পোশাকি সভ্যতার ভেতরের রূপ ‘আদিম’

‘আদিম’ সিনেমার দৃশ্যছবি: পরিচালকের সৌজন্যে

কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে একসময় ট্রেনে বালিগঞ্জ যাতায়াত করতাম। লাইনের ধারে সারিবদ্ধ বস্তিতে অসংখ্য মানুষের বাস। পরিচিত অনেকের মুখেই শুনেছি, পার্ক সার্কাসের কাছাকাছি ছুটন্ত ট্রেনে লেডিস কম্পার্টমেন্টে বস্তি থেকে ধেয়ে এসে সময় বুঝে রে রে করে উঠে পড়ত একদল ছিনতাইকারী। ধারালো ছুরি বের করে ভয় দেখিয়ে গলার চেইন, মানিব্যাগ, হাতের মুঠোফোন—এসব কেড়ে নিয়ে ছুটন্ত ট্রেন থেকে আবার নেমে পালিয়ে যেত।

হাওড়া মেইন লাইনে ভিড়, ট্রেনে আমার বাবার পকেট থেকে টাকা খোয়া গেছে বেশ কয়েকবার। হাওড়া স্টেশনের সাবওয়ে দিয়ে এখনো প্রতিদিন অফিস যাতায়াত করি। কড়া নেশার দ্রব্য টেনে নিয়ে নারী–পুরুষ কিছু ভবঘুরকে দেখতে পাই। গভীর নেশার ঘোরে লাশের মতো পড়ে আছে। পুলিশ এদের লাঠিপেটা করলেও নেশা না কাটা পর্যন্ত এরা ওঠে না। আবার সাবওয়ে দিয়ে বেরিয়ে হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে অফিস যাওয়ার সময় ভোরের দিকে কতবার মুঠোফোন ছিনতাই হতে দেখেছি।

এই কথাগুলো শুনে কলকাতা সম্পর্কে কেউ ভীত হবেন না। এগুলো সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু ঘটে। কথাগুলো লেখার কারণ, ‘আদিম’ চলচ্চিত্রে যুবরাজ শামীম যে মানুষের জীবনের কথা বলতে চেয়েছেন, এই মানুষগুলোকে আমি চিনি। টুঙ্গিপাড়া রেলস্টেশনের পাশে ব্যাংক মাঠের বস্তির জনজীবনের কথা হলেও দেশ–কাল–স্থান ভেদে এই জীবন অমিল নয়।

হাওড়া বালিতে আনন্দনগর নবজীবনপাড়াতে ২৫ বছর ধরে এক টুকরা জমিতে ঘর করে আমরা বাস করছি। আমার পাড়াতে কিছু উদ্বাস্তু, কিছু অবাঙালি রিকশাচালক, ভ্যানচালক, রং মিস্ত্রি, আইসক্রিমওয়ালা প্রভৃতি পেশার মানুষের বসবাস। এখানে যখন কারও সঙ্গে কারও ঝগড়া হয়, তখন ঘরে বসে আমার কবিতা লেখার ঘোর কেটে যায়। এই পাড়ায় বছরে ৮–৯ মাস পানি জমে থাকে। পানিতে ডুবে বাচ্চা মারা যায়। নানা কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। খুনের ঘটনাও মিডিয়াতে উঠে আসে। পুলিশ আসে, নেতা আসে, প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটে; কিন্তু দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজ তেমন কিছু হয়ে ওঠে না।

অস্তিত্বের সংকটে মানুষ ছিনিয়ে নিতে, ছিনিয়ে খেতেও দ্বিধা করে না। বাঁচার তাগিদে পশুর মতো মানুষ একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। বাঁচার তাগিদে মানুষ শরীরে দগদগে ঘায়ের চিকিৎসা করান না। কারণ, এই ঘা দেখিয়ে সে ভিক্ষা করে খান।

আজকের কলকাতা এবং আশপাশের জেলা সদরে বিউটি পারলার, বডি ম্যাসাজের নামে মধুচক্রের রমরমা ব্যবসা। রাস্তাঘাটে খোলাখুলি বডি ম্যাসাজের বিজ্ঞাপন। এই মধুচক্রের ফাঁদে হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েরাই জড়িয়ে পড়েন বেশি।
আবার যেসব কারণে দরিদ্র মানুষের জীবনে এত সংঘাত, ভাঙচুর, ঐতিহাসিক বা তারও আগে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই এসব কিছুর পেছনে রয়েছে মানুষের পেটের ক্ষুধা, শারীরিক চাহিদার ক্ষুধা, লোভ, হিংসা ইত্যাদি।

অস্তিত্বের সংকটে মানুষ ছিনিয়ে নিতে, ছিনিয়ে খেতেও দ্বিধা করে না। বাঁচার তাগিদে পশুর মতো মানুষ একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। বাঁচার তাগিদে মানুষ শরীরে দগদগে ঘায়ের চিকিৎসা করান না। কারণ, এই ঘা দেখিয়ে সে ভিক্ষা করে খান। বাঁচার তাগিদে কিছু মানুষ অসৎ চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে নিজের সুস্থ–সবল শরীরের অঙ্গ, হাত অথবা পা কেটে বাদ দিয়ে আসেন। কারণ, নিজেকে বিকলাঙ্গ প্রতিবন্ধী দেখিয়ে ভিক্ষা জুটে বেশি।

অনেকটা সময় পেরিয়ে আসার পরও সমাজের আর্থসামাজিক বৈষম্য, কিছু মানুষকে সভ্যতার রেলগাড়িতে উন্নতির পথে এগিয়ে দেয় ঠিকই। কিছু মানুষ যেই তিমির, সেই তিমিরেই একটু বেশি পরিমাণে আদিম-ই থেকে যায়। আমরা কেউ আম খাই, কেউ আমের আঁটি খেয়ে পর্যন্ত বেঁচে থাকি। আদিম হলো পোশাকি সভ্যতার ভেতরের একটা রূপ। আদিম হলো মানুষের ভেতরের প্রবৃত্তি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের কাছে পরিচালক যুবরাজ ঋণী। সেই গল্পের চরিত্রই এখনো মিশে আছে টুঙ্গিপাড়ার বস্তির মানুষের ভিড়ে। তাঁদের সঙ্গে বাস করে, তাঁদের জীবনের গল্পকে স্ক্রিপ্ট করে, তাঁদের মুখের সংলাপকে হুবহু তুলে এনে, তাঁদের দিয়েই অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন যুবরাজ শামীম। প্রাগৈতিহাসিকের হাত ধরে ঘটে চলা ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।

তার মানে পৃথিবীর নাট্যশালায় সবাই নিজের চরিত্রে কুশীলব হয়ে অবস্থান করছেন। সেই অবস্থানকে পর্যবেক্ষণ করা একজন দায়বদ্ধ সৃষ্টিশীল মানুষের কাজ। আবার এই যে ক্ষুদ্র অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষ, উচ্চবর্গের নাক উঁচু প্রগতিশীলেরা, যাঁদের সংস্কৃতিমনস্ক ভাবতে পারেন না, তাঁদের ভেতরেও কিন্তু সৃষ্টিসত্তা বিরাজ করে। তাকে ঠিকঠাক তুলে আনার জন্য শুধু একজন কারিগর দরকার মাত্র।

পেশাদারি নায়ক-নায়িকা না রেখেও যুবরাজ এ ধরনের একটি কাজ করতে সফল হয়েছেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্প নিয়ে একটি গল্পমালা চলচ্চিত্রায়ণ করতে পেরেছেন। নিম্নবর্গের প্রান্তিক এই মানুষদের জীবনকে উদ্‌যাপন করতে শিখিয়েছেন। এই ধরনের চলচ্চিত্র বানিয়ে খুব বেশি টাকাপয়সা পাওয়া যায় না। কিন্তু চারদিকে রুচির দুর্ভিক্ষের এই অসময়ে দাঁড়িয়ে, মানুষের মধ্যে রুচি তৈরি করে চলার কাজটিও কারিগরকে নীরবে করে যেতে হয়।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত