মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে ডাক্তার শশীবাবু বা ছোটবাবু প্রধান চরিত্র হলেও গল্পের প্রয়োজনে অনেক চরিত্র এসেছে, আবার হারিয়েও গেছে। শশীর বন্ধু পরাণের বৌ কুসুমের সঙ্গে শশীর প্রেমের বন্ধন এখানে মুখ্য ঘটনা হলেও, এর মধ্য দিয়ে আশপাশে অনেকগুলো ঘটনা ওঠে এসেছে। কুসুম চরিত্রে বেশি মুগ্ধ হয়েছি। গ্রাম্য মূর্খ মেয়ে কুসুমের ব্যবহারে নাটকীয় নানা দিক গল্পে ভিন্নতা তৈরি করেছে। সরলা এই গ্রামের বধূ কত কিছুই যে করতে জানে। পরিস্থিতি, প্রয়োজন বুঝে নিজেকে নানা উপায়ে সবার সামনে উপস্থাপন করতেও যেন পিছপা হয়নি কুসুম।
শশী বাবু দীর্ঘদিন ধরে চেয়েছে বাজিতপুরের এই গাওদিয়া গ্রাম ছেড়ে অদূরে চলে যাবে। আর কখনো ফিরবে কি না, তা পরে ভেবে দেখবে। কিন্তু শশী যতই গ্রাম ছাড়ার প্রস্তুতি নেয়, ততই যেন গ্রামের মায়া, গ্রামের মানুষ, গ্রামের নানা দায়িত্ব তাকে ঘিরে ধরে। গ্রামের এই মায়া, পারিবারিক বন্ধন, দায়িত্ব থেকে সে কোনোভাবেই বের হতে পারে না। এই কাজ, সেই কাজ শেষে শশী প্রস্তত করে নিজেকে গ্রাম ত্যাগ করার, পরিকল্পনা মাফিক কাজও করে সে। তবু শেষপর্যন্ত সে পারে না গ্রাম ছাড়তে। হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে গোছানো হলে এবং কুসুম একেবারে গ্রাম থেকে চলে গেলে, শশী ভাবে তার পক্ষে আর গ্রামে থাকা সম্ভব নয়। ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয় গ্রাম ছাড়ার। সবার সঙ্গে কথা বলে, হাসপাতালে নতুন ডাক্তার যুক্ত করেও ফেলে শশী। কিন্তু শেষ সময়ে তার বাবা গোপাল কৌশলে বাড়ি ছেড়ে শশীকে সব দায়িত্ব দিয়ে গ্রাম ছেড়ে একেবারে চলে যায়। শশীর আর গ্রাম ছাড়া হয় না।
শশী আর কুসুমের তাল বনের মাটির টিলার ওপর বসে আলাপচারিতা গল্পের সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে কয়েকটা। কুসুমের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর বিচার বিশ্লেষণের কাছে শশী ডাক্তার পর্যন্ত কাবু হয়ে যায়। লোকসমাজ আর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ শশী আর কুসুমকে পায় না। কুসুমও তীব্র কষ্ট নিয়ে গ্রাম ছাড়ে।
মতি আর কুমুদের গল্পটা এখানে আলাদা মাত্রা যুক্ত করে। মনে হয় একটি গল্পের মধ্যে আরেকটি মৌলিক গল্প লেখক উপস্থাপন করেছে। মতি আর কুমুদের গল্প দিয়ে মনে হয় আরেকটা উপন্যাস হয়ে যেতে পারত। শশী আর কুসুম প্রধান চরিত্র হলেও মতি আর কুমুদের ভালোবাসার সংসার গল্পের পরতে পরতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। অসমাপ্ত নানা গল্পেও এই গল্প পূর্ণতার স্বাদ এনে দেয় পাঠককে। পাঠক হিসেবে এই তৃপ্তি আমিও পেয়েছি।
শশী কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করছে। ফিস নেওয়ার চেয়ে বরং মানবসেবাকে সে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবু যেটুকু না করলে না হয়, সেটুকু সে হিসাব রাখে। শশীর বাবা গোপালের অর্থসম্পত্তির অভাব ছিল না। ৪ সন্তানের মধ্যে শশীই একমাত্র ছেলে গোপালের। তবু ছেলের সঙ্গে গোপালের সম্পর্ক সমন্বয় হতো কম। শশী তার বাবার সমালোচনা করত না, সম্মান করত; কিন্তু সব সিদ্ধান্তে একমত হতে পারত না।
হারু ঘোষ তার মেয়ে মতির সম্বন্ধ দেখতে গিয়ে অপঘাতে মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনা দিয়েই গল্প শুরু। হারু ঘোষের পরিবারের সঙ্গে শশীর সম্পর্ক ভালো। হারু ঘোষের ছেলে পরাণ শশীর বন্ধু। তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া হয় ভালো।
গ্রামের সম্মানিত পন্ডিত মশাই যাদব শশীকে স্নেহ করেন, স্ত্রী পাগলাদিদিও। তাকে শিষ্য করতে চাইলেও সে রাজি হয় না। সূর্য মন্ত্রের উপকারিতা শোনালেও শশী তাতে বিশ্বাসযোগ্য উপাধি পায় না। কিন্তু শশীকে যাদব পন্ডিত বিশ্বাস করে। সে প্রমাণ তিনি দিয়েছেন মৃত্যুর পর। নিজ ঘোষিত স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করার আগে যাদব পণ্ডিত নগদ অর্থ ও সব সম্পত্তি দিয়ে গ্রামে হাসপাতাল করার দায়িত্ব শশীর নামে দিয়ে উইল করে যান। শশী সে দায়িত্ব পালন করে। যাদব মেমোরিয়াল হাসপাতাল তৈরি করে গ্রামের সবার সহযোগিতায়।
যামিনী কবিরাজের বৌ সেন দিদি শশীকে নিজের সন্তান সমতুল্য দেখেন। যদিও যামিনী কবিরাজের সঙ্গে শশীর বাবা গোপালের বিরোধ আছে। গ্রামের সবাই জানে যে অর্থের লোভে সেন দিদির মতো এমন সুন্দরী অল্প বয়সী মেয়েকে যামিনীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল গোপাল। বয়স্ক যামিনীও সে নিয়ে বিরক্ত।
গ্রামে যাত্রাপালা হয় দূর্গাপূজা উপলক্ষে। শশীর কলকাতায় পড়ার সময়কার বন্ধু কুমুদ আসে গ্রামে যাত্রাদলের সদস্য হয়ে। তালপুকুরে কুমুদের সঙ্গে পরিচয় হয় মতির, সে পরিচয় প্রেম সম্পর্ক ছাড়িয়ে যায়। মতি কুমুদের সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে কলকাতা যায়, কিন্তু কুমুদের দেখা পায় না। কুমুদও প্রেমের আবেশে আবার গ্রামে আসে, মতির সঙ্গে বিয়ে হয়, তারা কলকাতা যায়, হোটেলে থাকে, বাসা ভাড়া করে সংসার পাতে। প্রথমে জয়া ও বনবিহারীর সঙ্গে মিলে বাসা নিয়ে, আবার নিজে আলাদা বাসা ভাড়া করে। ভবঘুরে যাযাবর থিয়েটার, যাত্রাপালা করা কুমুদ মতিকে তার মতো করে গড়ে তোলে। কুমুদের নতুন চাকরি হলে সে মতিকে গ্রামে রাখতে চায়। শশী ও পরাণ দীর্ঘদিন পর চিঠি পেয়ে কলকাতা আসে। মতির পরিবর্তন তাদের চোখে পড়ে, তারা অবাক হয়। গ্রামের সেই মতি স্বামী কুমুদকে ছেড়ে যেতে চায় না। তার সঙ্গে করে ট্রেনে উঠে অজানা ভবিষ্যতের দিকে চলে যায়।
শশীর আর গ্রাম ছাড়া হয় না। কুসুম একেবারে বাপের বাড়ি চলে গেলেও সে আর গ্রাম ছাড়িতে পারে না।
বন্ধু, নরসিংদী বন্ধুসভা