বৃষ্টি ও জোছনাপ্রেমী লেখক হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা একাত্তরের শহীদ ফয়জুর রহমান, মাতা আয়েশা ফয়েজ। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিমার রসায়নের ওপর পিএইচডি অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। রসায়ন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করলেও বাংলার সাহিত্যাকাশে লেখালেখির ভুবনে গল্পের জাদুকর হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। ৩১ বছর ধরে বর্তমান প্রজন্মের পাঠকের কাছে তাঁর বই মানে অনেকটা মজার ভোজন রসদের মতো। পাঠককে শিখিয়েছেন কীভাবে বৃষ্টি উপভোগ করতে হয়। কীভাবে জোছনার সুধা পান করতে হয়।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ পাঠকদের বইয়ের মাধ্যমে শিখিয়েছেন, কীভাবে তৃতীয় নয়ন দিয়ে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়। কীভাবে উপভোগ করতে হয়। বৃষ্টিতে ভেজা, বৃষ্টির ঘ্রাণ নেওয়া, বাদলাদিনে প্রিয়জনকে কদম ফুল দেওয়া, জোছনাভাঙা রাতে প্রিয়জনকে নিয়ে আনন্দ আড্ডা দেওয়া, সমুদ্রবিলাস করা। প্রকৃতির কাছে তিনি বারবার ছুটে যেতেন। প্রকৃতির সঙ্গে অদৃশ্য ভালোবাসা বিনিময় করতেন। সমুদ্র সৌন্দর্যরানি প্রবাল দ্বীপে নিজের পরিকল্পনায় তৈরি করেছেন সমুদ্রবিলাস নামে ছোট কুটির। প্রায় সময়ই লেখক ছুটে যেতেন সমুদ্রস্নান করতে, সমুদ্রের গর্জন শুনতে, গভীর রাতে সমুদ্রপারে জোছনা উপভোগ করতে।
জীবনের শেষ দিনগুলোয় তিনি প্রকৃতিকে উপভোগ করেছেন। নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদে লেখক লিখেছেন, ‘ম্যাপলগাছের ওপর নির্লজ্জের মতো চাঁদ উঠেছে, তার থাকার কথা ছিল বাঁশবাগানের ওপর। বাংলাদেশের দুঃখিনী চাঁদ আমাকে ভালোবেসে কংক্রিটের নিউইয়র্ক নগরে চলে এসেছে।’
নুহাশপল্লীতে চাঁদনি রাতে গানের আসরের আয়োজন হতো। গৃহত্যাগী জোছনা নিয়ে লেখক একটা অসাধারণ কবিতা লিখেছেন, ‘প্রতি পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই গৃহত্যাগী হওয়ার মতো জোছনা কি উঠেছে? বালিকাভোলানো জোছনা নয়। যে জোছনায় বালিকারা ছাদের রেলিং ধরে ছোটাছুটি করতে করতে বলবে, ও মাগো, কী সুন্দর চাঁদ। নবদম্পতির জোছনাও নয়, যে জোছনা দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন, দেখো দেখো নীতু, চাঁদটা তোমার মুখের মতোই সুন্দর।’ কত রোমান্টিক জোছনাপ্রেমী হলে এত সুন্দর কবিতা তাঁর মনের আকাশে জোছনার মতো উদিত হয়।
নুহাশপল্লীতে জোছনারাতে লেখক অবস্থান করতেন তাঁর প্রিয়জন এবং খুব কাছের মানুষদের নিয়ে। রাতভরে আড্ডা দিতেন, লবঙ্গ-আদা মিশ্রিত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গান উপভোগ করতেন। গানের আসর চলত গভীর রাত পর্যন্ত, কখনোবা ভোর হয়ে যেত। গুন গুন করে গাইতেন ‘চাঁদনি প্রসরে কে আমায় স্মরণ করে, কে এসে দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে, তাহারে চিনি না আমি সে আমারে চিনে’। চাঁদের বিশালতা মানুষের মধ্যেও আছে।
বৃষ্টির দিনেও দেখা যায় গল্পজাদুকরকে বৃষ্টি নিয়ে গান লিখতে, ‘বাদলাদিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান...বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর নদে এলো বান। যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো, চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে এসো গান করি’।
হুমায়ূন আহমেদ নিজের জীবনকে বৃক্ষ ও প্রকৃতির মধ্যে পুরোপুরি বিলিয়ে দিয়েছেন। কল্পনার রাজ্যে প্রকৃতিকে এমনভাবে উপভোগ করেছেন যেন জলজোছনার ছায়ার সঙ্গে জীবন বাস্তবতার চিত্র চোখের সামনে খেলা করে।
২০১২ সালে ১৯ জুলাই বৃষ্টি ও জোছনাপ্রেমী লেখক হুমায়ূন আহমেদ অগণিত ভক্ত পাঠককে কাঁদিয়ে তুমুল বৃষ্টির ছোঁয়া নিয়ে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে প্রিয় লেখকের জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। ঢাকায় আমার দেখা সবচেয়ে বড় জানাজার নামাজ। তিল পরিমাণ জায়গা ছিল না ঈদগাহ মাঠে। জানাজা নামাজ শেষে কফিনের কাছে ছুটে গেলাম। এত ভিড়! অনেক ধাক্কাধাক্কি করে একসময়, কফিন যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বহু প্রতীক্ষার পর কফিন স্পর্শ করলাম। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। আকাশ ভেঙে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছিল। প্রিয় লেখকের কফিনের স্পর্শ লেগে রইল। শুভ্র বর্ণের বৃষ্টিভেজা কফিনটি গাড়িতে যখন ওঠানো হলো, বৃষ্টির মধ্যে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। জানি আমার কান্না কেউ দেখছে না। কিন্তু প্রিয় লেখক ঠিকই দেখেছিল। মনে হচ্ছিল মিসির আলির কোনো এক অদৃশ্য হাতের স্পর্শ আমার মাথায় রেখে বলছে, ‘কেঁদো না বাবা! মনে রেখো পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অলৌকিক সংগীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়।’
বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা