রোজা ও পাতার গল্প
রোজা সাত বছরে পা দিয়েছে। এখনো ইস্কুলে যাওয়া হয়নি। হবেইবা কেমন করে। মুখে অ আ বুলি আওড়ানোর আগেই এক রাতে ওর মা জুলেখা বানু ওকে একা করে চিরতরে চলে গেছেন। দীর্ঘদিন অসুখে-অনাহারে ভুগে মারা গেছেন। কত স্বপ্ন ছিল তাঁর! অভাবের সংসারে খেয়ে না খেয়ে হলেও রোজাকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবেন। স্বামীর রোজগার কম বলে মানুষের ঘরে কাজ করে হলেও রোজার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হলো না, প্রকৃতির চিরন্তনী ডাকে তাঁকে সবকিছু রেখে চলে যেতে হলো।
মাকে হারানোর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি রোজা। কয়েক মাসের মধ্যে বাবা আরেকটা বিয়ে করেন, বাড়িতে নতুন মা আসেন। নতুন মা শুরুর দিকে রোজাকে খুব আদর করতেন। নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন। মাথার চুল আঁচড়ে দিতেন। ওর বাবার সামনে ওকে নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকতেন। রোজার মুখে হাসি দেখে তখন বাবার মনে খুশি। তিনি আনমনে ভাবতেন, মা মরা মেয়ে আবার মা পেয়েছে।
রোজার বাবা সোহেল মিয়া একজন দিনমজুর। সারা দিন বাইরে কাজ করে যখন ঘরে ফেরেন, তখন রোজার কষ্টের মুহূর্ত থাকে না। বাবার বিস্তৃত বুকে মাথা রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। বাবা নিজ হাতে মজা করে খাইয়ে দেন। দিনের ক্লান্তি শেষে সোহেল মিয়া মেঝের বালিশে মাথা রাখলে রোজা আস্তে করে বাবার বুকের ভেতর লুকিয়ে যায়। আর অমনি কি এক জাদুর পরশে রোজার চোখজুড়ে ঘুম নেমে আসে।
এক বছর শেষ হতে না হতেই নতুন মা আকলিমা বেগমের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। রোজাকে স্কুলে ভর্তি করানোর কথা বলতেই সোহেল মিয়ার মুখের ওপর তিনি বলে বসেন,
- মেয়েমানুষ! পড়াশোনা করিয়ে শুধু শুধু টাকা খরচ করার কী দরকার? একটু বড় হলে পরের ঘরে চলে যাবে। তার চেয়ে আমাদের ঘরে যদি কোনো ছেলেসন্তান আসে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
- তাই বলে রোজার পড়াশোনা হবে না!
- আরে, স্কুলে এত এত বেতন দিয়ে কী লাভ! তার চেয়ে তুমি বাসায় কিছু চক আর একটা বোর্ড নিয়ে এসো। আমি ওকে বর্ণমালা শিখিয়ে দেব। কোনোমতে নিজের নামটা লিখতে পারলেই হলো।
রোজার নতুন মায়ের কথায় সোহেল মিয়ার আর বুঝতে বাকি থাকে না, তাঁর মেয়ে ভালো নেই। কিন্তু ও তো কোনো দিনও নতুন মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি। আহা! বাবা হয়ে ওর মুখের ভাষা বুঝতে পারিনি। এসব ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন সোহেল মিয়া।
আকলিমা বেগম আবার বললেন,
- তুমি তো কিছুই বললে না। আমি কি ঠিক বলিনি?
- মা মরা মেয়ে আমার! ওর প্রতি কোনো দিন কঠোর হইয়ো না, বউ।
- তার মানে তুমি বোঝাতে চাইছ আমি ওকে মারধর করি!
- আমি সে কথা বলিনি। শুধু বলতে চেয়েছি, আমি আর তুমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই।
- ঠিক আছে। আর ন্যাকামো করতে হবে না। তোমার কথার মানে আমি বুঝি। এ বাড়িতে শুধু রোজাই গুরুত্বপূর্ণ। আমার কথার কোনো মূল্য নেই।
স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সোহেল মিয়া নরম গলায় বললেন,
- আরে এমন করে বলছ কেন? এ বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তুমি। সারা দিন রান্নাবান্না করো। আমার আর মেয়ের দেখাশোনা করো। আরও কত কী। আমি রোজগার করি ঠিক, কিন্তু ব্যয়ের খাতগুলো তুমিই পূরণ করো। আচ্ছা, কথা দিলাম এখন থেকে তুমি যেভাবে বলবে, আমি সেভাবেই চলব।
স্বামীর মুখের এমন কথা শুনে আকলিমা বেগমের আনন্দে লাফাতে ইচ্ছা করে। সোহেল মিয়া স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
- আবার কী ভাবছ? আমার গামছাটা নিয়ে এসো। এক্ষুনি কাজে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আকলিমা বেগম ঘরের ভেতর থেকে গামছাটা এনে স্বামীর হাতে দিলেন। সোহেল মিয়া স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে কাজের খোঁজে চলে গেলেন।
সকাল সাড়ে ১০টা। কুয়াশারা এখনো হারিয়ে যায়নি। পুবাকাশের সূর্যটা এখনো শীতে আড়ষ্ট হয়ে লুকিয়ে আছে। একটু পরপর শীতের হিমেল হাওয়াও বইছে। রোজা তার নতুন মায়ের পাশে রান্নাঘরের চুলার কাছে বসে আছে।
শুকনো কাঠ আর পাতা দিয়ে জ্বলছে চুলা। আকলিমা বেগম ওর দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
- কী রে হতভাগিনী, আর কতক্ষণ এখানে বসে থাকবি। এবার যা, শুকনো পাতা কুড়িয়ে নিয়ে আয়। মনে রাখিস, পাতা আনতে না পারলে আজ তোর বিপদ আছে। পাতা আনলেই দুপুরের খাবার পাবি। খাবি তো কাজ করে খা।
রোজা মন খারাপ করে বেরিয়ে যায়। পাতা কুড়ানোর জন্য প্লাস্টিকের থলেটা কাঁধে নিয়ে বাড়ির দক্ষিণের বনের দিকে চলে আসে সে। এ বনে অনেকগুলো গাছ। এক-দুইটা করে পাতা ঝরলেও সে অনেক পাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু অনেক পাতা তো দূরের কথা! আজ এক-দুইটাও দেখা যাচ্ছে না! তবে কী কেউ আগে এসে সব পাতা নিয়ে গেছে! এখন কী হবে! খালি হাতে ঘরে ফিরে গেলে মা মারবেন। খেতেও দেবেন না। এসব ভাবতে ভাবতে কেঁদে ওঠে রোজা।
একাকী একটি মেয়েকে বনের মধ্যে হঠাৎ কাঁদতে দেখে গাছের পাতাদের খুব মায়া হলো। পাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক পাতাটি রোজাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
- এই রোজা, তুমি এভাবে একা কাঁদছ কেন? তোমাকে কেউ বকেছে?
গাছের পাতাদের মুখে কথা শুনে রোজা থ বনে যায়। সে চারদিকে ভালোভাবে লক্ষ করে। কিন্তু কোথাও কাউকে না দেখে আবার গাছের পাতাদের দিকে লক্ষ করে। বয়স্ক পাতাটি আবার বলে উঠল,
- রোজা, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমরা তোমার সঙ্গে আছি। এখন বলো আজ তোমার কী হয়েছে? প্রতিদিন হাসিখুশি থাকো। আজ কান্না করছ কেন?
রোজা কাঁদো গলায় বলল,
- আমার মা নেই। মাকে আমি অনেক ডাকি। কিন্তু মা আমার কোনো কথাই শোনেন না। আমার কাছে আসেন না। আব্বুকে রোজ মায়ের কথা জিজ্ঞেস করি। আব্বু বলেন, ‘তোমার মা চলে গিয়ে নতুনভাবে ফিরে এসেছে।’ আমার নতুন মা-ই নাকি আমার মা। প্রথম প্রথম আমার কাছে আব্বুর কথাই সত্য বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হয়, আমার নতুন মা আমার সেই মা না। সেই মা আমায় কত আদর করতেন! আর নতুন মা শুধু বকেন আর মারেন। তোমরাই বলো, মায়েরা কী কখনো এমন হতে পারে?
পাতারা সমস্বরে বলে উঠল,
- না, পৃথিবীর কোনো মা-ই এমন হতে পারে না।
সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বয়স্ক পাতাটি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
- আচ্ছা, এখন তোমার সমস্যা কী?
- আমার নতুন মা বলেছেন শুকনো পাতা কুড়িয়ে নিতে। কিন্তু আজ কোনো শুকনো পাতা পাচ্ছি না। এখন আমি কী নিয়ে যাব? আসার সময় মা আমায় জোর গলায় বলেছেন, আজ যদি পাতা নিয়ে না যাই, তবে আমার নাকি বিপদ হবে। দুপুরের খাবারও খেতে দেবেন না।
এ কথা বলে রোজা কেঁদে ওঠে।
ছোট্ট রোজার দুঃখের কথা শুনে পাতাদের মুখও এক মুহূর্তে ভার হয়ে গেল। তারাও একসঙ্গে কান্না শুরু করল। আবার বয়স্ক পাতাটি সবার কান্না থামিয়ে রোজাকে উদ্দেশ করে বলল,
- তোমার দুঃখে আমরা সবাই খুব ব্যথিত হয়েছি। তুমি কী আমাদের পাতাদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছ?
- হ্যাঁ, পেয়েছি। কিন্তু আমার কষ্টে তোমরা কেন কাঁদছ?
- আমাদের যেমন কোনো পাপ নেই, তেমনি তোমার মতো ছোটদেরও পাপ নেই। তোমাদের মনে কেউ কষ্ট দিলে স্বয়ং খোদা কষ্ট পান। আর আমরা তো সেই খোদারই সৃষ্টি।
- তা ঠিক।
- আজ কয়েক দিন ধরে খুব শীত পড়ছে। সঙ্গে কুয়াশাও। সূর্যও উঠছে খুব বেলা করে। যার দরুন পাতারা দ্রুত শুকায়নি।
এ কথা বলে বয়স্ক পাতাটি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রোজা বলল,
- কী হলো! কোনো কথা বলছ না যে?
- ভাবছি।
- কী ভাবছ?
- কীভাবে তোমার উপকার করা যায়?
- তোমরা কীভাবে আমার উপকার করবে!
- শোনো রোজা, ইচ্ছা থাকলে যে কেউ উপকার করতে পারে। পরের উপকার করার মাঝে মনে শান্তি আসে।
- তুমি একদম ঠিক কথা বলেছ।
হঠাৎ বয়স্ক পাতাটি চিৎকার করে বলে উঠল,
- আইডিয়া! আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।
রোজাসহ সব পাতা একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল,
- কিসের আইডিয়া?
বয়স্ক পাতাটি পটপট করে বলতে লাগল,
- রোজা আমাদের ছোট গাছ থেকে ছোট ছোট পাতাযুক্ত ডাল ছিঁড়ে ওর নতুন মায়ের কাছে নিয়ে যাবে।
অন্য পাতারা বলল,
- এতে কী রোজার সমস্যার সমাধান হবে?
- হবে।
- কীভাবে?
- রোজা গিয়ে ওর নতুন মাকে বলবে, আজ বনে সে কোনো শুকনো পাতা খুঁজে পায়নি। তাই গাছের কাঁচা পাতা নিয়ে এসেছে। খালি হাতে তো ফেরেনি।
- তোমার কথায় যুক্তি আছে।
এরপর সবার অনুরোধে রোজা ছোট গাছের পাতাযুক্ত বেশ কিছু ডাল ছিঁড়ে নিল।
দূর থেকে মায়ের ডাক শুনে রোজা পাতাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরের দিকে ফিরে আসে।
রোজার হাতে কাঁচা পাতার ডাল দেখে আকলিমা বেগম তেড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
- বলি, এতক্ষণ ধরে কোথায় ছিলি?
- মা, আমি ওই বনে পাতা খুঁজেছি। কিন্তু আজ কোনো শুকনো পাতা পাইনি। তাই এগুলো নিয়ে এসেছি।
রোজার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই আকলিমা বেগম ওর কচি মুখে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দিয়ে চেঁচানো কণ্ঠে বললেন,
- সারা দিন খাই খাই করতে পারিস। একটু পাতা কুড়িয়ে আনতে বলেছি। তাতেই এত ঢং। আমার জন্য কাঁচা পাতা নিয়ে এসেছিস। এ পাতা তোর মরা মায়ের কাছে দিয়ে আয়। তার কাজে লাগতে পারে। আমার লাগবে না। কাঁচা পাতা না ছাই।
এ কথা বলে আকলিমা বেগম ঘরের ভেতর চলে গেলেন। রোজা পাতাযুক্ত ডালগুলোর দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল।
রোজার হাতে থাকা একটি পাতা হঠাৎ বলল,
- কেঁদো না, রোজা। আমরা তোমার সঙ্গে আছি।
রোজা বিস্মিত হয়ে বলল,
- তোমরা আমার সঙ্গে থাকলে কী হবে? তোমরা তো কাঁচা পাতা।
- আরে কাঁচা হয়েছি তো কী হয়েছে! আমরা শুকনো পাতা হয়ে যাব।
- কীভাবে?
- ওই দেখো আকাশের পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠছে। তুমি এক কাজ করো, আমাদের সবাইকে সূর্যের আলোর দিকে মুখ করে রেখে দাও। আমরা দুপুরের প্রখর তাপে শুকিয়ে শুকনো পাতা হয়ে যাব।
- তাতে তোমরা তো কষ্ট পাবে।
- আমরা কষ্ট পেলে কিচ্ছু হবে না। অন্তত তোমার নতুন মায়ের হাত থেকে আগামীকাল তো বাঁচতে পারবে। আর কথা বাড়িও না, রোজা। আমাদের রোদের দিকে রেখে দাও।
রোজা হাতের পাতাযুক্ত ডালগুলো রোদের দিকে মুখ করে রেখে দিল।