ইন্দু, আমি চলে যাচ্ছি

ট্রেনপ্রতীকী ছবি
কাউকে বুঝতে দিল না। শুধু আস্তে করে বলল, ‘সরি, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ তারপর সে স্বাভাবিক হয়ে বসল। আমাদের দ্বিতীয়বারের মতো চোখের পলক বিনিময় হলো।

ইন্দু আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। সে দৃশ্য সরাসরি দেখতে পারছি না। ট্রেনের কামরায় যে আয়না আছে, সে আয়নায় তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে তার মায়াবী মুখটা। ঘুমালে সব মানুষকে মায়াবী দেখায় কি  না জানা নেই। ইন্দুর মুখে সে মায়াটা দেখতে পারছি। মেয়েটা একেবারে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তার নিশ্বাস স্পষ্ট টের পাচ্ছি। ঝাপসা আয়নায় বারবার ঘুমন্ত মুখটা দেখছি। আজকে ট্রেনটাও চলছে একেবারে ধীরগতিতে। মাথার ওপর চারটা ফ্যান ঘুরছে। জানালা দিয়ে বাইরের বাতাস আসছে। গরমে বাতাসের শীতল উপস্থিতি আর ট্রেনের মৃদু ঝাঁকুনিতে তার ঘুমের গভীরতা বেড়েছে। আমি চুপচাপ বসে আছি।

ছোট–বড় মিলে আমরা মোট নয়জন এক কামরায়। দুইটা ছোট বাচ্চা সারাক্ষণ ফড়িংয়ের মতো তিড়িংবিড়িং করছে। তাদেরকে তাদের বাবা সামলাচ্ছেন আর মা চোখ রাঙাচ্ছেন। যাত্রাপথে আছে বলে হাত তুলতে পারছেন না। একজন মাথার ওপরে স্লিপিং বেডে ঘুমাচ্ছে। আর দুজন সম্ভবত সদ্য বিবাহিত দম্পতি। কবুতরের জোড়া। একজনের সঙ্গে আরেকজন চিপকে বসে আছে। একটু পরপর খিলখিল করে হাসছে। তাদের কথা পাশেরজন শুনতে পারছে কি না সন্দেহ। একেবারে আস্তে আস্তে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। ট্রেনটা সবুজ মাঠ, ঘরবাড়ি, গাছপালা ফেলে ছুটে চলছে সামনের দিকে।

ইন্দু ঘুমানোর আগপর্যন্ত যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। থাকে রোকেয়া হলে। মেয়েটা নিঃসন্দেহে অলস প্রকৃতির। একবেলা এক পদ রান্না করে তিনবেলা খায়, মাঝেমধ্যে সেটা তিন দিনে গড়ায়। হাত–পায়ের আঙুল সরু আর লম্বা লম্বা। সে ক্ষেত্রে তুখোড় মেধাবী সেটুকু বলাই যায়। যতক্ষণ সে সজাগ ছিল, সেই সময়ের পর্যবেক্ষণে এতটুকু অব্দি জানতে পেরেছি। কিন্তু আমি পড়েছি বিপদে। তাকে সরিয়ে দেওয়ার শক্তিটা পাচ্ছি না। একটা ঘুমন্ত মেয়েকে কীভাবে জাগিয়ে তুলি। বিবেকে বাধা দিচ্ছে। একটু ঘুমাচ্ছেই তো, ঘুমাক না। নতুন বিয়ে করা দম্পতিটা আমাদের দিকে আড়চোখে মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছে। আমাদের নিয়ে কী ভাবছে কে জানে। ইন্দু ঘুমাচ্ছে।

কাউকে বুঝতে দিল না। শুধু আস্তে করে বলল, ‘সরি, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ তারপর সে স্বাভাবিক হয়ে বসল। আমাদের দ্বিতীয়বারের মতো চোখের পলক বিনিময় হলো। কারও মুখে কথা নেই। যে যার মতো। দুজনই নিশ্চুপ। ব্যাগ থেকে একটা কবিতার বই বের করে পড়তে থাকলাম। সে মোবাইলে ডুব দিল। ঘণ্টা দেড়েক যাওয়ার পর দেখি আবার ঘুম। এবার আর কাঁধে মাথা রাখেনি। একা একাই ঘুমাচ্ছে। সাহস করে তাকাচ্ছি তার দিকে। কোথায় থেকে একটা মাছি এসে তার মুখে বসছে। যেটা বিরক্ত করছে তাকে। হাত দিয়ে দুয়েকবার তাড়িয়েও দিয়েছি। সামনে বসা সদ্য বিবাহিত দম্পতির মেয়েটা, সেই দৃশ্য তার সঙ্গীকে দেখাচ্ছে।

আমি আবার বইয়ে মনোযোগ দিলাম। পাশে হাঁ করে ইন্দু ঘুমাচ্ছে। ঘুমের সঙ্গী হয়েছে পিচ্চি মেয়ে দুইটাও। হঠাৎ দেখি আবার সে কাঁধে হেলে পড়েছে। আর কী করা! আমাকে সে ভার বহন করতেই হচ্ছে। সবাই ভাবছে আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা। সেই ভুল ধারণা আর ভাঙাতে চাইনি। যার যা ভাবার ভাবুক। এরই মধ্যে গন্তব্যে চলে এলাম। ট্রেনের মধ্যে থেকে এক তরুণীর মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে আসছে, ‘সম্মানিত যাত্রী সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি…’। এবার আর না ডেকে থাকতে পারলাম না। আস্তে করে ডাকলাম, ‘এই যে শুনছেন?’ সে আবার হুড়মুড়িয়ে উঠল। লাজুক মুখে সেই একই কথা, ‘আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার সময় বলে এলাম, ‘ইন্দু, আমি চলে যাচ্ছি।’ মেয়েটা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল। আমাদের কোনো কথা হয়নি আর।