রিমা, আমি আর সমীর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দেয়ালঘড়ির পেছনে টিকটিকি যুগল টিকটিক করে উঠল। ওখানেই ওদের সংসার। বেশ। রাত ১১টা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নায়িকা শাবানার সঙ্গে ঘোরসন্ধ্যা কাটাচ্ছি। কম্পিউটারে কেএম প্লেয়ারের পর্দায় শাবানা ম্যাডাম ননস্টপ নেচে–গেয়ে যাচ্ছেন, ‘ও দরিয়ার পানি, তোর মতলব জানি, তোর ছোঁয়াতে যৌবনে মোর লাগল শিহরণ...’ শাবানা ম্যাডামের দিকে চোখ রেখে বললাম, ম্যাডাম, আপনি বিরতিহীন গাইতে থাকেন, নাচতে থাকেন; আমি আছি আপনার সঙ্গে। আহা!

আমার আর শাবানা ম্যাডামের সখ্যে ছেদ পড়ল; বিবেকহীন মুঠোফোন নামক যন্ত্রের রিংটোনের আওয়াজে। রাতবিরাতে কে আমাকে মনে করে? কোন সে দরদি? খুশি হওয়ার মতো কেউ নয়, সেয়ানা বালক সমীর, ঘোড়া ডিঙিয়ে চুপি চুপি ঘাস খেতে যার জুড়ি নেই। মিচকা শয়তানটা এত রাতে কেন?
‘হ্যালো, সেয়ানা বালক, বলো।’ বললাম আমি।
‘মুনির ভাই কি বাসায় আছেন?’
‘হুঁ।’
‘একাই আছেন?’
‘না, তোমার বইন আছে লগে।’
‘আমি আসতেছি আপনের বাসায়।’
‘আসো।’

মনিটরে চোখ রেখে বললাম, ম্যাডাম, একটা বালক আসতেছে, আমাদের বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য। ছোকরাটা এলেই এই বিচ্ছেদ কার্যকর হবে। দুঃখিত, নিশ্চয়ই এই সন্ধ্যাকালীন গানের জলসায় আবার দুজনের দেখা হবে। আপাতত বালক সমীর না আসা পর্যন্ত গাইতে থাকেন, ও দরিয়ার পানি, তোর মতলব জানি...।

রাত ১২টার দিকে ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সমীর এল। এসেই পাঠ নিল, ‘“ও দরিয়ার পানি, মতলব জানি” দেখছেন, এই সব এখন চলে? বিদ্যার “উলালা” থাকলে চালান ফিলিংস আনি।’  বললাম, ‘মিয়া, তোমার পোলাপাইন্যা চোখ, পোলাপাইন্যা জিনিসই তো দ্যাখবা।’
সমীর তর্কবালক, তর্ক করল। শেষমেশ আমার ছ্যাঁচানি খেয়ে শাবানা ম্যাডামকে সালাম দিতে বাধ্য হলো। তারপর জানতে চাইলাম, ‘তা কী মনে কইরা আসলা?’
‘ভাই, রুমে সারা দিন একা ছিলাম, রাতে আর একা একা ভালো লাগছিল না।’
‘ভালো করছ। এইটা কোনো কথা কও, আমগো কি একলা থাকনের বয়স? পড়াশোনা কবে শেষ হইব, কবে চাকরি পামু, এরপর নাকি মা–বাপে ঘটকরে খবর দিব; এইটা কোনো কথা কও?’
‘ঠিকই বলছেন ভাই, এইটা অবিচার।’
‘কঠিন অবিচার।’
‘ভাই, বিদ্যার “উলালা” গানটা চালান।’
‘আমার পিসিতে বিদ্যাও নাই, উলালাও নাই, এক্সট্রারাও নাই। ক্লিয়ার, বালক?’
‘কী বলেন? “উলালা” নাই? বিশ্বাস হয় না।’
‘সত্য। আর তুমি নিজেই তো একটা উলালা, নেও উলালা নাচ শুরু করো দেখি।’
‘থাক। উলালা গান লাগবে না, এখন তাহলে কী করবেন?’
‘কিছু না, হুদাই বইস্যা থাকুম।’
‘হুদাই?’
‘হ, হারা দিন হুদাই-হুদাই বইয়া রইছি, রাইতও হুদাই পার করুম।’
‘আপনার কোনো বান্ধবীকে ফোন দেন, কথা বলি।’
‘বান্ধবী নাই। থাকলে কি হুদাই–হুদাই....? তোমার বান্ধবীরে ফোন দেও।’
‘সাথি কি এত রাতে ফোন রিসিভ করবে? সমস্যা থাকতে পারে; সকালে দিব।’
‘তাইলে আর কী, হুদাই বইস্যা থাকো।’

বাকি রাতটা আর আমার হুদাই কাটেনি, সমীরের বিদ্যা বালান এসে চোখের সামনে কিছুক্ষণ ‘উলালা উলালা’ করে গেল। কাছে টানলাম। সরে গেল ঠোঁট বেঁকিয়ে। আরও জোরে টেনে ধরতেই পাশ থেকে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সমীর বলল, ‘ভাই কি পানি খাবেন?’
উত্তর দিলাম না কোনো। চোখ মেলে দেখি, দেয়ালঘড়িতে বেলা ১১টা। বাসা থেকে দুজনের কেউই বাইরে পা দিলাম না। মটকা মেরে ঘরের মধ্যেই পড়ে রইলাম অলসভাবে। অলসদের প্রতিযোগিতা হলে নিশ্চিতভাবে আমি চ্যাম্পিয়ন আর সমীর রানারআপ হতো।
দুপুর পেরিয়ে বিকেলের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সময়। এ সময় সমীর বিছানা থেকে উঠে বসে সোজা হলো। তারপর আমাকে ডেকে বলল, ‘ভাই, সাথিরে ফোন দিয়ে দেখি, কী বলেন?’
‘তোমার সাথিরে তুমি ফোন দেও আর কী দেও, তা তুমিই জানো।’

অতি উৎসাহ আর আশা নিয়ে সাথিকে ফোন করল সমীর; ঠিক পঞ্চান্ন সেকেন্ড পর সমীর মরা মাছের মতো চোখ-মুখ করে বলল, ‘ভাই, সাথির নাকি পরীক্ষা চলে।’
‘ঠিকই তো আছে। তুমি অকর্মা, ওর পড়াশোনা আছে, পরীক্ষা আছে, ভালো তো।’
‘ভাই, আপনি জানেন না, ওই মেয়ের সারা বছর পরীক্ষা! যখনই ফোন করি, বলে, “ভাইয়া, আমার তো পরীক্ষা।”’
‘হা হা হা...।’
‘আচ্ছা ভাই; সেদিন যে মেয়েকে আপনার সঙ্গে টিএসসির আড্ডায় দেখলাম, নামটা মনে পড়ছে না, কী যেন নামটা...।’
‘রিমার কথা বলতেছ?’
‘জি ভাই, রিমা। রিমা–ই নাম...ওরে একটা ফোন দেন।’
‘ফোন দিয়া কী কমু?’
‘কোথাও আসতে বলেন।’
‘কইলেই আইব?’
‘আপনি বললে, কোন মেয়ে আসবে না? রিমা তো রিমা, সাথিও ছুইটা আসব। তবে সাথিরে না, রিমারে টিএসসির ওদিকে আসতে বলেন।’
‘ভাইও, ভালোই ফুলানি দিলা। তাইলে সাথিরেই ফোন দেই, কী কও?’
‘থাক ভাই, বাদ দেন, রিমা মেয়েটা কিন্তু সুন্দর আছে।’
‘আপন–আপন লাগে, না?’
‘ঠিক বলছেন ভাই।’

চুপ করে রইলাম। জানালার ওপাশে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, ‘ওরে সমীর, তুই রিমার দিকেও নজর দিছিস, ওকে আমি সারা দিন-রাত বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুরিফিরি।’
সমীর আমাকে মৃদু ধাক্কা মেরে বলল, ‘ভাই, কী চিন্তা করছেন? এত চিন্তা করে লাভ নাই। ফোন দেন।’
হুঁশ ফেরে আমার। মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে রিমাকে মিথ্যে মিথ্যে কল দিয়ে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বলি, ‘ফোন বন্ধ কইরা রাখছে।’
মুখে হতাশার ভঙ্গি করে ফোনটা বিছানার ওপর ছুড়ে মারলাম। ফোনটা তখনই নেচে উঠল। কে আর কল দিবে, নিশ্চয়ই আসমান থেকে কোনো পরিটরি হবে! রিমা কল দিয়েছে।
‘হ্যালো!’ বলতেই ওপাশ থেকে রিমা বলল, ‘মুনির ভাইয়া, আপনি কি এক্ষুনি টিএসসির দিকে আসতে পারবেন?’
‘এইটা তুমি কী কইলা? চোখের পলকে আইতাছি।’ বলে ফোন রেখে সমীরের দিকে তাকালাম, ওর চোখেমুখে রাজ্যের প্রশ্ন, ‘কে ভাই? কোনো মেয়ে নিশ্চয়ই?’
‘না, তোমার বইন। অখন রেডি হও, বাইরে যাইতে হইব।’

আলস্যের আড়মোড়া ভেঙে কচি সবুজ পাতার মতো জেগে উঠলাম দুজন।
আমাদের রেডি হতে দুই-চার মিনিটের বেশি লাগল না। তিন নম্বর বাসে চড়ে বসলাম। বাস থেকে নেমে হেঁটে টিএসসিতে এসে দেখি, রিমা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে, ওর হাতে বৃষ্টিভেজা কদমগুচ্ছ। একটা ব্যাপার আগেও খেয়াল করেছি—বর্ষার কদম মেয়েগুলোর হাতে কীভাবে যেন চলে আসে। ইচ্ছা করছে, ঢাকা শহর তন্নতন্ন করে সব কটা কদম ফুল ওকে এনে দিয়ে বলি, ‘ঢাকা শহরের সব কটা কদমগাছের মালিক এই বান্দা; ফুলগুলোর পাহারায় সার্বক্ষণিক বেতনভুক্ত একজন মালি নিয়োজিত।’ রিমা হাতে শুধু কদমই নয়, বাঁ হাতে একটা একটা ভারী ব্যাগ শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমি কিছু বলার আগেই রিমা বলল, ‘চলেন।’
‘কোথায়?’ জানতে চাইলাম।
‘আমি যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে।’
‘আচ্ছা।’ বলে আমার পাশে দাঁড়ানো সমীরকে দেখিয়ে বললাম, ‘এইটারে লগে লমু?’
‘হুম, চলেন।’
রিমার ডাক, ‘নামেন, এসে গেছি।’
নামলাম। দেখলাম একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে। এ ছেলের হাতেও একটা ভারী ব্যাগ। ছেলেটিকে দেখিয়ে রিমা বলল, ‘মুনির ভাইয়া, ওর নাম সৌরভ।’

বিনীত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিল সৌরভ নামের ছেলেটি। হাতে হাত রেখে পরিচিত হলাম। রিমা বলল, ‘মুনির ভাইয়া, আমি আজ বিয়ে করতে যাচ্ছি; সৌরভ আমার বর। আপনি আমাদের বিয়েতে সাক্ষী হবেন।’

বন্ধু, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা

লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।