অনিন্দিতা

অলংকরণ: তুলি

আমাদের শহরে নভেম্বর মাসে একটা বইমেলা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নান্দনিক আয়োজন থাকে, অনেক গুণীজন আসেন। সংগীত একাডেমির সদস্য হিসেবে আমিও গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পাই। শহরের প্রায় সব সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকেই শিল্পীরা আসেন। সেবার স্থানীয় কলেজ, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদেরই একজন অনিন্দিতা; বইমেলার অনুষ্ঠানেই পরিচয়। আমি প্রথম তাকে দেখি আবৃত্তির মঞ্চে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবৃত্তিশিল্পীরা সেবার স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন। আমার একটি কবিতাও আবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হয়। কবিতাটি আবৃত্তি করেন অনিন্দিতা। তখনই দুচোখ ভরে তাকে দেখি। নীল শাড়ি, কালো টিপ, লাবণ্যময় চেহারা।

আমার দাদু বলতেন, ‘জীবনে যখন ভালো কিছু হবে, দেখবি পরপর শুধু ভালো হতে থাকবে। আবার যখন খারাপ কিছু ঘটবে তখন খারাপ ঘটতে থাকবে। এ দুইয়ের জন্যই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’ কথাটা প্রথম উপলব্ধি করি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরদিন। টিউশনি শেষে ইজিবাইকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। কানে এল, কেউ নাম ধরে ডাকছে। নারীকণ্ঠ। পেছনে ঘুরে দাঁড়ালাম। সাদা সালোয়ার কামিজে অনিন্দিতা, রিকশায় বসে আছে। একটা মায়াবী ঘোরের মধ্যে পড়লাম। অনিন্দিতার কথায় স্বাভাবিক হলাম। তার কথামতো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই রিকশায় উঠে বসলাম। তরুণীর সঙ্গে প্রথম রিকশায় চড়া, লজ্জা ও সংকোচে নিশ্চুপ আমি। অনিন্দিতার কথায় আরও লজ্জা পেলাম, ‘আপনি কি সত্যিই বোকা, নাকি বোকার ভান ধরে থাকেন?’
কী বলা উচিত, ভাবতে ভাবতে বললাম, ‘জানি না।’

অনিন্দিতা হাসল। কারও হাসি যে এত সুন্দর হতে পারে, সেদিনই প্রথম অনুভব করি। তার কানের ওপরের চুলগুলো মুখের ওপর নুইয়ে পড়েছে। কী মনে হতেই চুলগুলো ওপরে তুলে দিলাম। ‘যা ভেবেছিলাম, আপনি কিন্তু মোটেই তেমন নন। আপনি হচ্ছেন পাতাড়ি মাছ টাইপ!’ মুখভর্তি হাসি ছড়িয়ে বলল অনিন্দিতা। এত কিছু থাকতে মাছের সঙ্গে তুলনা? কাজে সাফল্য থাক বা না থাক, মানুষ কথায় কথায় বাঘ–সিংহ উপমা ব্যবহার করে। আর সেখানে কিনা সামান্য মাছ! মনে মনে ভাবলেও বললাম না। কিছু দূর যেতেই রিকশা থামাতে বলল অনিন্দিতা। শহরের শেষ প্রান্তের বস্তি এলাকা, ছোট ছোট ঘর, কলেজের এক শিক্ষিকার সঙ্গে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করছে সে। শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এল। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি। সে শিশু ও মায়েদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে, শিশুদের বুকে টেনে নিচ্ছে।

হাসি বোধ হয় সংক্রামক, সবাই তার সঙ্গে হাসছে। নাকি মেয়েটা বশীকরণ জানে?  আমিও তো বশ হয়ে যাচ্ছি। নাকি তার হাসির ধ্বনিতে মোহিত হওয়ার জন্যই আমার পৃথিবীতে আসা? এসব ভাবছি, হঠাৎ একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের এক ভদ্রমহিলা গাড়ি থেকে নামলেন। আমাকে দেখেই নাম ধরে ডেকে বললেন, ‘কাল তোমার গান ভালো হয়েছে। কত গুণ তোমার, অনিন্দিতার মুখে শুনলাম। তুমি তো ভালো লেখোও, কাল তোমার কবিতাই তো পড়েছে অনিন্দিতা’। একরাশ হাসি ছড়িয়ে যথাসম্ভব বিনয় প্রদর্শন করলাম।

কাজ শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ভদ্রমহিলা গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা চটপটির দোকানের সামনে পৌঁছালাম। আসার পথে পরিবার সম্পর্কে নানা কথা জিজ্ঞেস করল অনিন্দিতা। আমার বাবা কী করেন, মায়ের হাতের রান্না কেমন, বোন কোন ক্লাসে পড়ে, পরিবারে কে কে আছে। নিজের সম্পর্কেও কিছু কথা বলল সে। রাস্তা পার হওয়ার সময় তার হাত ধরলাম আমি। সে মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘আমি রাস্তা পার হতে জানি। চলেন চটপটি খাব।’
শুকনা মুখে চটপটির প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছি। অনিন্দিতা হাসতে হাসতে বলল, ‘হাত ধরার সময় তো অনেক পাবেন। কিন্তু ধরে রাখতে পারবেন তো?’ কথাটা শুনে বুকের ভেতর তির বেঁধার মতো যন্ত্রণা অনুভব করলাম। কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই মনে যা এল, বললাম, ‘জীবনে তেমন কিছুই তো পাইনি। পেলে নিশ্চয়ই হারাতে চাইব না।’ উত্তর না দিয়ে অনিন্দিতা বলল, ‘আমাকে হোস্টেলে পৌঁছে দেন।’

অনিন্দিতাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফেরার পথে সেই শিক্ষিকার সঙ্গে আবার দেখা। কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘অনিন্দিতাকে সামলে রেখো। মেয়েটা বড় দুঃখী। মা–বাবা দুজনই অসুস্থ, তেমন আত্মীয়স্বজনও নেই।’ মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল আমার। ভদ্রমহিলাকে বললাম, ‘তবে যে অনিন্দিতা বলল..’ ‘আত্মবিশ্বাসী মেয়ে, কারও কাছে সহজে বলতে চায় না। মানুষ সহানুভূতি দেখাবে, এটা কি ভালো কথা?’ বললেন উনি। আমি তাঁকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরলাম। একটা ঘর, একা থাকি। বাড়িওয়ালা কাকিমা মায়ের বান্ধবী। আমার দেখভাল করেন তিনি। তাঁদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করি। কিন্তু খিদে না থাকায় আসার সময় কাকিমাকে বললাম, ‘রাতে খাব না, বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।’ অন্যদিনের মতো কাকিমা রাগ করলেন না। আমি ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে খাটের ওপর পিঠ এলিয়ে দিলাম। দুচোখে শত প্রশ্নের ভিড়, মনের ওপর চিন্তার পাহাড়। দুর্ভাবনা কাটাতে ল্যাপটপে মুভি দেখতে শুরু করলাম। রাত ১১টা বাজে, একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। আমি ‘হ্যালো’, ওপাশ থেকে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর একসঙ্গে ভেসে এল। রাতবিরাতে ছেলেরা মেয়েদের ফোন করে বিরক্ত করে শুনেছি, কিন্তু মেয়েরাও যে কাজটা শুরু করেছে, ভাবতেই হাসি পেল। কয়েক মুহূর্ত পর কণ্ঠস্বরগুলো সব থেমে গেল। একটি কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ ভেসে আসছে, ‘আমি অনিন্দিতা, পাগলিগুলো মজা নিচ্ছিল। চিনতে পেরেছেন তো?’ হতচকিত হলেও বুঝতে দিলাম না। এ যুগে কারও ফোন নম্বর জোগাড় করা কঠিন কাজ নয়। তাই ‘নম্বর কীভাবে পেলে?’ জিজ্ঞেস করলাম না। আনন্দিত স্বরে বললাম, ‘চিনব না কেন, চিনেছি।’ ‘ভালো হয়েছে,’ মশকরার স্বরে বলল অনিন্দিতা। উত্তরে কিছু না বলে চুপ করে আছি। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে তার। ছন্দময় শ্বাস-প্রশ্বাস, যেন প্রার্থনার সুর বয়ে যাচ্ছে, ‘একাডেমির ফাইলে দেখলাম, আপনার রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ। আগামীকাল রক্ত দিতে হবে, সকাল আটটায় ক্লিনিকে পৌঁছে যাবেন। ঠিকানা, রুম নম্বর লিখে পাঠাচ্ছি। রাখি, শুভরাত্রি।’ বলল অনিন্দিতা।

আমি আগে কোনো দিন রক্ত দিইনি। একধরনের ভীতি আছে। তারপরও অনিন্দিতাকে না করলাম না। মনের জোর নিয়েই সকালবেলা ক্লিনিকে গেলাম। অনিন্দিতার হোস্টেলের কাজের আন্টির মেয়ের অপারেশন, তার জন্যই রক্ত লাগবে। রক্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয় কাজ শুরু হলে, অনিন্দিতা মাথার কাছে এসে বসল। কিছু সময় পর ডাক্তার চলে গেলেন। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।’ ‘আবদার। মানুষকে বসতে দিলে শুতে চায়।’ কিছু না বলে আবারও হাসলাম। অনিন্দিতা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কত ভালো কাজ করছেন জানেন? আন্টি অনেক আশীর্বাদ করছেন।’

এভাবেই দিন অতিবাহিত হচ্ছিল। ভেবেছিলাম, অনিন্দিতার জন্মদিনে একটা আয়োজন করে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলব। কিন্তু করোনাভাইরাস সব ভেস্তে দিল। ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ায় দুজনই গন্তব্যে পাড়ি দিলাম। যোগাযোগ বলতে তখন শুধু মেসেঞ্জারের মেসেজ ও ভিডিওকল। ভাইরাসের শঙ্কায় আতঙ্কিত হলেও ডিজিটাল ডিভাইসের আশীর্বাদে ঘরবন্দী সময়টা ভালোই কাটছিল। কিন্তু নিয়তি; তার সঙ্গে কে পারে! একদিন বই পড়ার সময় খেয়াল করলাম, মাথার চুল উঠে যাচ্ছে। মাকে বললাম। বাড়ির সবাই আমার সঙ্গে মশকরা শুরু করল। মাথায় কম চুলের ছেলেদের মেয়েরা বিয়ে করতে চায় না। বিয়ে দিতে কষ্ট হবে, আরও কত কী!

অনিন্দিতাকে কথাটা জানাব ভেবেও সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু নিজের কাছে সৎ থাকার ভাবনা থেকেই কথায় কথায় অনিন্দিতাকে কথাটা বললাম। শুনতেই হেসে কুটিকুটি সে। আমি রেগে উঠলে হাসি থামিয়ে অনিন্দিতা বলল, ‘অহেতুক চিন্তা বাদ দিয়ে বই পড়ো। আর পারলে, আমার জন্য একটা গান লেখো। আবার যে কবে সব স্বাভাবিক হবে, আমরা একসঙ্গে ঝালমুড়ি খাব, রাস্তায় হাঁটব!’ উত্তরে কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলাম। গান লিখতে হবে, কিন্তু গান কীভাবে বাঁধতে হয় শিখিনি তখনো, জানি না। তারপরও ভাবতে ভাবতে মাথায় আসা লাইন দুটো লিখে সুর করে অনিন্দিতাকে শোনালাম।
‘আমার সুরের শব্দেরা পাচ্ছে না আর তোমার খেয়াল,
ক্রমশ তুমিই যেন বাড়িয়ে নিচ্ছ মনের দেয়াল!’

লাইন দুটো শুনতেই অনিন্দিতা বেজায় চটে গেল। তার রাগকে পাত্তা না দিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে বললাম, ‘কেন ভালোবাস? বলার মতো পরিচয়, সম্পদ কোনোটাই নেই। শরীরভর্তি অনিয়ন্ত্রিত মাংসের ভার, চুল পড়ে যাচ্ছে। একুশ বছর বয়সেই পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মনে হয়, বুড়িয়ে যাচ্ছি। অভাবের দিনে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। মিথ্যে অজুহাতেই তো কত নিবিড় সম্পর্ক ভেঙে ফেলে মানুষ। সেখানে তোমার হাতে কতগুলো কারণ, তবুও পড়ে আছ! আমি কিন্তু করুণা চাই না।’
‘জানো, অবান্তর কথা পছন্দ করি না। তারপরও বলে কী যে মজা পাও! বাদ দাও, কেন ভালোবাসি জানি না। তবে প্রায়ই যে বলো, কিছু নেই, কিছু নেই—এটা কিন্তু ঠিক না। তোমার মা–বাবা আছেন, বোন আছে, পরিবার আছে। দুই আঙুলের ভেতর কলম আছে, পড়ালেখা করছ, মস্তিষ্কের ক্ষমতা আছে। তারও অধিক আছে আত্মবিশ্বাস, যা অনেকের থাকে না। এত কিছু থাকার পরও তোমার আমি আছি। আর কী চাও?’
শেষের কথাটা হাসতে হাসতে বলল অনিন্দিতা। উত্তরে কিছু বললাম না, কল কেটে দিলাম। দুচোখ জলে ভরে উঠল।