ডিসেম্বরের মঞ্চ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
ওপর তলায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নখে হোঁচট খেয়ে উহ বলে ওঠে নূর। চারপাশে ধোঁয়ার মতো ঝাপসা হতে থাকে, ডান হাতের রং বদলে সবুজ হয়ে যায়, বাঁ হাত পুরো লাল টকটকে! নূর কিছুই বুঝতে পারে না কী হচ্ছে!

হঠাৎ ধুম করে গ্রিন রুমের দরজা খুলে যায়।
সাল ২০১৫, মাস ডিসেম্বর, তারিখ ১৮, সন্ধ্যা ৭টা, সেনাকুঞ্জ অডিটরিয়াম। চমকে গিয়ে নূর পেছনে তাকায়। কেউ নেই। দরজা লক করা হয়নি। চাপিয়ে রাখা হয়েছিল। দরজার কাছে এগিয়ে যায়। সাড়াশব্দ নেই কারও। একটু আগে যে তিনজন ক্যাডেট শহীদ মিনার সাজাবে বলে মঞ্চে মহড়া দিয়েছিল, তার মধ্যে নূরও একজন। মঞ্চে, অডিটরিয়াম রুমে কাউকে না দেখে গা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে! গ্রিন রুমের বাইরে অডিটরিয়ামের ওপর তিনতলার দিকে মৃদুজাতীয় সংগীতের শব্দ শুনে এগিয়ে যেতে থাকে। অনুমতি ছাড়া জনসাধারণের এই অঞ্চলে প্রবেশ নিষেধ।

একটু পরেই বিজয় দিবস প্যারেড শেষ করা সব বাংলাদেশি ক্যাডেট এবং শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভারত, ভুটান থেকে আগত ক্যাডেটদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নূরের দলীয় নাচ এবং শহীদ মিনার সাজার ক্যারেকটার আছে। ওপর তলায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নখে হোঁচট খেয়ে উহ বলে ওঠে নূর। চারপাশে ধোঁয়ার মতো ঝাপসা হতে থাকে, ডান হাতের রং বদলে সবুজ হয়ে যায়, বাঁ হাত পুরো লাল টকটকে! নূর কিছুই বুঝতে পারে না কী হচ্ছে! পেছন থেকে বেশ কিছু কণ্ঠ অগোছালো এলোমেলোভাবে বলতে থাকে…

’৭১-এ আমরাও ব্যথা পেয়েছিলাম। আমাদের ‘উহ’ শব্দ কেউ শুনতে পায়নি। আমাদের আহাজারি, আর্তনাদ, চিৎকার শোনেনি কেউ যেখানে, সেখানে ‘উহ’ শব্দ কী করে শুনবে? কত নির্মমভাবে হত্যা করেছিল আমাদের স্ত্রী-সন্তান, স্বপ্ন, নিরীহ গৃহপালিত কুকুর, গাছে থাকা পাখি, সবুজ পাতা, মা-মাটিকে। মুহূর্তের জন্য শহীদ মিনার সেজে জাতীয় সংগীত গেয়ে আমাদের সেই ত্যাগের প্রতিদান কী করে দিবি নূর? দেশপ্রেমিক হওয়া এত সহজ? মঞ্চে নির্ধারিত দিবসে, প্রকাশ্যে কিছু সময়ের জন্য দেশপ্রেমিক হওয়া আদৌ সম্ভব?

মঞ্চের চারপাশ থেকে কিছু শিকল এসে নূরের হাত-পা গলা পেঁচিয়ে ধরে। নূর কথা বলতে পারে না। শ্বাস বন্ধ হতে নেয়। দূর থেকে ডাক ভেসে আসে সহপাঠীদের, নূর.. নূর..!

মঞ্চে যখন সাদা কাপড় গায়ে নিয়ে নূর শহীদ মিনার সাজছিল, অডিটরিয়ামের ওপর তলার শেষ প্রান্তে অসংখ্য ছায়া দেখতে পেয়েছিল। শহীদ মিনার সাজার জন্য গায়ে প্যাঁচানো সাদা রঙের কাপড় থেকে ধুপ, কর্পুরের গন্ধ ছড়াচ্ছিল। কোনোমতে সহপাঠীদের সঙ্গে শহীদ মিনারের পার্টটুকু শেষ করে মঞ্চের যে স্থানে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে চিহ্ন খুঁজতে থাকে!

চোখ যায় উইংসের আড়ালে। যিনি প্রোগ্রাম ডিরেকশন দিচ্ছিলেন, তিনি সব সাদা কাপড়গুলো ফিরিয়ে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনা স্বাস্থ্যের অমসৃণ চেহারার একজন লোকের কাছে ফিরিয়ে দিতে দিতে পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দেয়। নূর অবাক হয়ে যায়, যে লোকটাকে কাপড় ফিরিয়ে নিতে দেখল, ওই লোকটাকে কাফনের কাপড় ঘরে, কাফনের কাপড় বিক্রি করতে দেখেছিল!

বন্ধু, সিরাজগঞ্জ বন্ধুসভা