মোমবাতি নিবু নিবু, প্রায় শেষের দিকে। টেবিলে বসে বই পড়ছি। খুব বিরক্তের সঙ্গে এক প্রকার জোর করেই পড়ছি। কাল পরীক্ষা। ঘুমও পাচ্ছে।
জানালা থেকে জ্যোৎস্না এসে গায়ে পড়ছে। অন্য দিনের থেকে আজ চাঁদটাকে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। এক ভিন্ন অনুভূতি কাজ করছে। জানালার পাশে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত এই শহর।
পাশেই বেশ বড় একটা কবরস্থান। কবরস্থানের সব থেকে বড় তালগাছটা মাথা নাড়িয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। চাঁদের আলোয় গাছটিও তার ছায়ার সঙ্গে দুলছে মৃদু বাতাসে।
বিদ্যুৎ না থাকায় অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখতে পেলাম। আরও গভীরভাবে দেখতে লাগলাম আশপাশটা। কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আকাশটা! হঠাৎ করেই চোখ পড়ল মসজিদের ছাদের দিকে। মসজিদের কাজ চলছে, এখনো ছাদের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। বাসা থেকে একটু দূরে। কবরস্থানের পরই মসজিদটি। মসজিদের ছাদে চোখ পড়তেই চমকে গেলাম।
একটু দূরে হওয়ায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কুয়াশার মতো এক ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। এত রাতে মসজিদের ছাদে ওই লোকটি কী করছে?
সে হাঁটছে আর দুই হাত নাড়িয়ে কী যেন বলছে। কী বলছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিছু যে একটা বলছে, তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগল। তখনই দেখি লোকটা কী যেন একটা করছে। ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এক দণ্ড রড নিয়ে ছাদের ওপর আঘাত করছে বারবার। কাউকে খুন করছে না তো? হঠাৎ মনে হলো দম বন্ধ হয়ে আসছে।
মুহূর্তেই সুন্দর পরিবেশটা ভয়ংকর রূপ নিল। ছোট ছোট পা ফেলে বিছানায় এসে বসলাম। মোমবাতি নিভে গেছে এতক্ষণে। জ্যোৎস্নার আলো জানালা থেকে রুমে আসায় সবকিছু যেন দিনের আলোর মতো দেখা যাচ্ছে। মোবাইলের লাইট নিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। পুরো রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম। কেমন যেন লাগছে, ঘুমও আসছে না।
মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সকাল হয়ে গেছে। রাতে কখন যে ঘুমিয়েছি, খেয়াল নেই। রাতের ঘটনাগুলো আবার মাথায় নাড়া দিল। আবারও উল্টাপাল্টা প্রশ্ন মাথায় এসে উঁকি দিতে লাগল। ওসবে মন না দিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। অনেক দিন ধরে পরীক্ষার ঝামেলা শেষই হচ্ছে না। আজ পরীক্ষা শেষ ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। হঠাৎ ভাবলাম, আজ রাতে যদি আবার গতকালের মতো কিছু দেখতে পাই তাহলে বন্ধু ইয়ামিনকে নিয়ে যাব।
কিন্তু কী ছিল এত রাতে? এত রাতে কেউ ছাদে একা উঠে কী-ই বা করবে? এসব ভাবনা আর ভালো লাগছে না। পরীক্ষা শেষ করে সোজা বাসায় চলে এলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আমতলা পার্কে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শরীর সায় দিল না। খাওয়াদাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম। ঘুমে চোখটা লেগে আসছে, রাতে ঠিকভাবে ঘুম হয়নি।
হঠাৎ ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে, হাত-মুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। অনেকটা আগ্রহ নিয়ে বসে আছি একা রুমে, কখন রাত আরও গভীর হবে, কখন সে আসবে। আসবে তো?
দেখতে দেখতে রাত একটা বেজে গেল। কিন্তু কেউ এল না।
অপেক্ষা...! অপেক্ষা করা যে কী কঠিন, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। হঠাৎ করেই দেখলাম কেউ একজন এসেছে গতকালের মতো। গত রাতের মতোই সবকিছু হচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, এত রাতে যাওয়া কি ঠিক হবে? যাব? ইয়ামিনকে কল দেব কি?
মনে পড়ল, ইয়ামিন এত রাতে আসতে পারবে না। তাহলে কি একাই যেতে হবে? ভেবেই ভয় লাগতে শুরু করল। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল মুহূর্তেই। পরক্ষণেই মনে সাহস নিয়ে ভাবলাম, কী আর হবে। যা হবে দেখা যাবে। আর আমি কি ভিতু? না, একটুও না, আমি অনেক সাহসী। এসব বলে নিজেই নিজেকে উৎসাহ দিলাম। তারপর প্রস্তুত হলাম যাওয়ার জন্য, সঙ্গে একটা বড় টর্চলাইট নিলাম। যাওয়ার আগে আর একবার তাকিয়ে দেখলাম সে আছে কি না?
হ্যাঁ, আছে! আজ আরও ভয়ংকর লাগছে। সাদা জামা পরেছে সে। আজও গতকালের মতো করছে সেই অন্ধকার ছায়া। দূর থেকে দেখেই ভয়ে শরীর একেবারে ঠান্ডা হয়ে আসছে। কে সে? নিজের ভেতর অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে যাব বলে স্থির করলাম।
বাসা থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে হাঁটছি। পুরো রাস্তা খালি, জনমানবশূন্য। এমনকি একটা গাড়ি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ঘড়ি দেখলাম, রাত ২টা বাজে। মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। মনে মনে ভাবছি, আর কিছুক্ষণ পরই সব প্রশ্নের উত্তর পাব।
মসজিদের সামনে কয়েকটি কুকুর ছিল। ওরা আমার পরিচিত, প্রতিদিনই দেখি। ওরা আমাকে দেখে কোনো আওয়াজ করল না। কিন্তু কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। সবকিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছে। মসজিদের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে লাগলাম। যত ওপরে উঠতে লাগলাম তত দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। শরীর থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে। বুকের ধুব ধুব আওয়াজ যেন বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। অবশেষে ছাদে এসে পৌঁছালাম।
কোথায়? সে কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না যে। হঠাৎ দেখলাম, ছাদের একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। ধবধবে সাদা জামা পরা, বেশ লম্বা। ভাঙা ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে আপনি?’ সে উত্তর দিল না। পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছেন এত রাতে এখানে?’ সে এবারও কিছু বলল না। আবার কিছু একটা বলব, তখনই ঘুরে আমার দিকে তাকাল। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে।
হঠাৎ সে বলে উঠল, হাওয়া খাচ্ছি।
আমি তাকে আবারও কিছু একটা বলার জন্য অনেক করে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভয়ে মুখ থেকে একটা শব্দও বের হলো না। হঠাৎ মনে হলো হাত-পা স্থির হয়ে যাচ্ছে। কাঁপতে কাঁপতে হুঁশ হারিয়ে ফেললাম।
কানে ভেসে এল হাসির শব্দ। মনে হলো কেউ যেন তৃপ্তির হাসি হাসল।
ইমু, ইমু ডাকে লাফ দিয়ে উঠলাম। ইয়ামিনের গলার স্বর। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভাবতে থাকলাম, কে ছিল? কেনই-বা এত রাতে ছাদে এসেছিল? রড দিয়েই বা কী করছিল? কোনো উত্তর পেলাম না। রহস্য হয়ে থেকে গেল।
স্বপ্নের মধ্যেই হারিয়ে গেল কোনো এক অজানা রহস্য।