‘পৌষ মাসের পিরিত’ মন এবং শরীরের মুক্তি, মানবাধিকারের কথা বলে। এটি একটি শিল্পোত্তীর্ণ মনস্তাত্ত্বিক গল্প।
জনপ্রিয় কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কালজয়ী ‘রস’ গল্প অবলম্বনে অনবদ্য একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক নার্গিস আক্তার। চলচ্চিত্রের সুন্দর একটি নামকরণ করেছেন ‘পৌষ মাসের পিরিত’। বাংলায় প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’। পৌষ মাস মানে সুখে, শান্তিতে ভালো দিন। এই পৌষ মাসের আক্ষরিক সুখ–শান্তি বিরাজ করে আবহমানকালের গ্রামবাংলার পৌষ-পার্বণের মূল কান্ডারি ফসল ফলানো কৃষকদের জন্য। তাঁদের দৌলতেই ঘরে ঘরে পিঠাপুলি নাড়ু-মোয়ার নবান্ন উৎসব আসে। প্রকৃতির সোনা ফলানো জমিন আবাদ এবং মানবজমিন আবাদের দুইয়ের পারস্পরিক সম্পর্ককে উৎস করে ‘রস’ গল্পের যাত্রা। সেই গল্পকে অনবদ্য দৃশ্যকাব্যে রূপান্তরিত করে রীতিমতো একটা খাঁটি বাংলাদেশের সুর জারিত মহাকাব্য নির্মাণ করলেন নারী পরিচালক নার্গিস। একদিন না একদিন আমাদের সামাজিক লিঙ্গবৈষম্য অবশ্যই মিটে যাবে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঘরে-বাইরে নারীদের উপযুক্ত মর্যাদা দিতে শিখবে, সমানাধিকার নিয়ে সেদিন আলাদা করে আর ‘নারী পরিচালক’ কথাটা উল্লেখ করতে হবে না।
‘পৌষ মাসের পিরিত’ মন এবং শরীরের মুক্তি, মানবাধিকারের কথা বলে। এটি একটি শিল্পোত্তীর্ণ মনস্তাত্ত্বিক গল্প। গল্পের পরতে পরতে দেহকে মন্দির করে আত্মোন্মোচনের দার্শনিক তত্ত্বকথা আছে। নারী শরীরের সঙ্গে এখানে মিলে যায় খেজুরগাছের রূপক। আবার শিল্পী যেমন পাথর কেটে ভাস্কর্য নির্মাণ করেন, গাছ কাটাও পরম একটি সাধনা। গাছি একজন শিল্পী, দক্ষ কারিগর। পুরুষ যেমন নারী শরীরে প্রবেশ করে ভালোবাসার বাগান সাজিয়ে তোলেন, প্রেম আর কাম দেহমন্দিরকে পবিত্র করে তোলে। ‘রস’ গল্পটি পশ্চিমবঙ্গেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয়। এই গল্পের সাহিত্যরসকে চলচ্চিত্রায়িত করা সহজ কাজ নয়। বাণিজ্যিক ধারার কোনো অদক্ষ পরিচালকের হাতে পড়লে একটি অশ্লীল চলচ্চিত্র নির্মিত হতো, শ্লীল আর অশ্লীলের যে চিরকালের দ্বন্দ্ব শিল্প উত্তীর্ণ হওয়ার যে সূক্ষ্ম সুতার ওপরে নির্ভর করে, প্রগাঢ় প্রজ্ঞা এবং গভীর মননশীল সৃজনশীলতা ছাড়া তা করা সম্ভব নয়। দেহতত্ত্ব, মানবতত্ত্ব, কৃষি ফলনতত্ত্ব একে অপরের পরিপূরক। সব দিক উন্মোচিত করার শৈল্পিক গুণ বিচারে নার্গিস অবশ্যই একজন গুণী পরিচালক।
কাহিনি বিন্যাস, সংলাপ ও রচনা করেছেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। বাংলাদেশের মাটির সুর এই ছবির ব্যঞ্জনাকে ছড়িয়ে দিয়েছে। মমতাজ, মনির খানের কণ্ঠে ‘বন্ধু আমারে পোড়াও…’ গানটি যেমন হৃদয়গ্রাহী, চিত্রায়ণও চমৎকার। সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ‘রূপের সিন্দুক খুইলে দিব...’ মন ছুঁয়ে যায়। ‘ফুলে ফুলে ভ্রমর দোলে আমার ভ্রমর কই রে...’, ‘আমার মন মৈজেছে রঙ্গিলা পিরিতে…’ সুন্দর গানগুলোও অনবদ্য চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। ছবির সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী নিজের শ্রেষ্ঠটুকু উজাড় করে দিয়েছেন। তবে কিছু কিছু দৃশ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে বাউল, ফকিরদের মতো খালি গলায় গান হলে ভালো লাগত।
রাজেক মৃধা চরিত্রে আহমেদ রুবেল যখন কামারশালায় কামারের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন তাঁর কণ্ঠে হঠাৎ যান্ত্রিক সুরের গান ভালো লাগেনি। এই ছবির শিল্পনির্দেশক মোহাম্মদ কলমতর, কোরিওগ্রাফার এ কে আজাদ, চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খান, সম্পাদনা মুজিবুর রহমান দুলু, রূপসজ্জায় দীপক কুমার সুর, পোশাক পরিকল্পনা মিষ্টি রহমান—সবারই কাজের প্রশংসা করতে হয়। সবাই মিলে অপরূপ বাংলার মুখ উন্মোচিত করেছেন।
রাজেক মৃধা চরিত্রে আহমেদ রুবেল অভিনয়ের গুণে অশিক্ষিত চাষি থেকে অনেক বড় মাপের গাছি শিল্পী এবং জীবনশিক্ষক হয়ে উঠেছেন। বেঁচে থাকলে রুবেলকে দিয়ে কেউ বড় একজন দার্শনিকের চরিত্রে বা বাউল ফকির চরিত্রে সফল অভিনয় করিয়ে নিতে পারতেন। মোতালেফ চরিত্রে টনি ডায়াস একাধারে গ্রামীণ প্রেমিক এবং কূটকৌশলী রস ব্যবসায়ীর অন্তর্মুখী দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। মাজু বিবি চরিত্রে পপি একজন দক্ষ গুঁড়ের কারিগর শুধু নয়, রক্তমাংসের নারীশরীরের যৌবনযাতনা, ঘরে-বাইরে পদে পদে সামাজিক লাঞ্ছনা, প্রেমিকা বধূ থেকে মমতাময়ী মাতৃত্বস্বরূপা নারী প্রতিটি ভাঙা-গড়ায় সুন্দর অভিনয় করেছেন। ফুলজান চরিত্রে প্রিয়াঙ্কাও চঞ্চলা চপলা গ্রামের মনমাতানো সুন্দরী থেকে জীবনের ভাঙা-গড়ার বিধ্বস্ত নারী অভিনয়ে রূপের ঝলক ছড়িয়ে দিয়েছেন। অন্য সবার অভিনয়ও বেশ ভালো।
মাজু নামক বঙ্গললনার সুন্দর মুখে কচুপাতার মুক্তোরাশি ছিটকে পড়ার ঝলকের মতোই অপরূপ দৃশ্যকাব্য হয়ে থাকবে এই চলচ্চিত্র। পৌষ ফুরোলে রস ফুরিয়ে যায়, লোলুপ ব্যবসায়ীর কাছে রসের কারিগরের প্রেমের মান থাকে না—এমন সহজ সরল সত্য কথার উচ্চারণের মধ্য দিয়েও এই ছবি জীবনের শাশ্বত সাধনার কথা বলে যায়। জীবনরসের সাধনা প্রতিটি শিল্পী এবং মানব জীবনের চলার পথের মূল বার্তাবাহক।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত