পয়লা বৈশাখ: কারও সুখের, কারও দুঃখের

প্রতীকীছবি: আব্দুল মোমিন

টিউশন ছেড়েছি বছর চারেক হয়ে গেল। কত ছোট ভাইবোনদের পড়ালাম! কেউ আজ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, ফার্মাসিস্ট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নামকরা বিভাগে পড়াশোনা করছে। মাঝেমধ্যে দু-একজনের সঙ্গে মুখবইয়ে বার্তালাপ হয়, তা–ও নেহাত সামান্য। এই ভাইবোনগুলোর জীবনের কত সহস্র গল্প হজম করে তাদের জীবনযুদ্ধের সারথি বানিয়েছি, সেটা একমাত্র তারাই জানে। হাজারো গল্প শোনা হতো, হাজারো চাপা কান্না বইয়ের ভাঁজে হারিয়ে যেত। নিজের মনকে শক্ত করে ওদের ধমক দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতাম। দিন শেষে জীবনের পরীক্ষায় তাদেরই উতরাতে হয়েছে, আমি পথপ্রদর্শক ছিলাম মাত্র।

এমনই এক ছোট বোন, এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে আমার কাছে পড়া শুরু করে। এই টিউশনটা শহরের এক প্রান্তে ছিল বিধায় শুরুতে ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু অভিভাবকের চাপে পড়ে আর আর্থিক টানাপোড়েনে ব্যস্ত নগরীর জ্যাম ঠেলে ওকে পড়াতে যেতাম। পড়ালেখায় সে ছিল মোটামুটি, আমাকে বলেছিল, ‘ভাইয়া পাস, করতে পারলেই হবে।’ ওর মা, আন্টিও বেশ আদর করতেন আমায়। তাঁদের বনেদি পরিবার, বাবার অর্থপ্রাচুর্যের অভাব নেই। আন্টি, ছোট বোনটি তাঁদের উত্থানের গল্প, এই শহরে বসবাস—এসবের গল্প বলত, আর আমি শুনতাম মন দিয়ে। অল্প কদিনে তাঁদের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। তারপরও সবকিছুরই শেষ আছে। নিয়মমাফিক পরীক্ষার পর এই টিউশনের ইতি টানি।

একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি ভোরসকালে। তখন সকাল সাড়ে ৮টা, গাড়িতে ছিলাম। দেখি ছোট বোনটা ফোন দিয়েছে। ফোন ধরতেই সে বলে উঠল, ‘ভাইয়া, আম্মা তো নাই।’
আমি বললাম, ‘কি!!! তুই মজা করছিস আমার সঙ্গে?’
সে কান্নার জন্য কোনো কথাই বলতে পারল না। এর কিছুদিন আগেও তার মা আমায় ফোন দিয়ে ওর ভর্তির ব্যাপারে পরামর্শ নিয়েছিলেন। আন্টির সে রকম কোনো অসুখও কখনো চোখে পড়েনি। এই খবরে হতবিহ্বল হয়ে শক্ত হয়ে গেলাম কিছুক্ষণ, কী শুনলাম এটা! সেই সময় ছোট বোনটি শক্ত হাতে মা-হীন ছোট ভাইদের সামলেছে। এরপর তার পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিয়েও হয়ে গেল। বিয়ের ছবি দেখে ভাবছিলাম, যাক এবার মেয়েটা একটু ভালোমতো বাঁচুক, হাসিখুশিতেই কাটুক বাকি পথ।

আজ বছর তিনেক পর কিছুদিন আগে সে আমায় মেসেঞ্জারে মেসেজ দিল। স্বাভাবিক একটু অবাকই হলাম, এত দিন পর খবর নিচ্ছে আমার! হালকা কুশলাদি জানার পর কথার ভাবাবেগে বুঝলাম সে ভালো নেই। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, ‘আমার কোলন ক্যানসার, ফোর্থ স্টেজে আছে।’ সেই আগের মতো আকাশ ভেঙে পড়ল। তাকে কী বলব, কী বলে সান্ত্বনা দেব; খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

এবার পয়লা বৈশাখে ভাবছিলাম বোনটার কথা। রঙিন বাহারি শাড়ি পরে তার পুরো শহর চষে বেড়ানোর কথা ছিল। স্বামী সন্তান নিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে ডিসি হিল কিংবা সিআরবিতে আইসক্রিম খাওয়ার কথা ছিল। হয়তো সন্তানকে বাঙালির পান্তা-ইলিশের কথা শোনানোর কথা ছিল। কিন্তু সে আজ ক্ষণ গুনছে প্রতিদিন বাঁচার আকুতি নিয়ে। প্রতিদিন চোখ খুললেই ওই সূর্যের দিকে তাকালেই তার মনে হয়, আজই পহেলা বৈশাখ! তার জন্য এখন প্রতিদিনই বিশেষ কিছু। নিয়তি কী নির্মম! এই পয়লা বৈশাখ কারও জন্য আনন্দের, আবার কারও জন্য শুধু বিমর্ষতা।

পিএইচডি গবেষক, চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া