাম শুনে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বলীখেলা হচ্ছে একধরনের কুস্তি খেলার মতো; যে খেলায় নির্মল আনন্দ উপভোগ করা যায়। মেলা, পার্বণ ও লোকসাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশে বলীখেলা শুধু চাটগাঁইয়াদের। ‘বলীখেলা’ শব্দটা আমাদের। চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ উপভোগ করে। কথায় আছে, ‘চাটগাঁইয়া পোয়া মেডিত পইড়লে লোআ’। চাটগাঁইয়া নওজোয়ানরা যে শৌর্যবীর্যের অধিকারী, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলীখেলা বললে চট্টগ্রামের মানুষ আনন্দে ভাসে। বলীখেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। বলী শব্দের আভিধানিক অর্থ শক্তি বা পরাক্রমশালী লোক, বীরপুরুষ ও শক্তিশালী। অর্থ শুনে বোঝা যায়, বলীখেলা মানে শক্তিশালীর মল্লযুদ্ধ বা কুস্তি প্রতিযোগিতা। বলীখেলা চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতির অংশ। চাঁটগার মল্ল নামে খ্যাত আদিকালের হিন্দু–মুসলিম পরিবারে দেখা যায়। মল্ল শব্দের অর্থ কুস্তিগির, বলী হলো খালি হাতে কুস্তি ধরা।

বলীখেলার ইতিকথা
গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর মতে, ‘চট্টগ্রামের ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস বিখ্যাত। এসব পরিবারের প্রায় সব কটিই পটিয়া থানায় অবস্থিত। যেমন পটিয়া আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরির চিকন মল্ল, জিরির ঈদ ও নওয়াব মল্ল, পারিগ্রামের হরি মল্ল, হাইদগাঁওয়ের অলি মল্ল, পেরালার নানু মল্ল  ও মোজাহিদ মল্ল, গোরাহিত মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল, শোভদণ্ডির তোরপাচ মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, গৈড়লার ছুয়ান মল্ল। এ মল্ল হলো বলী বা কুস্তিগির। যাঁরা কুস্তি বা বলী ধরে তাঁদেরকে মল্ল বলা হয়।’

ব্রিটিশ আমল থেকে বলীখেলার আয়োজন হয়ে আসছে। চাটগাঁইয়া বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শোনা যায়, চাটগাঁ হলো মল্ল বা কুস্তিগির বা বলীর শহর। কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় মল্ল পরিবার বসবাস করত। ধারণা করা হয়, চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে বলী খেলার প্রচলন শুরু হয়। ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতান–পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে চাঙা করার জন্য যুবসমাজকে শক্তিমত্তা প্রদর্শনসহ তাঁদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে সে সময় বিত্তবানেরা মাইকিং করে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলীখেলার আয়োজন করতেন। সুনাম ও খ্যাতি অর্জনের জন্য অনেকে এ খেলার আয়োজন করতেন; যা আজ আর কারও বলীখেলা অজানা নয়।

পটিয়ার চরকানাই ও বাজি পুইজ্যার পটিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বলীখেলা। সত্তরের দশকে এ বলীখেলারও মেলা বন্ধ হয়ে যায়। এর অপর নাম সফর আলী মুন্সীর বলীখেলা। যেদিন বলিখেলা হতো, সেদিন খেলা শেষে নানা প্রকারের বাজি পোড়ানো বা ফোটানো হতো। এ জন্য এটি বাজপইুজ্যার বলীখেলা নামেও পরিচিত ছিল।

বলীখেলার উদ্ভবের ইতিকথা সম্পর্কিত বিবরণে কবি আলাদীন আলীনূর লিখেছেন, ‘কবি কালিদাসের জন্মভূমি পশ্চিম মালব অর্থাৎ পটিয়ার মালিয়ারা থেকে এবং কবি আফজাল আলীর জন্মভূমি পূর্ব মল্লর অর্থাৎ সাতকানিয়ার মল্ল বা মিলুয়া থেকে প্রথম মল্লক্রীড়ার অনুষঙ্গী হিসেবে বলীখেলার উদ্ভব হয়। পরে তা সমগ্র চট্টগ্রামে জনপ্রিয়তা লাভ করে।’

আদিকাল থেকে পটিয়ায় তোফায়েল আলী মুন্সীর বলীখেলা ও টেগর পুনির বলীখেলার বেশ সুখ্যাতি ছিল। বৈশাখ মাসে এ খেলার আয়োজন করা হতো। পটিয়ায় প্রথম খেলার আয়োজন করেন পটিয়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের (পাইকপাড়া) পরির দিঘি এলাকার প্রয়াত তোফায়েল আলী মুন্সী। পরির দিঘির দক্ষিণ পাড়ে তোফায়েল আলী মুন্সীর খেলা নামেও একসময় বলীখেলার প্রচলন ছিল। পরবর্তী সময়ে পরির দিঘির খেলা নামে যা পরিচিতি লাভ করে। পাকিস্তান আমলে পরির দিঘির বলীখেলা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে চল্লিশের দশকের দিকে তাঁর ছেলে পটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তৎকালীন চেয়ারম্যান মনির আহমেদ বলীখেলার আয়োজন করতেন।

পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশের দশকের দিকে পটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান প্রয়াত আমজু মিয়া সওদাগর এ খেলা নিজ নামে প্রবর্তন করেন। ফলে পটিয়ায় ‘আমজুর বলীখেলা’ নামে প্রচলন হয়। আমজু মিয়া সওদাগর মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে আবু মুছা সওদাগর এ খেলার আয়োজন করতেন। বর্তমানে আমজু মিয়া সওদাগরের উত্তরসূরি এ খেলার আয়োজন করে। আমজু মিয়া সওদাগরের চাচাতো ভাই হাজি আবুল বশর (৭৩) জানান, ‘১৯৫৫ সাল থেকে আমজু মিয়ার বলীখেলা উপভোগ করে আসছি। তবে তার আগে বলীখেলার প্রচলন শুরু হয় পটিয়ায়। সর্বশেষ পটিয়ায় ২০১৮ সালে আমজু মিয়ার ১১৫তম বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়।’

এখন বলীখেলা বললে সমগ্র দেশে ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে লালদীঘির মাঠের ‘জব্বারের বলীখেলা’।  চাটগাঁ নগরীতে ১৯০৯ সালের ২৬ এপ্রিল বকশীহাটের বদরপাতি এলাকার গোলাম রসুল সওদাগরের পুত্র আবদুল জব্বার সওদাগর ছিলেন কংগ্রেসী ও স্বদেশি আন্দোলনের সংগঠক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সমাজকে শারীরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে বলীখেলার আয়োজন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় জব্বারের বলীখেলা নিয়মিত আয়োজন হয় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির মাঠে। কোভিড-১৯–এর কারণে গত দুই বছর বন্ধ থাকলেও ২০২২ সালের মে মাসে ঐতিহাসিক লালদীঘির মাঠে ১১৩তম জব্বারের বলীখেলা সম্পন্ন হয়। জব্বারের বলীখেলা সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে বলীখেলা বললে জব্বারের বলীখেলা সবার মুখে মুখে।

বলীখেলা প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক ইতিহাসবিদ শামসুল হোসাইনের মতে, ‘চট্টগ্রামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে বলীখেলার প্রচলন ছিল। সুলতানি আমল থেকে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে কুস্তির চর্চা হতো চট্টগ্রামে। তখন চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেনারা ছিলেন মূলত পাদতিক। তাই কুস্তির মধ্য দিয়ে শারীরিক সামর্থ্য ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল তাঁদের। এরপর মল্ল সম্প্রদায়ের মানুষ গ্রামে গ্রামে বৈশাখ মাসে বলীখেলার আয়োজন করতেন। পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার চট্টগ্রামে যেটা চালু করেন, তার সঙ্গে গভীর রাজনৈতিক যোগ ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মুসলিম সম্প্রদায়ের তরুণদের টানতেই তিনি বলীখেলা চালু করেন।’

বলীখেলা নিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল আলিম বলেন, ‘যে খেলায় নির্মল আনন্দ আছে, যে খেলায় সর্বস্তরের মানুষ নির্মল আনন্দ খুঁজে পায়, সেটার নামই বলীখেলা। ১৯৬৯-৭০ সালের কথা, ছেলেবেলায় নির্মল আনন্দ খুঁজে পেতাম আমজু মিয়ার বলীখেলায়। প্রতীক্ষায় থাকতাম কখন বৈশাখ মাস আসবে, কখন বলীখেলা শুরু হবে। বলীখেলার চেয়েও বেশি আনন্দ পেতাম মেলায়। ঢোলের তালে তালে শুরু হতো বলীখেলা। খেলার মাঠের চারদিকে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে–বসে উপভোগ করত। বাঁশির আওয়াজ, মানুষের উপচে পড়া ভিড়, চিৎকার–চেঁচামেচি সন্ধ্যায় আতশবাজির উৎসব! আহা! কী নির্মল আনন্দ উপভোগ করতাম। কালের বিবর্তনে সেটা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।’

লেখক ও গবেষক ইতিহাসের খসড়ার সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, ‘১৯৭০ সালের পূর্ব থেকে পটিয়ায় বলীখেলার প্রচলন ছিল। তুফান আলী মুন্সির বলীখেলা, পরির দিঘির বলীখেলা, ভাটিখাইনের বারেক চেয়ারম্যানের বলীখেলাসহ আরও বেশ কয়েকটি বলীখেলা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সত্তরের দশকে পটিয়ায় বলীখেলার আয়োজন করে আসছে আমজু মিয়া সওদাগরের পরিবার। পটিয়ায় আমজু মিয়ার বলীখেলা নামে ব্যাপক পরিচিত। আমজু মিয়ার বলীখেলা উপভোগ করতে বহু দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসত। সে সময় গ্রামের মানুষের বিনোদনের দারুণ উৎসব ছিল বলীখেলা। ছোটবেলায় এই খেলার চেয়েও বেশি উপভোগ করতাম লোকজ শিল্পের মেলা। মেলা থেকে বাহারি রঙের খেলনা ও আসবাব কিনে নিয়ে যেতাম। মেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ আসত বলীখেলা দেখতে। বলীখেলা মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হতো। মানুষের মধ্যে একটা সেতুবন্ধ রচনা হতো। এটা ছিল অনেকটা নির্মল বিনোদনের মতো। এখন নির্মল বিনোদন নেই।’

১৯৫৫ সালে জন্ম আবদুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতি শওকত আনোয়ার। তিনি বলেন, ‘জব্বার সওদাগর মারা যাওয়ার পর জব্বারের বলীখেলার দায়িত্ব নেন আমার বাবা। বলীখেলা এতটা প্রসারিত ছিল না। লালদীঘি এলাকার বলীদের জন্য আয়োজন করতেন, ঢোলের তালে তালে বলীরা আসতেন, আমরা তখন স্কুলে পড়ি। আমরাও তাঁদের পিছে পিছে ঘুরতাম। বাবার মুখে শুনেছি, বলীখেলার প্রচলন হওয়ার পর বলীরা মাস দুয়েক আগে থেকে এসে আমাদের বাড়ির একটা বৈঠকখানায় থাকতেন। খাওয়াদাওয়া করতেন, বলীখেলার অনুশীলন ও শারীরিক কসরত ও প্রস্তুতি নিতেন। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি আরও বলীখেলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সত্তরের দশক থেকে বিভিন্ন জেলার কুস্তিগিররা জব্বারের বলীখেলায় আসতে শুরু করেন। জব্বারের বলীখেলা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ার পর সমগ্র দেশের মানুষ জানতে পারে এটি সম্পর্কে।’

বলীখেলার ঘোষণা কীভাবে হতো
আগেকার দিনে বলীখেলার দিন-তারিখ ঠিক হলে হাটবাজারে ঢোল পিটিয়ে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতো। কেউ কেউ কেরোসিনের টিন বা চামড়ার ঢোল পিটিয়ে গ্রামগঞ্জে বলীখেলার দাওয়াত করত। মাইকের মাধ্যমে মানুষদের খেলা উপভোগ করার জন্য সবিনয় দৃষ্টি আকর্ষণ করত। খেলা যেদিন শুরু হবে, সেদিন ঢোল, ব্যান্ডপার্টির বাদ্যের আওয়াজে মুখর থাকত শহর। বর্তমান সময়ে কার্ড ও খুদে বার্তা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় ঘোষণা দেওয়া হয় যে জব্বারের বলীখেলা শুরু হতে যাচ্ছে। ভেন্যু, সময়, উদ্বোধক, অতিথি ও আয়োজকদের নামও ঘোষণা করা হয়।

কোথায় বেশি আয়োজন হয়
পুরো বাংলাদেশে বলীখেলাকে সবচেয়ে বেশি পরিচিত করেছে চট্টগ্রাম নগরের লালদীঘি মাঠের ‘জব্বারের বলীখেলা’। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার উল্লেখযোগ্য জায়গা হলো, পটিয়ার তোফায়েল আলী মুন্সীর বলীখেলা, পরির দিঘির বলীখেলা, আমজু মিয়ার বলীখেলা, ভাটিখাইনের বারেক চেয়ারম্যানের বলীখেলা, সিআরবির শিরিষতলার শাহাব উদ্দিনের বলীখেলা, হাটহাজারীর ফতেপুরের বলীখেলা, মাদার্শার বলী নোয়াপাড়ার বলীখেলা, নোয়াপাড়ার বলীখেলা, নাজিরহাটের বলীখেলা, বড়তাকিয়ার বলীখেলা, ভুজপুরের বলীখেলা, করের হাটের বলীখেলা, ছালিমপুরের বলীখেলা, নদীমপুরের বলীখেলা, চুয়ারখাঁর বলীখেলা, ফটিকছড়ির বলীখেলা, বেতাগীর বলীখেলা, রানীরহাটের বলীখেলা, সাতকানিয়ার বলীখেলা, রামুর বলীখেলা ও কক্সবাজারের বলীখেলা।

বলীখেলা বা কুস্তিখেলার পদ্ধতি ও পুরস্কার
প্রাচীনকাল থেকে বলীখেলার কিছু নিয়ম ছিল। বলীদের খালি হাতে হাফপ্যান্ট বা নেংটি পরে কুস্তি বা বলী ধরতে হবে। হাতের আঙুলে কোনো ধাতব বস্তু কিংবা আংটি শিকল থাকতে পারবে না। বলীদের হাতে মাটি বা বালু মারতে পারবে না। পেট, চোখ, মাথা, বুক ও কানে আঘাত করা যাবে না। ঘুষি ও লাথি দেওয়া যাবে না। চুল বা কানে ধরে আঘাত করা যাবে না। হাত–পায়ে হাঁটুর ওপর নিচের দিকে প্যাঁচ দিতে পারবে কৌশলে। তবে শারীরিক আঘাত হয় এমন কোনো প্যাঁচ বা কৌশল করা যাবে না। বলী শুরু হওয়ার আগে দুই বলী নাচানাচি করতে পারবেন; তবে দিগম্বর হওয়া যাবে না। শরীরে কোনো তৈলাক্ত পদার্থ বা ঘি, চর্বি ও তৈল ব্যবহার করা যাবে না। হাতের নখ ছোট থাকতে হবে। দুই বলী বা দুই কুস্তিগির বলী ধরার আগে সালাম ও কুশল বিনিময় করে আনন্দের সঙ্গে খেলা শুরু করবেন। পিঁপ পিঁপ করে রেফারির বাঁশি ও ঢোলের বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে শুরু হবে বলীখেলা। দুজনের মধ্যে কৌশল ও শক্তিপরীক্ষার খেলা চলতে থাকে বেশ কয়েক মিনিট ধরে। সাধারণত ১৫ থেকে ২০ কিংবা ২৬ মিনিট পর্যন্ত চলতে থাকে লড়াই। কৌশলে হাত-পায়ের প্যাঁচ বা কসরত আর বাহুবলীরা শক্তি দিয়ে অপরজনকে মাটিতে ফেলে পিঠ ঠেকাতে পারলেই জিতে যান একজন বলী। নিয়ম ভঙ্গ করে যদি কেউ কাউকে আঘাত করে, তখন ফাউল হয়। আগেকার দিনে কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে তাকে শাস্তিস্বরূপ বেত্রাঘাত ও জরিমানা করা হতো। বলীখেলায় চ্যাম্পিয়নদের সোনা-রুপার মেডেল, ট্রফি ও সঙ্গে টাকা প্রদান করা হয়। আবার আগেরকার দিনে গ্রামগঞ্জের বলীখেলায় নগদ টাকা, টেলিভিশন ও দামি জিনিসপত্র পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হতো। ২০২৩ সালে জব্বারের বলীখেলার ১১৪তম আসরে চ্যাম্পিয়নকে নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং রানারআপকে ২০ হাজার টাকা ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারীকে ১৫ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

বিখ্যাত বলীদের নামের তালিকা
দক্ষিণ চট্টগ্রামের পরাণ সিকদার বলী, নাজির বলী, ঠেকর মুনশীর বলী, তুফান বলী, আলী মুন্সী বলী, আহাদ বলী, গইন্যা বলী, মীরা বলী, রহমান বলী, করিম বলী, রফিক বলী, গুন্নু বলী।

চাটগাঁ শহরের, বিশেষ করে উত্তর চট্টগ্রামের বিখ্যাত বলীদের উল্লেখযোগ্য নামের তালিকায় আছেন—অলী বলী, টুইখ্যা বলী, বাদশা বলী, হামজা বলী, হামিদা বলী, লালমিয়া বলী, দুইধ্যা বলী, এয়াকুব বলী, সুলতান বলী, ওয়ালী বলী, বাদশা বলী, ইউছুফ বলী, খাজা বলী, লেদুবলী, তজু বলী, আবুল্যা বলী, আবদুল হাকিম বলী, জালাল বলী, নুরা বলী, বজল বলী, হামদু বলী, আবদুল গফুর বলী, চুন্নু বলী, এজাহার আলী বলী, সোনা মিয়া বলী, সুলতান বলী, আশিক্য বলী, জেবল বলী, শ্রীমণ্ড বলী, অনিক্যবলী, মতি মাস্টার বলী, এজাহার বলী, নাজিম বলী, কালু বলী, অলী বলী, টেকনাফের আলম বলী, কুমিল্লার সোহারাব বলী।

বলীখেলা, লোকজ শিল্পের সমাহার ও বৈশাখী মেলা
মহাত্মা গান্ধী চট্টগ্রাম পরিদর্শনে এসে একদা বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম সর্বত্রে এগিয়ে’। কথাটি এমনি বলেননি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতার ঘোষণাও হয় কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে। তা ছাড়া আমাদের রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্যের রানি পাহাড়–পর্বত, নদী, সমুদ্র, উপত্যকা, নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচার, বিশেষ করে বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লোকজ শিল্পের মেলা বসে। বৈশাখ মাসে হয় বিধায় অনেকে বৈশাখী মেলাও বলে। মেলা কিন্তু বলীখেলার ভাবমূর্তি ও গাম্ভীর্যতা আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। জব্বারের বলীখেলা বা বিভিন্ন উপজেলায় বলীখেলাকে কেন্দ্র করে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বলীখেলাকে ভিত্তি করে লোকজ শিল্পের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রসারও লাভ করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা চারুশিল্প, কারুশিল্প ও মৃৎশিল্পসামগ্রী নিয়ে মেলায় স্টল দেন। কেউ কেউ রাস্তায় পসরা সাজিয়ে বসেন। বিকিকিনি সদাইপাতিও বেশ ভালো হয়। ঘরকন্নার জিনিসপত্র, বিশেষ করে রন্ধনশিল্পীদের রসুইঘরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র মেলায় ওঠে। মাটির হাঁড়িপাতিল, ফুলের টব, মূর্তি, সানকি, মালশা, বাঁশের ও বেতের  তৈরি চালইন, বিচইন, কুলা, ডালা, ডোলা, ঝুড়ি, উইজ্যা, লোহার তৈরি দা, বটি, কোদাল, ধামা, ছুরি, খুন্তি, হামানদিস্তা, তাওয়া,  গৃহসজ্জার আসবাব, সাজসজ্জা, কারুপণ্য, মাদুর, শীতলপাটি, তালপাতার পাখা, পাটের তৈরি জিনিসপত্র, নকশিকাঁথা, গাছের চারা, ফুলদানি, নানা রকমের খেলনা মুরালি বাঁশি। খাবারের স্টল, পিঠাপুলি, মোয়া, গজা, খই—সবই পাওয়া যায়। বলীখেলা ও মেলা শুরু হলে আন্দরকিল্লা, নন্দনকানন, লালদীঘির মাঠ থেকে কোতোয়ালি, চেরাগী পাহাড় ডিসিহিলের আশপাশে যানবাহন চলাচল অনেকটা বন্ধ থাকে। মানুষের ভিড়, ব্যবসায়ী ও ফুটপাতের হকারদের চেঁচামেচি ও হাঁকডাকে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

বলীখেলা আমাদের চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের খেলা। বলীখেলা আমাদের শিকড়ের খেলা ও বিনোদনের উৎসব। দেশের মানুষ জানে, এটা চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি। কালের বিবর্তনে আকাশ-সংস্কৃতি ও ডিজিটালের জাঁতাকলে বলীখেলা যেন হারিয়ে না যায়। ঢাকঢোল পিটিয়ে আতশবাজি উৎসবে বলীখেলার আনন্দ ঝরনাধারা ছড়িয়ে পড়ুক সমগ্র দেশের মানুষের হৃদয়ে। নাগরদোলা, বাঁশি, টমটম গাড়ির শব্দ, লোকজ শিল্পের প্রাণের মেলা অনন্তকাল বেঁচে থাকুক গ্রামবাংলায়। আঁরার ঐতিহ্য আঁরার বলীখেলা।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা