মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বুদ্ধিজীবী–সমাজ

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে জাতীয় পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে এক শিশুফাইল ছবি: হাসান রাজা
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীরা বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, অনেককে জীবন দিতে হয়েছে।

একাত্তরে যখন মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে, তখন বিশ্বরাজনীতি এক জটিল দ্বন্দ্বে উন্মত্ত। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানপ্রেমে বিভোর। মাও সে-তুংয়ের সমাজতান্ত্রিক গণচীনও আদর্শ, তত্ত্ব-দর্শন ভুলে মার্কিনদের সঙ্গে এককাট্টা হয়েছে। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ছিল পশ্চিমা পরাশক্তির প্রভাববলয়ে বন্দী এবং অনেক ক্ষেত্রেই পঙ্গু, অর্থনৈতিকভাবে অসহায়। তাদের পক্ষে সংকীর্তনের আসরের দোহারের ভূমিকা পালন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আরব-দুনিয়ার মুসলিম দেশগুলো তো ইসলামি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক শক্তির অভ্যুত্থানে ভীষণ অখুশি ছিল। এই যখন বিশ্বরাজনীতির পরিস্থিতি, তখন পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গণতান্ত্রিক রায় নিয়ে ত্রাতারূপে আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে চাইলেন ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা খানরা। কিন্তু কোনো কিছুতেই জেগে ওঠা বাঙালির প্রাণের জোয়ারকে ঠেকানো গেল না। চরম বৈরী ও বিরূপ পটভূমিকায় রক্তসমুদ্র মন্থন করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলো। এমন বিরূপ-বিরুদ্ধ পরিবেশে কী করে বাংলাদেশের উজ্জ্বল অভ্যুদয় সম্ভব হলো? কী করে অনভিজ্ঞ বাঙালি মাত্র ৯ মাসে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী, পরাক্রান্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করল? উত্তর হলো স্বাধীনতার জন্য একটি জাতির আবেগ যখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে, তখন সব মারণাস্ত্রের ব্যবহারই তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। বাঙালির দুর্দমনীয় আবেগের কাছে সেদিন তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানিদের সব মারণাস্ত্র, ভেস্তে গিয়েছিল নিক্সন-কিসিঞ্জারদের সব গোপন কূটচাল। বাঙালির একাত্তরের আবেগের সঙ্গে সেদিন সংহতি জ্ঞাপন করেছিলেন দেশ-বিদেশের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ বিশ্বের সংবেদনশীল, মানবতাবাদী, অগ্রসর চিন্তার বিপুল অংশের মানুষ। সেসব মানুষের সমর্থন উত্তাল তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়েছিল জনতার মিছিলে। লাখো জনতার মিছিলের অভিঘাত থেকে একের পর এক সৃষ্টি হচ্ছিল গান-কবিতা, শিল্প আরও কত কী! একাত্তরে বিশ্বজুড়ে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, চিন্তক, ভাবুকেরা মূলত প্রতিরোধের আগুনে জ্বলে ওঠা বাংলাদেশের বন্দনায় মুখর ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আমেরিকার ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।

দেখা যায়, পশ্চিমা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও পশ্চিমা নবজাগ্রত তরুণ সমাজ ছিল মুক্তিকামী জনতার পক্ষে। তাই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ভিন্নমাত্রিক ব্যঞ্জনা লাভ করেছিল বিশ্বজনের কাছে। হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল সমর্থনের ডালা নিয়ে। বিশ্বের মানববাদী কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ভেতর বিপুল পরিমাণ মানবিকতা, ন্যায্যতার উপাদান দেখেছিলেন বলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সবার, বিশ্বজনের।

২.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশে-প্রবাসে অবস্থান করে কতজন কত বিচিত্রভাবেই না ভূমিকা পালন করেছেন, যার বিবরণ দেওয়ার জন্য একটি পুরো বই লিখে ফেলা যায়। মুক্তিযুদ্ধটা সূচনা থেকেই গণযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। যে কারণে দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন গড়ে উঠতে থাকে। সব শ্রেণির মানুষ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, কূটনীতিক, শিক্ষক-ছাত্র, শ্রমিক-কৃষক, সাংবাদিক সবাই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধ চলেছে নগরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, কূটনৈতিক ফ্রন্টে। মুক্তিযুদ্ধ চলেছে কালিতে-কলমে, বর্ণে-বর্ণনায়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, খেলার মাঠে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, কলকাতার কফি হাউসে।

বাঙালি কূটনীতিকেরা একটি কূটনৈতিক ফ্রন্ট খুলেছিলেন। নিউইয়র্কেও একটি কূটনৈতিক ফ্রন্ট কাজ করেছে। তখনকার কনস্যুলেট জেনারেলের ভাইস কনসাল বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ২৬ এপ্রিল পদত্যাগ করেন। ওয়াশিংটনের পাকিস্তান এম্বাসিতে ইকোনমিক কাউন্সিলর সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পদত্যাগ করেন ৩০ জুন। এনায়েত করিম এবং এস এ এম এস কিবরিয়া পদত্যাগ করলেন ৪ আগস্ট। পরে আরও অনেক কর্মকর্তা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি সরকারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কূটনৈতিক ফ্রন্টে যোগ দেন। একাত্তরে আমাদের দেশপ্রেমী রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিবিদদের দুনিয়াকাঁপানো সাহসী ভূমিকা স্বাধীনতাযুদ্ধের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করেছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি নানাভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে জাতি। রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, ঢাকা
ফাইল ছবি: জাহিদুল করিম

৩.
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রশাসন পরিচালনা এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনেও এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা পালন করেন অসামান্য ভূমিকা, যা আমাদের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের অত্যুজ্জ্বল অংশ। গত শতকের ষাটের দশকে মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, আখলাকুর রহমানের মতো রাষ্ট্রচিন্তক, অর্থনীতিবিদেরা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলনে নানাভাবে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তাই বাঙালি বুদ্ধিজীবীবিরোধী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে, বিজয়ের প্রাক্কালেও দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বাংলাপিডিয়ায় স্বাধীনতাযুদ্ধে ১ হাজার ১১১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর হিসাব রয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক-প্রকৌশলী। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, রশীদুল হাসান, হবিবুর রহমান, গিয়াসউদ্দিন আহমদের মতো প্রাতঃস্মরণীয় শিক্ষক, ফজলে রাব্বির মতো খ্যাতিমান চিকিৎসক, শহীদুল্লা কায়সারের মতো বিপ্লবী সাংবাদিক, জহির রায়হানের মতো নন্দিত চলচ্চিত্রকারের নাম উল্লেখযোগ্য।

গোবিন্দচন্দ্র দেব ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই দার্শনিক, সত্য-সুন্দর মানবতার উপাসক। মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রদর্শনে নিমগ্ন আপাদমস্তক শিক্ষক। শহীদুল্লা কায়সার সাংবাদিক ছিলেন বটে; তবে তাঁর জীবনচেতনার মর্মমূলটি ছিল সামগ্রিকভাবে রাজনীতি দ্বারা পরিব্যাপ্ত। এই রাজনীতির মূলকথা ছিল ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের মুক্তিসাধন। মুনীর চৌধুরী আমাদের নাট্যসাহিত্যে কেবল আধুনিকতার প্রবর্তন করেননি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বনিয়াদ সুদৃঢ় করতেও তাঁর শিল্পমণ্ডিত নাটক কাজ করেছে অসাধারণভাবে। শহীদ আনোয়ার পাশার সাহিত্যকর্মের মধ্যে বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার পথরেখাটি খুঁজে পাওয়া যায় সুস্পষ্টভাবে। স্টপ জেনোসাইড-এর নির্মাতা জহির রায়হানও ৩০ লাখ শহীদের মিছিলে হারিয়ে গেছেন। একাত্তরের পুরো ৯ মাস বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চলেছে। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীরা বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, অনেককে জীবন দিতে হয়েছে।

৪.
কবি, শিল্পী, লেখক, ভাবুক, ইতিহাসবিদ—সৃষ্টিশীল মানুষমাত্রই সত্য-সুন্দরের উপাসক; মানবধর্মের সাধক। সমাজ, রাষ্ট্র, জীবন ও পরিপার্শ্বকে সুন্দর-আনন্দময় করে তুলতে, মানুষের ভেতরের স্বপ্নগুলো জাগিয়ে রাখতে, বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরা কাব্যরচনা করেন, ছবি আঁকেন, গান বাঁধেন। নিজের ভেতরের সত্তার অদম্য টানেই সব ধরনের বীভৎসতা, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, প্রতিবাদ করেন। শান্তির সময়, সুখের সময় হয়তো শিল্পী-সাহিত্যিকেরা সবকিছু উপেক্ষা করে নির্লিপ্ত থাকেন। কিন্তু যখন অশান্তির লেলিহান আগুন চারদিকে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তখন তাঁরা এগিয়ে আসেন সত্য-সুন্দরের পক্ষে, ন্যায়-মানবিকতার পক্ষে। ফরাসি দার্শনিক অঁদ্রে মালরো স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে আসতে চেয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর অধীনে একটি ট্যাংক ইউনিট পরিচালনার ব্যাপারে ছিলেন অটল। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা গেরিলা পদ্ধতিতে লড়াই চালিয়ে যাও। প্রথাগত যুদ্ধে তোমরা একটা পেশাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে টিকবে না।’ মালরোর বক্তৃতা, বিবৃতি, দার্শনিক ভাবনা আমাদের মুক্তিকামী সংগ্রামী জনগণকে নবপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত করেছিল।

বাঙালির মুক্তির জন্য মালরো যে দায়িত্ব পালন করেন বা করতে চেয়েছিলেন, তা ছিল একজন সত্যিকারের সৃষ্টিশীল মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবীর কাজ। আদর্শপ্রাণ মানুষ হিসেবে আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও একাত্তরে সীমাহীন দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যে দেশের জন্য যা করেছেন, তা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মালরোর মতো তাঁরাও গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুভয়হীন একটি জাতির আত্মাকে কখনো পদদলিত করা যায় না। স্বৈরাচার যত নির্মম হোক না কেন, তার বেদিমূলে কোনো অকুতোভয় জাতি মাথা নত করে না। বিশ্বমানবতা ও মানবমুক্তির দিশারি হিসেবে আমাদের সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ক্রান্তিকালে রাজনীতিকদের সঙ্গে মিলেমিশে অভিন্ন শত্রুর মোকাবিলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঘরে ফেরা বুদ্ধিজীবীরা শরণার্থী পুনর্বাসন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে যুক্ত হন। গত শতকের আশির দশকের শেষ প্রান্তে স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে কবি, শিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কয়েক লাখ জনতার উপস্থিতিতে গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে যে গণ-আদালত বসে, তার আয়োজকেরা সবাই ছিলেন বুদ্ধিজীবী।

সম্প্রতি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাজের সম্পর্ক ক্রমশ বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠছে। অনেকেই একমত হবেন যে তাঁদের অনেকেই আর তেমন সৃষ্টিশীল নয় বরং অন্ধ নিষ্ফলা, গোঁড়া। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখন পার্টিতন্ত্রের পেটের ভেতর ঢুকে গেছেন। পার্টি কিংবা ক্ষমতার পেটের ভেতর পরজীবী হয়ে বসবাসরত সুশীল বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ আরামে খুদকুঁড়া খেয়ে মোটাতাজা হচ্ছেন। কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করছে না। ভুলে গেলে চলবে না, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধিবৃত্তিক চৈতন্যে দায় অনুভব করে কখনো দার্শনিক হয়ে; কখনো পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। অনেকে মনে করেন, গত শতকের নব্বই দশকের পর থেকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা ক্রমেই মেরুদণ্ডহীন, বাকসর্বস্ব হয়ে উঠেছে। তাঁরা অনেকেই রাজনৈতিক দল ও শক্তিমানদের স্তুতি ও উপাসনায় এমনভাবে মগ্ন যে তাঁদের গ্রাম্য রাজনৈতিক কর্মী ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। অথচ বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষলগ্নে এদের ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আহমদ শরীফের মতো ভাবুক; গোবিন্দচন্দ্র দেবের মতো দার্শনিক; সিকানদার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুরের মতো দ্রষ্টা কবি, মুনীর চৌধুরীর মতো নাট্যকার, জহির রায়হানের মতো চলচ্চিত্রকার; শহীদুল্লা কায়সার, আনোয়ার পাশার মতো লেখক, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, খান সারওয়ার মুর্শিদ, এ আর মল্লিক, আনিসুজ্জামান, কবির চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো শিক্ষাবিদ, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, স্বদেশ বসুর মতো অর্থনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধের পরও তাঁরা সক্রিয় থেকেছেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। ক্ষমতা, বিত্তবৈভব কোনো কিছুই তাঁদের সত্যধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

প্রাবন্ধিক ও গবেষক এবং সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ