নিজেকে নিয়ে পরিতৃপ্ত, যেন এই বিশাল পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ না থাকলেও তার এমন কিছু অসুবিধা হতো না। এই মানসিকতার লোক স্ক্রুজ হলো উপন্যাসের মূল চরিত্র। মার্লে তার ব্যবসায়ের অংশীদার ছিল। সাত বছর আগে যে গত হয়েছে। এই মার্লেই একসময় ভূত হয়ে স্ক্রুজের সামনে এসে জীবনের সবক শেখাবে।
ভূত হয়ে স্ক্রুজের সামনে কেন আসবে, সেটার কারণ স্ক্রুজ নিজেই। স্ক্রুজ যখন রাস্তায় বের হয়, তখন কুকুরগুলো তাদের মালিকের কাপড় টেনে ধরে। স্ক্রুজ চোখের আড়াল হলেই তারপর বের হবে।
এক দিন পরেই ক্রিসমাস। চারদিকে ‘ক্রিসমাস আনন্দময় হোক’ বার্তা যখন সবার মুখে মুখে, তখন একঘেয়েমি, নিরানন্দ, গম্ভীর স্ক্রুজ মুখ গুঁজে কাজ করে চলে। আপন ভাগনে তাকে ক্রিসমাসের দাওয়াত দিতে এলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বের করে দেয়। যে ছেলেটা ক্রিসমাসের সংগীত গেয়ে চলছিল, সে–ও বাদ যায়নি তার রোষানল থেকে। অসহায়ের জন্য চাঁদা তোলা ব্যক্তিকে বিমুখ করা তার বিবেকের কাছে কোনো বাধাই না। চাঁদা না পেলে ওরা যে মরে যাবে, সমাজকর্মীর এমন কথার বিপরীতে স্ক্রুজ বলে, ‘তাহলে তাদের মারা যাওয়া উচিত। মরে অধিক জনসংখ্যা রোধে ভূমিকা রাখা উচিত।’
নিজে খাব, নিজে পরব, নিজে ভালো থাকা এই মানুষটির কাছে যখন তার কেরানি ক্রিসমাসের ছুটি চাইতে আসে, তখন বিশেষ শর্তের বিনিময়ে এক দিনের ছুটি দেওয়া হয়।
যাহোক, একদিন রাতে ভয়হীন স্ক্রুজের ঘরে দেখা দেয় সাত বছর আগেকার মৃত মার্লে। যার গায়ে আবদ্ধতার শিকল প্যাঁচানো। যারা পৃথিবীতে কাজ ও একঘেয়েমির ভারে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের থেকে নিজেকে দূরে রাখে, তাদের জন্য মৃত্যুর পর পরানো হয় এই শিকল। মার্লে ভূত, স্ক্রুজকে নিয়ে যায় ভূতের শহরে। সেখানে সবার গায়ে আবদ্ধতার শিকল। এরা সবাই জীবিত থাকাকালে নিজের কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। এখন জীবিতদের সাহায্য করতে চাইছে, কিন্তু কোনোভাবেই পারছে না। বেঁচে থাকতে যে কাজটা অনায়াসে করতে পারত। মার্লে ভূত চলে যাওয়ার সময় আরও তিনটি ভূতের আগমনের কথা বলে যায়।
প্রথম ভূত এসে স্ক্রুজকে নিয়ে যায় তার শৈশবের কাছে। শৈশবের কাছে ফিরে গেলে আপনি যেমন আনন্দ পেতেন, স্ক্রুজ তেমন আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে। একের পর এক প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হয়। যাদের মধ্যে কেউ গত হয়েছেন, আবার কেউ কেউ জীবিত। সেই সময়ের দুরন্ত, পরোপকারী, প্রেমিক স্ক্রুজ নিজেকে আবিষ্কার করে ভিন্নভাবে। শৈশবের পরে মধ্যবয়সী স্ক্রুজের সামনে অর্থের হাতছানি। এর পরপরই পরিবর্তিত মনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রেমের বিসর্জিত রূপে দেখা যায় স্ক্রুজকে। এই স্ক্রুজের ভেতর সেই প্রেম নেই, আছে কেবল ধনী হওয়ার প্রবল বাসনা। দৃশ্যের পরিবর্তনের মাধ্যমে দেখানো হয় প্রেমিকার সংসার। স্ক্রুজ মনে মনে ভাবে, তারও হতে পারত এমন একটা সংসার।
মানুষের আচরণ তার ভবিষ্যৎ পরিণতি নির্দেশ করে। মানুষ যদি তার স্বভাব বদলে নেয়, তবে পরিণতিও বদলে যায়।
দ্বিতীয় ভূত এসে স্ক্রুজকে নিয়ে যায় ক্রিসমাসের সকালে। ভূত দেখে এখন সে আর ভয় পায় না। ভূতের কাছে সে শিখতে চায়। এই ভূতটা তাকে প্রথম নিয়ে গেল কেরানি ও ভাগনের বাড়িতে, যেখানে ক্রিসমাসের আনন্দের ছোঁয়া। ক্রিসমাসের দিনটিতে স্ক্রুজকে না পেয়ে ভাগনের কাতরতা ও ভাগনে বউয়ের শ্লেষ স্বচোখে দেখল স্ক্রুজ। এরপর তারা গেল শহরের অলিতে-গলিতে, জেলখানায়, হাসপাতালে, গরিব মানুষের বাড়ি—শত দুঃখ–কষ্টের মধ্যেও সর্বত্র ছড়িয়ে আছে খুশির আমেজ।
দ্বিতীয় ভূত চলে যাওয়ার সময় তার সামনে প্রতীকী হিসেবে দুটি শিশুকে দেখানো হয়। যার একটি হলো অজ্ঞতা, অন্যটি অভাব। অজ্ঞতার কপালে লেখা থাকে মানবজাতির ধ্বংসের ইতিহাস।
পৃথিবীতে যে জিনিস যত অজানা, সেটাই তত বেশি ভয়ংকর। তৃতীয় ভূতটা যে দৃশ্যের অবতারণা করল, সেটা আসলেই ভয়ংকর ছিল স্ক্রুজের জন্য। মৃতের খাটলায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অপেক্ষায় পড়ে আছে মৃত শরীর। যে শরীরটার জন্য কোনো মায়া নেই, হতাশা নেই, কান্না নেই। এমনকি মৃতের শরীর থেকে পোশাক খুলে বিক্রির জন্য নিয়ে গেছে একজন ঝি। শহরজুড়ে এই মৃতের জন্য কোনো আফসোস নেই, আছে কেবল বিতৃষ্ণা। পৃথিবীতে যারা শ্রদ্ধাভাজন, তাদের একটা চুল নাড়ানোর ক্ষমতাও কারও থাকে না। কিন্তু আমরা শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠার কোনো চেষ্টাই করি না।
সব পরিচিতদের ভিড়ে স্ক্রুজ তার নিজের মুখটা কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। মনে ভয় আসে, মৃত ব্যক্তিটি সে নয়তো! ভূতের কাছে তার প্রশ্ন, এই শহরে এমন কি কেউ নেই, যে এই মৃতের জন্য একটু সমবেদনা রেখেছে? নেই, একজনও নেই সেই শহরে সমবেদনা জানানোর। মানুষের আচরণ তার ভবিষ্যৎ পরিণতি নির্দেশ করে। মানুষ যদি তার স্বভাব বদলে নেয়, তবে পরিণতিও বদলে যায়।
পরিশেষে ভূত স্ক্রুজকে নিয়ে যায় একটা কবরের কাছে। কাঁপতে কাঁপতে এগোয় সে। অবহেলিত কবরটার দিকে তাকাতেই শিউরে ওঠে। পরিষ্কার হরফে লেখা আছে, ‘এবনেজার স্ক্রুজ।’
ভূতের হাত চেপে ধরে স্ক্রুজ বলে, ‘এখন থেকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ক্রিসমাস পালন করব। অতীতের কথা মনে রাখব, বর্তমানের সঙ্গে মানিয়ে চলব, আর প্রস্তুত হব ভবিষ্যতের জন্য।’
ভূতটা চলে গেলে স্ক্রুজ নিজেকে আবিষ্কার করে নিজের ঘরে। কেঁদে ফেলে স্ক্রুজ। এখন সে পরিবর্তিত মানুষ। সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকে মুখে। ক্রিসমাস উপলক্ষে সবচেয়ে বড় টার্কি মুরগি কিনে গরিবদের মধ্যে বিলায়। এখন তার কথায় মাধুর্যতা। আত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক। চলনে-বলনে–ব্যবহারে স্ক্রুজ এখন ভালো মানুষ।
যাঁরা কেবল করপোরেট ভাবনায় ডুবে থাকেন, তাঁদের জন্য বইটি। উপন্যাসটি পড়ে নিজেকে উন্নত করুন খাঁটি একজন মানুষে।
সারসংক্ষেপ
বই: আ ক্রিসমাস ক্যারল
লেখক: চার্লস ডিকেন্স
রূপান্তর: খসরু চৌধুরী
প্রকাশক: ঐতিহ্য
মূল্য: ১৩০
লাইব্রেরি কর্মকর্তা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, পিরোজপুর