সম্পর্কের ভাঙা-গড়ার নিপুণ মনস্তাত্ত্বিক বুননের ধীরগতির এই চলচ্চিত্র মুগ্ধ করেছে। পরিচালক রবিউল আলম রবি। চলচ্চিত্রটির সঙ্গে যুক্ত আছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মতো প্রখ্যাত পরিচালক। আগাগোড়া একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে কাহিনির বাঁকের পর বাঁক প্রায় একাই সামলে নিয়ে গেছেন মেহজাবীন চৌধুরী। ক্যামেরার ভাষা কিছু কিছু দৃশ্যে নীরব কবিতার জন্ম দিয়ে গেছে। গভীর ভালোবাসা আর চরম মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের চলচ্চিত্র ‘ফরগেট মি নট’।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইংরেজি নাম নিয়ে এখন আর আমাদের কারও কিছু বলার থাকে না। বহুদিন ধরেই তা হয়ে আসছে। বাঙালির চিরাচরিত রাবীন্দ্রিক মনোভাব থেকে হয়তো এই ছবির নাম দেওয়া যেতে পারত ‘তবু মনে রেখো’। নতুন প্রজন্মের শহুরে সুশিক্ষিত কিছু বাঙালির মুখের ভাষা এখন বাংলা আর ইংরেজিতে মিশ্রিত। হৃদয়ের গহিন অনুভব সেই মুখের ভাষায় উঠে আসবে, প্রকাশিত হবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। পরিচালকের কাজ সমাজের চিত্র তুলে ধরা। সম্পর্কের ভাঙা-গড়ার জটিল দ্বন্দ্ব এই প্রজন্মের প্রেম-প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের প্রেমের ভাষা এবং প্রেমকেন্দ্রিক জটিলতা, এখনকার প্রেমের ভাষা এবং প্রেমকেন্দ্রিক জটিলতা এক নয়। আর সৃজনশীল একজন পরিচালক সময় এবং সমাজের তাপে যেভাবে উত্তপ্ত হন, চোখের সামনে যা দেখেন, মনে মনে যেখানে দৃশ্য ভাবেন, নীরবে কাটাকুটি করেন, চোখের সামনে ভাসতে থাকা টুকরা টুকরা সেসব অনুভবের ছবি সেভাবেই চিত্রায়িত করে চলার চেষ্টা করে যান। গোটা একটা চলচ্চিত্র দেখে আমরা মুগ্ধ হই।
যে দৃশ্যগুলোতে ইয়াশ রোহান এসেছেন, চমৎকার অভিনয়ে গোটা ছবির চাবিকাঠি হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে তাঁর ঘটনাকে ঘিরে আবর্তিত সম্পূর্ণ ছবিতে মূল ভরকেন্দ্রে ঘুরে বেরিয়েছেন মেহজাবীন।
আবার একালের প্রেম, এই প্রজন্মের জীবনযাপন এবং পরিচালকের বুনন—সবই যে একেবারে পুরোনোকে অস্বীকার করে, তা কিন্তু নয়। পুরোনো চিরাচরিত সংস্কৃতিকে তারাও মনেপ্রাণে ভালোবাসে। নতুন সময়ের সৃষ্টিতে সেই পুরোনো ধারাও এসে মিশে যায়। এই চলচ্চিত্রে আবদুল মজিদ আরাকানীর কণ্ঠে সুন্দর একটি গ্রামীণ বাউলধারার প্রেমের গান আছে, ‘ফাহিম ভাইয়া অর্থী আপুকে ভালোবাসে/দূরে দূরে থাকতে দেয় না রাখে পাশে...’। ফাহিম চরিত্রে অভিনেতা ইয়াশ রোহান আর অর্থী চরিত্রে মেহজাবীনের অভিনয়ে আধুনিক ধারায় সুন্দর চিত্রায়িত হয়েছে এই গান। আসলে আধুনিক শব্দটাও চিরকালই আধুনিক। চল্লিশ বছর আগে যে পরিচালক প্রেমের ছবি নির্মাণ করতেন, তিনিও ছিলেন তাঁর মতো করে আধুনিক। এখন যিনি নির্মাণ করছেন, সময়ের কাছে তিনিও আধুনিক।
প্রেম শুধু দুজনের কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকার মধ্যে বহমান থাকে না। দূরত্ব, মাঝেমধ্যে তীব্র বিরহের মধ্যেও প্রেমের ঘনত্ব বেড়ে যায়। কেউ নিভৃতবাসে থেকেও মনমানুষের পাশে থাকে। আবার কেউ মনমানুষের অসহনীয় দূরত্ব মেনে নিতে না পেরে নতুন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এখান থেকে শুরু হয় প্রেমের জটিলতা আর দ্বন্দ্ব। পাঁচ মাস বান্দরবানে প্রকৃতির নির্জন ছায়ায় ধ্যানমগ্ন থেকে, নিভৃতে কাটিয়ে এসে ফাহিম জানতে পারে তার প্রিয়তমা অর্থীর নতুন সম্পর্কের আংটিবদল হয়ে গেছে। প্রেমিকার হাতে জন্মদিনের ফুলের তোড়া তবু তুলে দিতে হয়। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। দুই বছর হৃদয় বদল করে গভীর প্রেমের পর একজন যদি তৃতীয় অন্যজনের সঙ্গে আংটি বদল করে, তা মেনে নেওয়াও নবীন কোমল প্রাণের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
ফাহিম পারিবারিক জীবনেও নিঃসঙ্গ। বাবা দূরে চলে গেছে। মিডিয়া জগতের ব্যক্তিত্ব ব্যস্ত মা সন্তানকে একক মাতৃত্বের লড়াইয়ে বড় করে তুলেছে ঠিকই; ছেলের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, মনের ক্ষত দূর করতে পারেনি। আজ ছেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর মা এবং প্রেমিকা দুজনই নিজেদের দায়ী ভাবতে শুরু করেছে। ভালোবাসার মানুষকে ঘিরে এই অপরাধবোধ, এই জটিল মনের দ্বন্দ্ব সম্পর্কের শূন্যতাকে বিস্তৃত করে তুলেছে। খুব কম দৃশ্যে ফাহিম এখানে ছিল।
যে দৃশ্যগুলোতে ইয়াশ রোহান এসেছেন, চমৎকার অভিনয়ে গোটা ছবির চাবিকাঠি হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে তাঁর ঘটনাকে ঘিরে আবর্তিত সম্পূর্ণ ছবিতে মূল ভরকেন্দ্রে ঘুরে বেরিয়েছেন মেহজাবীন। তাঁর প্রতিটি মুহূর্তের অভিব্যক্তি, অভিনয় যাবতীয় শূন্যতাকে ভেদ করে মূল চলচ্চিত্রকে পূর্ণতা দিয়েছে। রেদওয়ান রনি নিজেও বড় মাপের পরিচালক হওয়ায় ছবির প্রযোজনা করতে এসে এখন খুঁটিনাটি অসম্পূর্ণ কিছু রাখছেন না। ছবির কারিগরি প্রতিটি দিক তাই শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।
অর্থী যখন খুঁজতে খুঁজতে বান্দরবানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ফাহিমের পাঁচ মাসের নিভৃতে থাকার সেই ধ্যানঘর আবিষ্কার করে, এবং একসময় সেই স্মৃতির ঘর পুড়িয়ে ফেলে—এই দৃশ্য একটা অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আবার স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে মনের নিভৃততম চরম দুঃখকাতর মুহূর্তে যখন নির্জন ঘরে ফাহিমের বিড়াল ডেকে ওঠে, আমাদের বুকের ভেতরেও মোচড় দিয়ে যায়।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।